পড়ে পড়ে আর মার খাবে না দলিতরা

পড়ে পড়ে আর মার খাবে না দলিতরা

Sunday August 14, 2016,

6 min Read

আমাকে যে কাঁদাবে তার ভাগ্যে আছে কাঁদন--
image


আমার তখন অল্প বয়স। আমরা থাকতাম মির্জাপুরে। এমন একটা শহর যেটা দুটো ঐতিহাসিক শহর এক বেনারস আর এলাহাবাদের মাঝে পড়ে রীতিমত স্যান্ডউইচ। বাবা আয়কর দফতরে কাজ করতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলা বাবার অফিসের পিওন আমাদের বাড়িতে আসতেন। প্রতিদিন চা বিস্কিট দেওয়া হত। কিন্তু এটুকুই। ওঁর কাপ প্লেট আলাদা করা ছিল। আমরা স্টিলের বাসনে খাবার দাবার, চা টা খেতাম। কিন্তু ওঁকে দেওয়া হত পোরসেলিনের বাসনে। এই বাসনটা আমাদের ব্যবহার্য বাসনের সঙ্গে রাখাও হত না। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যাবেলা ওগুলো ধুয়ে মুছে রেখে দেওয়া হত। তখন তো ছোট ছিলাম। বিশেষ কিছু আমলই করতাম না। তবু একদিন মাকে কৌতূহল বশত জিজ্ঞেস করেছিলাম।

আমার মা। উত্তর প্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে। লেখা পড়া জানতেন না। খুব সরল ভাবেই উত্তর দিয়েছিলেন, “আরে ওরা শিডিউল কাস্ট না ?...” ছোট ছিলাম, তাই উত্তরটায় তেমন কিছুই আপত্তির খুঁজে পাই নি। কিন্তু যত বড় হলাম। শিক্ষার খোলা আকাশের নিচে দাঁড়াতে শিখলাম। কলেজে গিয়ে আরও ভালো করে চিনতে শিখলাম আমাদের সমাজ কাঠামো। তখন টের পেলাম মার সেদিনের উত্তরটার কী মর্ম। মা সেদিন যা বলেছিলেন, সেটা আর কিছুই নয়, হাজার বছরের প্রাচীন এক ধ্যান ধারণা সামাজিক প্রথার বহমানতার সুরে সুর মিলিয়ে মা বলেছিলেন। যাকে আমরা অস্পৃশ্যতা বলি। আরেকটা জিনিসও আমার স্মরণে আছে ওই পিওন ভদ্রলোক আমাদের খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু কোনওদিন আমাদের ছোননি। আমাদের বাসন কোসন ধরেননি। চা বিস্কুট খাওয়া হলে নিজের কাপ ডিশ নিজেই জল ধোয়া করে রেখে দিতেন। বাইরে দাওয়ায় উপুড় করে।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি যত বড় হয়েছি, আমার বন্ধুদের পরিধি বেড়েছে, সমাজের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমার বাড়িতে বন্ধুরা এসেছে, মা অত খেয়াল করার ফুরসতই পাননি, কে উচ্চবর্ণ কে নিচু জাত কে মুসলমান। উঠেছে বসেছে এক সাথে খেয়েছে। মা যখন জানতে পেরেছেন একটুও হইচই করেননি। গেল গেল রব তোলেননি। সহজভাবেই গোটা বিষয়টাকে গ্রহণ করেছেন। এই কাহিনির প্রস্তাবনার অর্থ হল অস্পৃশ্যতা সমাজের দুদল লোকই একটা সময় কোনও প্রশ্ন না করেই মেনে চলত। লক্ষ্মণ রেখা পার করতে চাইত না কোনও দলই। কিন্তু সময় যেভাবে এগিয়েছে সমাজ যেভাবে বিবর্তিত হয়েছে তাতে কিছু মানুষের ভিতর এই কাঠিন্য দূর হয়েছে। একটু একটু করে ঔদার্য উঁকি দিয়েছে।

