"মোদিকে কিস্তি দেবে বিহারের ফ্লোটিং ভোট"

"মোদিকে কিস্তি দেবে বিহারের ফ্লোটিং ভোট"

Wednesday October 21, 2015,

5 min Read

(লিখছেন সাংবাদিক রাজনীতিবিদ আশুতোষ)

image


দিল্লীর বিধানসভা নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে বিজেপি ব্যর্থ হয়েছে। বহুল প্রচলিত একটি কথা রয়েছে, যে “যারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, তারা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে – প্রথমবার ট্র্যাজেডি হিসাবে, এবং দ্বিতীয়বার প্রহসন হিসাবে”। বিজেপি নেতৃত্ব যদি বিচক্ষণ হত, তাহলে তারা দিল্লী নির্বাচনে নিজেদের চরম পরাজয় থেকে শিক্ষা নিত এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করত। কিন্তু দম্ভ, বিশেষ করে ক্ষমতা ও মতাদর্শের দম্ভ রীতিমত আত্মঘাতী হয়ে দেখা দেয়। অনেক বড় মানুষকেও তা এগিয়ে দেয় ধ্বংসের দিকে। বিহার নির্বাচনেও ঠিক সেইটাই হচ্ছে এবং দিল্লী, যা ছিল প্রধানমন্ত্রীর কাছে অ্যাকিলিস হিল এর মত, সেই দিল্লীর পর এটাও মোদীর আর বিজেপির কাছে দ্বিতীয় ওয়াটারলু হতে চলেছে।

দিল্লীর নির্বাচনের সময় আমি বলেছিলাম যে হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড ও জম্মু-কাশ্মীরে বিজেপির জয় আদতে বিজেপির প্রতি মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করেনা। বরং একটি ‘প্রকৃত বিকল্প’ শক্তির অনুপস্থিতিই ছিল বিজেপির জয়ের একমাত্র কারণই। তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন এবং সেইসময়ে অন্যান্য দলগুলির তুলনায় মোদী তথা বিজেপিকে তাঁদের সামান্য হলেও অধিক প্রতিশ্রুতিময় বলে মনে হয়েছিল। তাই সাধারণ মানুষ তাঁদের উপর আংশিক আস্থা রেখে তাঁদেরকে নির্বাচিত করেন। যদিও এই আস্থা কোনোভাবেই ‘চূড়ান্ত’ ছিল না। কিন্তু দিল্লীর রাজনৈতিক আবহ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপের ভাবমূর্তি এখানে অত্যন্ত উজ্জ্বল ছিল। কারণ তারা এক নতুন রাজনীতির কথা বলত। দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতির কথা বলত। বলত সততার রাজনীতির কথা। এবং শুধুমাত্র কথায় নয়, বরং ২০১৩ এর নির্বাচনের প্রাক্কালে এবং তার পরবর্তীতে ৪৯ দিনের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের সময় আপ তা কাজেও করে দেখিয়েছিল। দিল্লীর মানুষের কাছে আপ নিজেকে ‘প্রকৃত বিকল্প’ হিসাবে তুলে ধরতে পেরেছিল এবং নির্বাচনের ফলাফল ছিল সেটারই বাস্তব প্রতিফলন।

ভারতের নির্বাচনের ইতিহাসে দিল্লী একটা নতুন ধাঁচা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এবং ২০০৯ সাল থেকে এই ধাঁচা রীতিমত ফলপ্রসূ হয়েছে। ২০০৯ সালে, যখন কেউই মনমোহন সিংহর সাথে যেতে চায়নি, সেইসময় নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে কংগ্রেস এককভাবে ২০০’র অধিক আসনে জয়লাভ করে এবং বিজেপি লজ্জাজনক-ভাবে পরাজিত হয়। এটা ছিল এক তেজি অর্থনীতির প্রভাব। এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হবার সুবাদে মনমোহন সিংহই ছিলেন এই কৃতিত্বের দাবিদার। কোন দল অতীতে কি করেছিল, কিভাবে কোন দল তৈরি হয়েছিল – সেইসব ‘আদি কাণ্ড’ নিয়ে মানুষ যে আর ভাবিত নয়, এই নির্বাচনী জয় সেই সত্যটাকেই প্রকট করেছিল। মানুষ রাজনৈতিক পরিসরে নিজেদের দৈনন্দিন জীবন যাপন সংক্রান্ত নানান সমস্যা নিয়ে আলোচনা দেখতে চাইছিল এবং মেরুকরণও হয়েছিল তার ভিত্তিতেই। এই ঘটনাকে আমি ‘ভারতীয় নির্বাচনের আধুনিকীকরণ’ বলেই মনে করি।

