টেনিস থেকে Burlap, সমৃদ্ধর সাফল্যের কাহিনি

টেনিস থেকে Burlap, সমৃদ্ধর সাফল্যের কাহিনি

Wednesday August 09, 2017,

5 min Read

পরিবেশ বন্ধু পাটের ফ্যাশনই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে কলকাতার তরুণ উদ্যোগপতি সমৃদ্ধ বর্মণের। একা সমৃদ্ধ নন সঙ্গে আরও দুজন আছেন, মুম্বাইয়ের রেওয়ান্ত লোকেশ আর দিল্লির করুণা পারিখ। তিন জনের টিম নিয়েই The Burlap People। অল্প দিনেই রকেট উত্থান বলতে যা বোঝায় তাইই পেয়েছে এই সংস্থা। বাজারে যেটুকু পরিচিতি সবটাই এই থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের খাটুনির ফল। আরও আছেন এক অনন্য সাধারণ কারিগর। তার কথাও শুনব।

image


বর্মণ পরিবারকে সবাই চেনে টেনিস দিয়ে। বাবা সত্যজিৎ বর্মণ নামজাদা টেনিস খেলোয়াড়। বোন শিবিকা দেশের হয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টেনিস ম্যাচ খেলছেন। একডাকে শিবিকাকে গোটা টেনিস বিশ্ব চেনে। আর লামার্টের ছাত্র সমৃদ্ধও বড় হয়েছেন টেনিসের সঙ্গেই। শিবিকার কোচ যদি ওঁর বাবা সত্যজিৎ বাবু হয়ে থাকেন তবে অনুপ্রেরণা অবশ্যই দাদা সমৃদ্ধ। দেশে বিদেশে নানান শহরে টেনিস খেলতে গিয়েছেন এই তরুণ উদ্যোগপতি। বলছিলেন নিজের ছোটবেলার কথা। টেনিসটাই একটা সময় স্বপ্ন ছিল সমৃদ্ধর।

২০১১ সালে কলেজের পাট চুকিয়ে বাবার সংস্থারই মার্কেটিং দেখাশোনার দায়িত্ব পান। পাটের ব্যাগ তৈরি করে দেশ বিদেশের বাজারে বিক্রি করাই সমৃদ্ধদের প্রায় ৪০ বছরের পুরনো পারিবারিক ব্যবসা। কিন্তু সমৃদ্ধর কিছু নতুন করার ইচ্ছে ছিল। ফলে পারিবারিক ব্যবসা সামলানোর কাজটায় ততটা তৃপ্তি পাননি। ছেড়ে দিয়ে স্পোর্টস ট্যুরিজম সংস্থায় চাকরি নেন। খেলার সঙ্গে নাড়ির যোগ। তাই ভেবেছিলেন মজা পাবেন কাজটায়। বেশিদিন সেটাও করা হল না। কারণ ২০১৫ সালে তিনি একটি নামী কর্পোরেট সংস্থায় কাজ পান। কিন্তু কাজটা শুরু করার পর মনে হয় নিজের জন্যে কিছু করতে হবে। ভেতরে ভেতরে অন্য একটা খেলা চলছিল। সামনে ধেয়ে আসা বলটা খালি ঠুকে দেওয়ার খেলা খেলতে চাইছিলেন না। আরও অগ্রণী হয়ে ম্যাচটা জিততে চাইছিলেন। কেরিয়ারের কোর্টে তিনিই নেতৃত্ব নিয়ে ম্যাচটা জিততে চাইছিলেন। লুথার কলেজে পড়ার সময় থেকেই ফ্যাশন আর নানান ধরণের ফেব্রিকের সঙ্গে পরিচয় হয়। বাড়িতে ছোটবেলা থেকে পাটের কারবার দেখে এসেছেন। তাই আর দেরি করেননি। নেমে পড়েন নিজের ব্যবসায়। দ্য বারল্যাপ পিপল সংস্থা খুলে ফ্যাশন দুরস্ত পাটের ব্যাগ তৈরি করে দেন।

