প্রেমের রঙে রঙিন RangRage

প্রেমের রঙে রঙিন RangRage

Friday December 04, 2015,

4 min Read

টাইম্‌স স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। নোটিশ বোর্ডের সামনে ভিড়। লিস্টে নিজের নামটাও খুঁজে পেয়ে বেশ উত্তেজিত ইন্দরের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে গগণ জৈন। কিন্তু মনে একটা খচখচ। কারণ নতুন জায়গা, সবার সাথে ঠিকঠাক মানিয়ে নিতে পারবে তো! লিস্টে একবার চোখ বোলাতেই 'যেন প্রাণ আসল ধড়ে'। খুঁজে পেলেন আরও একজন জৈনের নাম। নীতি জৈন। মেয়ে! লাজুক স্বভাবের গগণের মুখে তখন দেখার মতো দুষ্টু হাসি। 

চোখে চোখ রাখার আগেই গগণজোরা কল্পনা করে ফেলেছিল ছেলেটি। দেখা হওয়ার পর কল্পনা তাঁর দুডানা মেলে দিল। নামে মিল থাকলে কী হবে। দুজনের দুটো পৃথিবী দুরকম।

গগণ আর নিতি জৈন

গগণ আর নিতি জৈন


সম্ভ্রান্ত স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে নীতি। গগণের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। কোর্স শেষ হওয়ার পরেই পরিবারে একটা বড়সড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় গগণকে বাধ্য করে চাকরির চেষ্টা করতে। পরিবারের স্বার্থে কিছু একটা উপার্জন বাধ্যতামূলক। 

কলেজ জীবনে একসাথে ক্লাস, প্রোজেক্ট তৈরি করা দুই বন্ধুর মধ্যে হঠাৎ করেই একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। গগণ আর নীতির চলার পথটা যেন আচমকাই আরও দূরে আরও দূরে সরে গেল। কলেজ শেষে দুজনেই চাকরি পেয়ে গেলেন টাইম্‌স অফ ইন্ডিয়ায়। কিন্তু পোস্টিং হোল দুজায়গায়। কিছুদিন চাকরি করে গগণ নতুন চাকরি পেয়ে চলে গেলেন দুবাই। সেখানে ল্যান্ডমার্ক রিটেলে বেশ ভালো একটা চাকরি পেয়ে গেলেন। আর নীতিও চলে গেলেন জয়পুর। দুজনেই নতুন জায়গায় নতুন দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন। 

চাকরিসুত্রে দেশের ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে গেলেও একটা টান দুজনের মধ্যে থেকেই গিয়েছিল। বিদেশে কয়েকবছর কাটিয়ে দেশে ফিরলেন গগণ। দুবাইয়ের দিনগুলোয় নীতির অভাব টের পাচ্ছিলেন গগণ। দেশে ফিরেই হন্য়ে হয়ে খুঁজেছেন নীতিকে। বলিউডি প্রেমকাহিনি নয়। মানুষের জীবন থেকে উঠে আসা সত্যিকাহিনি।

ইন্টারনেটে নীতিকে খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি। গুগলটকে সম্পর্ক মেরামতির কাজটাও হয়েছে। মেঘ না চাইতে জল পাওয়ার মতো করে দুজনেরই বাড়ির লোক তাঁদের বিয়ে নিয়ে চিন্তায় ছিলেন। ফলে প্রেমের পরিণতি পেতেও খুব একটা অসুবিধা হলনা। দুই বাড়ির সম্মতিতেই সম্পন্ন হল শুভ পরিণয়। এই হ্যাপি এন্ডিং কাহিনির শেষ নয়। বরং সবুর করুন। এখানেই গল্পের ট্যুইস্ট।

ডেনিম জিন্স থেকে RangRage 

সালটা ২০১১। বিয়ের পর দুজনের মধ্যেই নতুন কিছু করার তাগিদ কাজ করে। কী করবেন! ভাবতে ভাবতে দুজনে ঠিক করেন একটা বই লিখলে কেমন হয়।তাও আবার উদ্যোগপতিদের জন্যে। তারা বিষয়টা নিয়ে বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। উৎসাহ দেওয়ার বদলে বেশিরভাগই তাদের নিরুৎসাহিত করেন। কেউ বলেন একটা বই লিখতে গেলে তাদের আরও একটু ভালো করে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হওয়া চাই। আবার কেউ বলেন যে বই লেখার আগে লেখার অভ্যাসটা জরুরি। ব্লগ লেখার আদর্শ জায়গা। এতসব উপদেশ মাথায় নিয়ে তাঁরা বুঝতে পারলেন যে বই লেখার আদর্শ সময় এটা নয়, তাই বাতিল হল পরিকল্পনা।