রাজনীতির কুশীলবরা এটা ভুলে গিয়েছিলেন যে এমনকি অতীতের নির্বাচনগুলিতেও চার থেকে ছয় শতাংশ ‘ফ্লোটিং’ ভোট থাকত। ‘ফ্লোটিং’ – অর্থাৎ যারা শেষ মুহূর্তে স্থির করেন যে কাকে ভোট দেবেন। আধুনিক প্রযুক্তির অগ্রগতি ও ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণ – এই দুইয়ের প্রভাবে বর্তমানে এই ফ্লোটিং ভোটের সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট থেকে দশ শতাংশে। দীর্ঘদিন ধরে এদেশে জাত-পাত, ধর্ম, লিঙ্গ, বাহুবল, টাকাপয়সা ও নেশার দ্রব্যের লোভ এসবের সাহায্যে যেভাবে রাজনীতি হয়ে এসেছে, আজকের ভোটারদের কাছে রাজনীতির সেই চিরাচরিত ধরণ আর গ্রহণযোগ্য নয়। এখন মানুষ জেনে-বুঝে ভোট দেয়। এবং এই অংশের মানুষরাই আন্না হাজারের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। আর তাই মোদী যখন বিভিন্ন অ-সাম্প্রদায়িক ইস্যুকে সামনে রেখে নির্বাচনী প্রচার শুরু করলেন, এবং এর মধ্যে দিয়ে নিজের সাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তির ঊর্ধ্বে উঠে দেশের অবস্থায় বদল আনার প্রতিশ্রুতিকে সামনে রাখলেন, তখন মানুষ তাঁকে সমর্থন করল এবং ক্ষমতায় আনল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার ঠিক পরপরই মতাদর্শ-গত দিক থেকে মোদীর ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের বিভিন্ন ব্যক্তিদের নানারকম উস্কানিমূলক মন্তব্যে এই শ্রেণির মানুষের মোহভঙ্গ হল। দ্রুতই সাম্প্রদায়িক কর্মসূচীর পরিকল্পনা ও রূপায়ন শুরু হল এবং নির্দিষ্ট কিছু জনগোষ্ঠী ও ব্যক্তিবর্গ হয়ে উঠল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। মোদীর উচিত ছিল এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, যেটা তিনি করলেন না।

