উৎকর্ষের ই মুদিখানা এখন কলকাতায় চর্চার বিষয়

উৎকর্ষের ই মুদিখানা এখন কলকাতায় চর্চার বিষয়

Wednesday September 23, 2015,

5 min Read

কলকাতায় মাথা তুলছে একের পর এক স্মার্টআপ। শহরটা শুরুয়াতির শহরে বদলে যাচ্ছে ক্রমশই। আজ শোনাবো এমনই একটা স্টার্টআপের গল্প।

হাতে হাতে স্মার্ট ফোন, সস্তার ইন্টারনেট, থ্রিজি ফোরজির যুগে অসংখ্য অ্যাপস আপনার জন্যে হাজির। এসময় পিছিয়ে থাকার জাস্ট কোনও মানে হয় না। আপনি চাইলেই সব ঝক্কি ভ্যানিশ হতে পারে এক তুড়িতে, থুড়ি বাটনে। 

ধরুন, মুদিমালের মাসকাবারি বাজার করবেন। মাসের প্রথমে দোকানের সামনে লম্বা লাইন যে পড়বে, চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। সেই লাইন পেরিয়ে যখন কাউন্টারে পৌঁছলেন এবার ফর্দ মিলিয়ে সবকিছু নেওয়া, হিসেব কষে টাকা মেটানো...উফ্, ততক্ষণে ঘেমে নেয়ে একসা। সময়ও গেল। কিন্তু যদি বলি মুদির দোকানে লম্বালাইন এবার ভুলে যান। শুধু একটা ক্লিক। ঘরের দরজায় পৌঁছে যাবে তেল, নুন, চাল, ডাল-যা যা চাইবেন সব। একটুও বাড়িয়ে বলছি না। খাস কলকাতা এমনকি হাওড়াতেও সেটা সম্ভব হয়েছে তিন তরুণের স্টার্টআপ JustShop24 এর দৌলতে।

image


কলকাতায় উৎকর্ষ লোহিয়ার স্টার্টআপ আইডিয়া, হতে পারে ধার করা, কিন্তু তাতেও একটা নিজস্ব চ্যালেঞ্জ আছে। আর সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েই উৎকর্ষ লোহিয়া, চেতন শেঠি এবং পূরভ জৈন শুরু করেছেন ই কমার্স পোর্টাল JustShop24। কলকাতা এবং হাওড়ায় বাড়িতে বাড়িতে অর্ডার করা মুদিমাল পৌঁছে দেয় JustShop24। নিজেদের যা জমানো ছিল তার উপর ভর করে এই ই কমার্স পোর্টাল শুরু করেন তিন তরুণ। একটু থিতু হওয়ার পর এবার ব্যবসা বাড়াতে বিনিয়োগ জোগাড়ের পরিকল্পনা নিয়েছেন কলকাতার তিন মূর্তি।

উৎকর্ষ  লোহিয়া

উৎকর্ষ লোহিয়া


স্কুলে পড়ার সময় থেকে উৎকর্ষ ছিলেন কম্পিউটারের পোকা। ওয়েব ডিজাইন এবং নানা প্রজেক্ট নিয়ে ডুবে থাকতেন। উৎকর্ষের বাবার একটা বইয়ের দোকান ছিল। কম্পিউটারের সামনে না থাকলে উৎকর্ষ বাবার দোকানে বই নেড়েচেড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন। ‘বই নিয়ে কোনও জিজ্ঞাস্য থাকলে সবসময় খুঁজে দেখতাম অ্যামাজনে। পড়াশেনা শেষ করে তাই অনলাইন বুকস্টোর খোলার প্ল্যানিং ছিল। কিন্তু আমার পড়া যখন শেষ হল ততদিনে ফ্লিপকার্ট অ্যমাজনরা অনলাইন বইয়ের বাজারে জাঁকিয়ে বসে গিয়েছে’, বলেন হতাশ উৎকর্ষ। ‘ফলে ই-কমার্স মার্কেটে আর নতুন কী করা যায় যেটা মানুষের কাজে লাগবে তার খোঁজ শুরু করি। অনলাইন মুদিখানার আইডিয়াটা মাথায় ঘুরতে থাকে। কারণ সেই সময় এধরণের কোনও ব্যবস্থা কলকাতা বা তার আশে পাশের শহরে ছিল না’, বলে চলেন উৎকর্ষ।