আমার মার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। খুবই সরল প্রকৃতির মহিলা ছিলেন মা। বোকাও বলতে পারেন। কখনও জটিল হতে শেখেনইনি। তখনও যেমন ছিলেন এখনও তেমনি পুজো আচ্চা নিয়েই আছেন। আমার বাবাও তাই। নিজে সেযুগের গ্র্যাজুয়েট। সরকারি উঁচু পদে চাকরি করতেন। উদারপন্থী ভাবধারা ছিল। কিন্তু মায়ের জীবন যাত্রায় কিংবা তাঁর পছন্দ অপছন্দে কখনও নাক গলাননি। দুজনের কেউই আমার বন্ধুদের জাতপাত নিয়ে তিলমাত্র উদ্বিগ্ন নন। তবে এখনও রোজ সকালে ওঠেন। স্নান টান সেরে পুজো করেন তবে মুখে কিছু দেন। বিশেষ পুজোর দিনে দুজনেই উপোষ করেন। এর মধ্যে আমাদের জন্যে কোনও শিক্ষা আছে কি? হ্যাঁ নিশ্চয়ই আছে! আমার বাবা মা হিন্দু এবং ধর্মপ্রাণ। কিন্তু ওঁরা ধর্মান্ধ নন। তাঁরা উন্নততর উদার আলোয় নিজেদের বদলাতে পেরেছেন। জীবনের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়েছেন প্রগতির দিকে। তাঁদের কাছ থেকেই উদারতার অনেক শিক্ষাই আমি পেয়েছি। ওরা যদি এরকম না হতেন আমি এটা ভেবেই শিউরে উঠি। ওরা যদি আমাদের মান্ধাতার আমলের সামাজিক নিয়ম কানুন কুসংস্কার মেনে চলার ফতোয়া দিতেন তাহলে কী হত?

গত মাসে আমি খুবই মনটা খারাপ ছিল। বিশেষ করে একদল গো রক্ষকের হাতে দলিতদের মার খাওয়ার ছবিটা দেখলাম। গা রি রি করে উঠল। মনে পড়ে গেল আমার ছোটবেলার কথা। আমার বিশ্বাস গো রক্ষকদের এই জঘন্য অপরাধ দীর্ঘদিন ধরে ওদের মনের ভিতর প্রথিত কুশিক্ষার, পক্ষপাতিত্বের, হিংসার বিকারগ্রস্ততার এমন বিষোদ্গার যে তারা দলিতকে মানুষের সম্মানই অপারগ। আমি কোনও মতেই এটা মানতে রাজি নই যে এটা গরু রক্ষা করার অতি উৎসাহের ফসল। তাই যদি হত তাহলে রাস্তায় হাইওয়েতে গরু গুলো যখন গাড়ি চাপা পড়ে তার প্রতিবাদ করত। সেই ধরণের দুর্ঘটনা বন্ধ করতে উদ্যোগী হত। আহত গরুদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করত। মোদির সরকারের কাছে গোটা দেশে গোমাংস বন্ধ করার আর্জি জানাত। তার বিরক্ত হত এটা শুনে যে মোদির আমলেই ভারত গোমাংস রফতানিতে দুনিয়ায় একনম্বর হয়েছে। কিন্তু কোথাও এ নিয়ে কোনও গো রক্ষকের মুখে টু শব্দ নেই।

চলুন এটা এবার মেনে নিই, যে অস্পৃশ্যতা ভারতীয় হিন্দু সমাজের কলঙ্কিত একটি সত্য। যা হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে। দলিতদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ চলছে এই সুদীর্ঘ সময় ধরে। তাদের কোনও দিনই কোনও অধিকার স্বীকার করা হয়নি। তারা সব সময়ই সমাজের বাইরের, কখনও সমান করে ভাবেইনি সমাজ। এটা পশ্চিম দুনিয়ায় দাসত্ব প্রথার সমতুল্য। শুধু একটা জায়গায় একটা সামান্য পার্থক্য আছে। সেটা হল যার সঙ্গে এই অস্পৃশ্যতা করা হচ্ছে এবং যে এই অস্পৃশ্যতা করছে উভয়েই ধর্মের দোহাই দিয়ে এই জঘন্য ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছে। কর্মফল, পূর্বজন্মের সুকৃতি এসব বিশ্বাস দিয়ে এই ব্যবস্থার ভিত তৈরি। এই জন্মে ভালো কাজ করলে পরের জন্মে ব্রাহ্মণ হওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে এরকম বিশ্বাসই বেঁচে থাকার একমাত্র মোটিভেশন। বাস্তবিক ভাবে যা নরক ছাড়া আর কিছুই নয়।