এই কাজে বাড়ির লোকেদের প্রচুর সাহায্য পেয়েছেন বলে জানালেন সমৃদ্ধ। পাটের ব্যাগই তো পারিবারিক ব্যবসা তাতে আধুনিকতার ছোঁয়া দিচ্ছেন সমৃদ্ধ। এটা দেখে মা এবং ওর বড়মা দুজনেই সাহায্য করেন প্রাথমিকভাবে। একজন টেনিস প্লেয়ারের শিল্পী আর ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার কাহিনির এটাই শুরু।

তারপর একদিন সমৃদ্ধর সঙ্গে দেখা করুণার। গড়িয়ায় সমৃদ্ধর ওয়ার্কশপে গিয়েছিলেন নিজের ব্যাগের ডিজাইন পছন্দ করতে। যা দেখলেন তাতে মুগ্ধ হয়ে যান। তখনই সিদ্ধান্ত নেন দ্য বারল্যাপ পিপলের সঙ্গে জুড়ে যাবেন। বছর বত্রিশের মডেল, লেখিকা, প্রাক্তন টিভি হোস্ট করুণা পারিখ। আর রেওয়ান্ত লোকেশ সমৃদ্ধর কলেজের বন্ধু। কলকাতায় বেড়াতে এসেই পাটের প্রেমে পড়া। সমৃদ্ধর কর্মযজ্ঞ দেখে আর ফেরা হয়নি। আলবিদা করে দিলেন কর্পোরেট দুনিয়ার লোভনীয় চাকরি। রয়ে গেলেন কলকাতায়। দ্য বারল্যাপ পিপলের সঙ্গে। এই দলের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য নুর উদ্দিন। ব্যাগের কারিগর। নুর উদ্দিনের হাতেই রূপ পায় বারল্যাপ প্রডাক্ট।

স্টার্টআপ মানেই বিজ্ঞাপনের জন্য লিমিটেড বাজেট। সোশ্যাল মিডিয়া সেক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ। কিন্তু সমৃদ্ধ বরাবরই একটু অন্য রকম ভাবে ভাবতে ভালোবাসতেন। ঠাণ্ডা মাথার টেনিস প্লেয়ার প্রথম সেটেই তাড়াহুড়ো করতে চাইছিলেন না।ঠিক করে নেন ইনস্টাগ্রাম ছাড়া প্রথমে কোনও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করবেন না। তার পেছনে কারণও ছিল। শুরুর দিকে স্টকে কিছুই ছিল না। অর্ডার পেলে তবে ব্যাগ তৈরি হত। বেশি অর্ডার পড়লে চাপ নেওয়াটা সমস্যার ছিল। ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজ না থাকায় ব্যবসার ফ্লো কম ছিল, অনেক কাস্টমর হারাচ্ছিলেন ঠিকই কিন্তু ইনস্টাগ্রামে পড়ে থাকাটা খারাপ আইডিয়াও ছিল না। প্রডাক্টের নিজস্ব পরিচিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। TBP এর আদর্শ এবং লক্ষ্য যারা পছন্দ করেছেন সারা বিশ্বে সেই ধরণের ক্রেতাদের আলাদা করতে পেরেছিলেন করুণারা। ফেসবুকে বড্ড ভিড়। সেই হিসেবে ইন্সটাগ্রাম অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন, সরাসরি অ্যাপ্রোচ করা যায়। প্রডাক্টের ছবিও অনেক পরিষ্কার, যে সুবিধা ফেসবুকে নেই। বোঝাচ্ছিলেন সমৃদ্ধ।

লঞ্চের পর মাত্র ক’মাসে ইন্সটাগ্রামে ব্র্যান্ডের কয়েক হাজার ফলোয়ার তৈরি হয়ে যায়। দেশ ছাড়িয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকায়, পাকিস্তান, বেলজিয়াম, সুইডেনে ছড়িয়ে যায় বারল্যাপের ক্রেতা। বলিউড তারকা পরিনীতি চোপড়া থেকে অরুণোদয় সিং, শিল্পী সাবা আজাদ, শিবানী দান্ডেকর, টেনিস তারকা এবং সমৃদ্ধর শিবিকাও TBP-র খদ্দের তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেন।