ডিজাইনার ডেনিম  জিন্স

ডিজাইনার ডেনিম জিন্স


সেবছরই অক্টোবরে গগণের কাছে একটা আমন্ত্রণ এল প্যারিস থেকে। একটা আন্তর্জাতিক ফ্যাশান কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ। প্যারিসের মতো জায়গায় আমন্ত্রণ বলে কথা, তায় আবার আন্তর্জাতিক ফ্যাশান শো। একটু ভালো ড্রেস পরে যাওয়া দরকার অবশ্যই। নীতি নিজের হাতে গগণের জন্য একটা জিন্সের প্যান্ট ডিজাইন করে দিলেন। স্মৃতি ঘাঁটতে গিয়ে গগণ ইওরস্টোরি কে বলছিলেন, যখন সে ওই জিন্স টা পরে আইফেল টাওয়ার ঘুরতে যান, তখন যেন ওখানকার সেন্টার অফ অ্যাট্রাকশণ ছিলেন গগণই। সবাই নিজের নিজের কাজ থামিয়েও নীতির তৈরি করা ডিজাইনার জিন্স দেখতে শুরু করে দিল। অনেকটা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ডিজাইন। নীতির হাতের কাজের খুব অপ্রত্যাশিত ভাবেই খুব ভালো একটা রেসপন্স পাওয়া গেল। সেখান থেকেই গগণ ফোন করে নীতিকে জানালেন সেই ইউরেকা মুহূর্তটা। সৃষ্টির আনন্দে ডগমগ নীতিও। দেশে ফিরেই উঠে পরে লাগলেন দুজনে। জন্ম নিল RangRage – হাতে আঁকা ডিজাইনার কাপড়ের এক অনন্য সম্ভার। 

চাহিদাটা ভালো করে বুঝে নেওয়ার জন্য প্রথমে তারা কিছু হাতে আঁকা টিশার্ট বাজারে ছাড়েন। নীতির হবি আসতে আসতে রূপ নিতে থাকে শুরুয়াতি ব্যবসার। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এই জৈন দম্পতি নিজের মতো করেই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তাঁদের সংস্থাকে। আজ RangRage শুধুমাত্র গগণ আর নিতির ব্যবসা নয় – এই প্রজন্মের অনেক শিল্পীর জন্যেই একটা বড় প্লাটফর্ম। নিজেদের সৃষ্টিকে তাঁরা আরও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন এই ই-কমার্স সাইটের দৌলতে। অনেক নতুন প্রতিভা খুঁজে পেয়েছেন নিজেদের স্বনির্ভর করার একটা শক্ত ভিত। শিল্পীরা হাতে পেয়েছেন তাঁদের শিল্প প্রদর্শনের একটা ভুবনজোরা ক্যানভাস।

গগণ-নীতিও খুশি। কারণ তাঁদের একটা উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। কিন্তু এসবের ফাঁকেও বই লেখার তাগিদটা মনের কোণে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু কিকটা আসছিল না। আড্ডার টেবিলেই একদিন এক বন্ধুর কথার ছলে বললেন ‘ লিখনা হ্যায় তো লিখ দো, নেহি ছাপেগি কোই বাত নেহি’, আর এই কথাটাই একটা ধাক্কা দিল ওঁদের। সত্যিই তো নিজের ইচ্ছাতে লেখাই যায়, ছাপা হবে কি হবেনা সেটা তো পরের কথা। দুজনের উৎসাহটা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল। আর যেমন ভাবা তেমন কাজ। প্রায় পঞ্চাশজন উঠতি ব্যবসায়ীর সাথে যোগাযোগ করলেন ওরা। এরমধ্যে প্রায় আটজন উৎসাহিত হয় ব্যাপারটাকে নিয়ে এবং অবশেষে ছয়জনকে নিয়ে প্রকাশিত হল গগণ আর নীতির প্রথম বই। বছর দুয়েকের চেষ্টায় সফল হল তাদের মনের মণিকোঠায় লুকিয়ে থাকা একটা স্বপ্ন।

ডিজাইনার  টাই

ডিজাইনার টাই


(লেখা – আদিত্য ভূষণ দ্বিবেদি, অনুবাদ – নভজিত গাঙ্গুলী)