উৎকর্ষ চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। নিজের ব্যবসা শুরুর আগে প্রায় চার বছর আর্নেস্ট অ্যান্ট ইয়ং-এ কাজ করেছেন। ই-কমার্সে সফল ব্যবসায়ীদের বিজনেস মডেল এবং কাছ থেকে তাঁদের কাজ করা দেখে দেখে রীতিমতো রিসার্চ করে ফেলেন। ‘এই ক্ষেত্রে বড় বড় সংস্থার ব্যবসার ধরন লক্ষ্য করতে থাকি। তাদের সবার বড় বড় গুদাম এবং সেখান থেকে সরবরাহ-একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলতে থাকে। ‘বিগবাস্কেট’এর মতো বড় সংস্থায় প্রতিদিন প্রচুর অর্ডার থাকে। প্রায় সব পণ্যের বর্ননা সমেত তালিকাও থাকে তাদের কাছে’, জানান উৎকর্ষ।

চেতন শেঠি

চেতন শেঠি


JustShop24 অবশ্য এখনও সেই জায়গায় পৌঁছতে পারেনি। ‘আমরা আপাতত তালিকায় সীমিত কিছু জিনিসপত্র রেখেছি। যেহেতু আমাদের শুরুয়াতি এবং এখনও বাজার ধরার চেষ্টায় আছি, সেই কারণে গ্রাহকদের চাহিদা এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিজেদের স্টকে চালু কিছু আইটেম রাখি। বাকিগুলির জন্য ডিলারদের সঙ্গে টাই-আপ করে নিয়েছি’, জানান উৎকর্ষ।

তবে উৎকর্ষের অনুযোগ, এই রাজ্যের মানুষ প্রযুক্তির সঙ্গে সড়গড় নন। তার উপর নতুন কিছুতে সবসময় বিমুখ। পাশাপাশি কলকাতা কিন্তু অত্যন্ত মূল্য সচেতন বাজার।

পূরভ জৈন

পূরভ জৈন


স্থানীয়ভাবে ব্যবসা শুরু করার অনেকগুলি সুবিধা আছে। ‘অফিসের জায়গা থেকে শুরু করে কর্মী নিয়োগ, ওয়েব ডিজাইনিং, গুদাম অন্যান্য জায়গা থেকে তুননামূলকভাবে সস্তায় পাওয়া যায়। একটা স্টার্টআপের পক্ষে প্রাথমিকভাবে প্রচুর খরচ বাঁচানো সম্ভব হয়। কলকাতায় বাজারে স্টার্টআপ খুব বেশি নেই। ফলে যে কোনও নতুন সংস্থার ক্ষেত্রে বাজার ধরার ভালো সুযোগ রয়েছে। অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় কলকাতায় এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছানো সহজ, খরচ কম।’ বলেন উৎকর্ষ।

চ্যালেঞ্জর কথা যদি বলা হয়, JustShop24 খুব একটা পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে চায় না, বরং সামনে কী আসছে তা নিয়েই বেশি উৎসাহী। আরও অনেক চ্যালেঞ্জ আছে যেগুলি পরের দিকে বেশ বেগ দেয়। ‘মাত্র কয়েক মাস (মার্চ,২০১৫) হল আমরা শুরু করছি। তাই সামনে আরও অনেক কঠিন সময় এবং চ্যালেঞ্জ পেরোনর অপেক্ষায় আছি। এখনও পর্যন্ত আমরা সংস্থা গড়ার প্রাথমিক কাজ করে ফেলছি যেমন, ঠিকঠাক লোক নিয়োগ, ক্রেতা এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কর্যকর দিক নির্দেশিকা ঠিক করা, এইসব চলছে। শুরুর তিন মাস পর থেকে বাজার ধরা, পরিচালনা, নতুন গ্রাহক ধরা এবং দক্ষতার সঙ্গে তাদের চাহিদা পূরণ করার দিকে নজর দিই’, জানান কলকাতার তরুণ উদ্যোক্তা উৎকর্ষ। ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই ছকে ফেলেছেন ওঁরা। ‘কলকাতার বাজারে ভালো জায়গা করে নিতে পারলে আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য হবে ওষুধ এবং অন্যান্য জিনিসপত্রও সরবরাহ করা। ভারতের অন্যান্য দ্বিতীয় সারির (টু টিয়ার) শহরগুলিতেও পা রাখার ইচ্ছে আছে। ধীরে ধীরে ব্যবসা যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে তরুণ উদ্যোগপতিদের উৎসাহ বাড়ছে। ‘ভারতে ই-কমার্সের বাড়বাড়ন্ত চারদিকে। ভারত এবং সারা বিশ্বে মুদিমাল হল সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রি। এই ক্ষেত্রটি খুব দ্রুত বাড়ছে এবং তাতে পা রাখতে পেরে আমরা বেশ লাভবানও হয়েছি’।