প্রত্যেকটি ব্যাগ খদ্দেরদের সঙ্গে কথা বলে তৈরি হয়। তাঁরা কী চান, কী ধরনের আইডিয়া দিচ্ছেন সব শোনেন ওরা। তারপর নিজেরা ডিজাইন করেন তাঁদের নিজস্বতা দিয়ে। এরপর নুর উদ্দিনের কাজ শুরু হয়। একটা ব্যাগ তৈরিতে সপ্তাহ দুয়েক সময় লাগে। ফলে কাস্টমরের কাছে যখন সেটা পৌঁছয় তখন সেটা শুধু ব্যাগ থাকে না, এক একটা কাহিনি যেন বুনে দেওয়া থাকে। বলছিলেন রেওয়ান্ত।

এতদিন জুটের সঙ্গে চামড়া ব্যবহার করতেন ওরা। এবার সম্পূর্ণ অর্গানিক ব্যাগ তৈরি করতে চাইছেন। আনারসের ছিবড়ে থেকে তৈরি একধরণের জৈব টেক্সচার দিয়ে ব্যাগ বানানোর কথাও ভেবেছেন ওরা। চলছে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা। এর জন্যে প্রয়োজনীয় ইনপুটগুলি ওদের ক্রেতাদের কাছ থেকই পান। ওরা প্রত্যেকেই নিজেদের লোভনীয় কেরিয়ার হেলায় ছেড়ে কলকাতায় পড়ে আছেন একটাই লক্ষ্যে, এবং সেটার কেন্দ্র আছে পরিবেশ চিন্তা। প্রাক্তন সঞ্চালক করুণা বুঝিয়ে দিলেন তাঁদের মিশন।

শুরুর ৬ মাসের মধ্যে ব্রেক ইভেনে পৌঁছে যায় বারল্যাপ। এখন মাসে ১৫ শতাংশ হারে লাভ বাড়ছে। হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে খদ্দেরের সংখ্যা। খদ্দের রিটেনশন বা খদ্দের ধরে রাখার কাজটাও দারুণ করছেন ওরা। প্রতি মাসে ২০ জন করে বাড়ছে ক্রেতা। এখনও বুটস্ট্র্যাপ করছেন। পরিবারের সাহায্য পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু বাইরের কোনও ফান্ডিং নেওয়ার কথা এখনও ভাবেননি। কলকাতায় স্টার্টআপ তৈরির ক্ষেত্রে সমৃদ্ধর বক্তব্য খুব পরিষ্কার, কলকাতা থাকার জন্যে, ব্যবসা শুরু করার জন্যে তুলনামূলক ভাবে সস্তার শহর। কিন্তু সৃজনশীল প্রতিভাও অফুরন্ত আছে। ফলে মানবসম্পদের দিক থেকে কলকাতা প্রথম পছন্দ হওয়াই স্বাভাবিক। তাই কলকাতাতেই শুরু করা। পাশাপাশি ভাবে কলকাতা ওর নিজের শহর। বড় হয়ে ওঠার শহর। এর অন্ধি সন্ধি সব ওর চেনা। তাই কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু কলকাতার বাইরে ওদের প্রোডাক্ট অবশ্যই পাওয়া যায়। নিজেদের কোনও আউট-লেট এখনও নেই। কিন্তু গোয়া, দিল্লির মত শহরে ওদের প্রোডাক্ট পাওয়া যায়। তাছাড়া কলকাতাতেও টি-আ-মে কাফে তেও পাবেন ওদের প্রোডাক্ট। সমৃদ্ধদের মূল চ্যালেঞ্জ ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া। মুখে মুখে নাম ছাড়ানো। আর অর্গানিক গ্রোথ। বিজ্ঞাপনের জন্যে তাই কোনও খরচ করতে একেবারে নারাজ সমৃদ্ধ-করুণা-লোকেশ।