কলমের এক খোঁচায় ভারতীয় সংবিধান অস্পৃশ্যতা এবং অসাম্য মুছে দিয়েছে। আইনের চোখে সকলেই সমান। উচ্চবর্ণের মানুষের যা অধিকার দলিতদেরও সমান অধিকার দিয়েছে ভারতীয় সংবিধান। কিন্তু সমাজ এখনও জাতপাতের বিচার নিয়ে এখনও শতধা বিভক্ত। হাজার হাজার বছরের কুসংস্কার রাতারাতি তো আর বদলে যেতে পারে না। কিন্তু সংবিধানে ঘোষিত সাম্যের বানী দলিতদের মনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। তাঁরা এখনও অনেক বেশি গঠনমূলক। সামাজিক অধিকার দাবি করার হিম্মত রাখে। মানুষের সম্মান পাওয়ার জন্যে লড়াই করছে। যা তারা পেয়েছেন সংবিধানের হাত ধরে, কিন্তু ঘোর আপত্তি করছে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ। এবং এই সংঘাত থেকে তৈরি হচ্ছে সংঘর্ষও। ঐতিহাসিক ভাবে দলিতদের প্রাচীন প্রথা মনে করিয়ে দিতে, সমাজে তাঁদের অবস্থান চিহ্নিত করে দিতে, এক কথায় কঠিন শিক্ষা দিতে, উচ্চবর্ণের হাতে দলিত পীড়নের ঘটনা ঘটছে। এইভাবে সামাজিক প্রথার সামনে তাঁদের ঘাড় ধরে নিচে আরও নিচে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সাংবিধানিক ক্ষমতা, গণতান্ত্রিক অধিকার যা তাঁরা পেয়েছেন তাতে তাঁদের যে মাথা ধীরে ধীরে উঠছিল, যে স্পর্ধায় তাঁরা মাথা তোলার চেষ্টা করছিলেন সেই সাহসটাই ভেঙে গুড়িয়ে দিতে এই প্রতিহিংসার ঘটনা।

আমার বাবা মা হাজার বছরের ধর্মীয় প্রথার শিকার। যেই তারা বাস্তবের মুখোমুখি হয়েছেন, পরিস্থিতি বুঝেছেন অমনি নিজেদের সংশোধন করে নিয়েছেন। এখন ওঁরা একেবারে পরিবর্তিত মানুষ। তারা আর আধুনিকতার সঙ্গে লড়াই করেন না। বরং দুটো হাত দিয়ে সেটাকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু যারা দলিতদের পেটায় তারা ওই প্রাচীন প্রথা আগলে দেশকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দিতে চাইছে। তারা এমন একটি অমানবিক প্রথার রক্ষী যে প্রথা মানুষকে মানুষের সম্মান দেয় না। তারা পরিবর্তনের পরিপন্থী। তারা আধুনিকতার শত্রু। তাদের সঙ্গে লড়াই জরুরি। তাদেরকে পরাস্ত করা আশু কর্তব্য। এর মধ্যে একটাই সুখের কথা হল দলিতরা আজ অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, অনেক বেশি সংঘবদ্ধ, অনেক বেশি আলোকপ্রাপ্ত। আজ তাঁরা সমাজের এই কালো অন্ধকার দিকটার সঙ্গে লড়াইটা নিজেরাই লড়তে তৈরি। তাদের প্রাপ্য মর্যাদা শুধু দাবি করতে নয়, সমাজে এবং ইতিহাসে সেটা প্রতিষ্ঠা করতে ওঁরা আজ বদ্ধপরিকর।

লিখেছেন AAP নেতা সাংবাদিক আশুতোষ-অনুবাদ Team YS Bangla

(Disclaimer: The views and opinions expressed in this article are those of the author and do not necessarily reflect the views of YourStory)