তাঁদের সংস্থা যেদিন বড় মাইলস্টোন পেরোল সেদিনের কথা বলতে গিয়ে আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন উৎকর্ষ। ‘প্রথম মাসে মার্কেটিংয়ে আমরা খুব বেশি খরচ করিনি। মার্কেটিং শুরু করার পর তরতরিয়ে চলছে ব্যবসা। শুরুতেই খুব বড় কোনও লক্ষ্য ছিল না। তবুও যা পেয়েছিলাম সেটাই আমাদের জন্য বিরাট ব্যপার ছিল। সপ্তাহে পাঁচ-ছটা ডেলিভারি দিয়ে শুরু করেছিলাম। সেখান থেকে দিনে ২৫ থেকে ৩০টি ডিলিভারিতে এসে পৌঁছেছি। কঠিন প্রতিযোগিতার বাজারে তাবড় তাবড় ওয়েবসাইট থাকা সত্বেও, শুরুর দুমাসের মধ্যে ‘online grocery shopping Kolkata’ এই কিওয়ার্ড নিয়ে গুগুল সার্চ ইঞ্জিনে চতুর্থ হয়েছি আমরা। প্রতিদিন ১০০ জনের বেশি আমাদের ওয়েবসাইট খুলে দেখছে। তার উপর আমাদের গ্রাহকদের প্রশংসাগুলি যখন পড়ি তখন মনে হয় ঠিক পথেই এগোচ্ছি’, এক নিশ্বাসে বলে চলেন উৎকর্ষ।

কলাকাতায় এখন বেশ কয়েকটি অনলাইন গ্রসারি স্টোর রয়েছে। তারা হল SaltnSoap, Homegennie এবং OnlineGroceryBazar। ‘আমরা একটা নতুন পলিসির কথা ভাবছি। সেটা হল ‘No questions asked return’ পলিসি। ক্রেতারা হোয়াটসঅ্যাপে অর্ডার দিতে পারেন, এবং আমরা ঠিক করেছি ব্যাগ বা ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্টের জন্য আলাদা কোনও চার্জ নেব না। আর সেই সিদ্ধান্তই প্রতিযেগীদের তুলনায় আমাদের এগিয়ে রেখেছে’।

বহু কষ্টে চাটার্ড অ্যাকান্ট্যান্সি পাশ করার পর, মোটা মাইনের নিরাপদ চাকরি ছেড়ে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ানোই ছিল উৎকর্ষের কাছে সবথেকে ঝুঁকির কাজ। কিন্তু শুরুয়াতি ব্যবসা করার সবচেয়ে ভালো দিক হল অসীম সম্ভাবনার বাজারে পা রাখার ক্ষমতা অর্জন করা। মুদিমাল সবার দরকার। আমার ওয়েবসাইটে মুদিমাল কেনার জন্য অটোচালকদেরও পেয়ে যাই।

একেবারে সদ্য উদ্যোক্তা হিসেবে উৎকর্ষ মনে করেন এখনও উপদেশ দেওয়ার সময় আসেনি।তবে একটা কথা বাববার বলছিলেন, ‘বেশি ভাবা নয়, শুরু করে দিন। সব কিছু খাপে খাপে পড়ে যাবে। যদি কিছু শুরু করেন আপনি সফল অথবা ব্যর্থ হতে পারেন। কিন্তু শুরুটাই যদি না করেন তাহলে ব্যার্থ বা সফল, কিছুই হওয়ার নেই’।