দিল্লী নির্বাচনের প্রাক্কালে মোদীর প্রচারের ধরন, তাঁর ভাষার ব্যবহার, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নামে বিষোদ্‌গার এবং অপ্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়কে নির্বাচনী প্রচারের কেন্দ্রে নিয়ে আসার মধ্যে দিয়ে দিল্লীর আমজনতার কাছে মোদীর স্বরূপ উন্মোচিত হল। যেটা এতদিন ছিল তাঁর ইউ এস পি, এবার সেটাই তিনি হারালেন। উদীয়মান নব্য ভারতীয় রাজনীতির পরিসরে অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং আপ হাজির হল মসিহ হিসাবে। পুরানো রাজনৈতিক ঘরানার প্রতিভূ বিজেপির বিরুদ্ধে আপ নিজেকে ‘প্রকৃত বিকল্প’ হিসাবে দাঁড় করাতে সক্ষম হল। দিল্লীর নির্বাচনের ফলাফল আমার বিশ্লেষণকেই বাস্তব প্রমাণ করল। বিহারেও এখন সেই একই জিনিস হয়ে চলেছে। মোদী/বিজেপি সেই একই ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। এবং দিল্লীর নির্বাচনের মত একইভাবে বিহারের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নীতিশ কুমারের প্রতি মানুষের অগাধ আস্থা। এটা একটা লক্ষণীয় বিষয়, কারণ উনি নয় বছর ধরে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন রয়েছেন। জনমত কখনওই তাঁর বিরুদ্ধে ছিলনা। মানুষ ওঁকে দেখেন এমন এক নেতা হিসাবে যিনি রাজ্যের চালচিত্রে গুণগত বদল আনতে সক্ষম হয়েছেন। মানুষ তাঁকে দেখেন উন্নয়নের মুখ হিসাবে। মিডিয়ার তীব্র কুৎসা এবং বিজেপির ব্যাপক প্রচার সত্ত্বেও কিছু রিপোর্ট অনুযায়ী বিহারের মানুষের কাছে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে প্রথম পছন্দ নীতিশ কুমার এবং দিল্লীতে যেভাবে অরবিন্দ কেজরিওয়াল জনপ্রিয়তার বিচারে মোদীর চেয়ে অনেকটাই এগিয়েছিলেন, একইভাবে এখানেও মোদীর চেয়ে নীতিশ কুমারের জনপ্রিয়তা অনেকটাই বেশি।

ভারতীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সমস্ত শ্রেণি ও সমস্ত জাতের মানুষের কাছেই নীতিশ সমান জনপ্রিয়। বিহারের রাজনৈতিক পরিসর, যেখানে রাজনীতি বরাবর ওতপ্রোতভাবে জাত-পাতের প্রশ্নের সাথে জড়িত হয়ে থেকেছে, সেখানে এই ঘটনার গুরুত্ব অপরিসীম। নীতিশ কুমার সবসময়ই উন্নয়নের কথা বলে এসেছেন। এবং মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ওঁর কাজের খতিয়ান ওঁর জনপ্রিয়তার একটা অন্যতম কারণ। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে লালুপ্রসাদ যাদবের সাথে তাঁর জোট হবার ফলে একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভোট তাঁর সপক্ষে যাবে এবং সেখান থেকে তিনি অবশ্যই লাভবান হবেন। কিন্তু দশ শতাংশ ‘ফ্লোটিং’ ভোটার, যাঁদের ভোট ক্ষমতার ভারসাম্যে এগিয়ে দেবে নীতিশ কুমারকে, সেই ভোটাররা কিন্তু নীতিশকে দৃঢ়ভাবেই সমর্থন করছেন।

এবং এই দশ শতাংশই নির্ধারক ভূমিকা নেবে। এই দশ শতাংশই কিন্তু ২০১৪ তে মোদীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু মোদীর কেবল ও কেবলমাত্র সংরক্ষণ, মাংসর উপর নিষেধাজ্ঞা, নিম্নবর্ণ, হিন্দু-মুসলিম, দলিত-মহা-দলিত, অগ্রসর-অনগ্রসর ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কর্মসূচী এই দশ শতাংশর সমর্থন নিজেদের পক্ষে রাখতে ব্যর্থ হয়েছ। অখলক হত্যা, সেই নিয়ে বিজেপি নেতাদের উস্কানিমূলক টিপ্পনী এবং গোটা ঘটনায় মোদীর নীরবতা এই দশ শতাংশকে বিজেপির প্রতি আরও ক্ষুব্ধ করেছে। সত্যি কথা বলতে গেলে, ভারতীয় জনসমাজের ‘নব্য উদীয়মান’ এই যে অংশ, যারা ২০১৪’র নির্বাচনে এই ভেবে মোদীকে ভোট দিয়েছিল যে এই লোকটা দেশের আর পাঁচজন ঘুণধরা রাজনৈতিক নেতার থেকে আলাদা, মোদী তাদের বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন। মোদীর কার্যকলাপ এই অংশকে হতাশ করেছে ঠিকই, কিন্তু তার জন্য ভারতের নির্বাচনের আধুনিকীকরণ বিহারে ক্ষেত্রে থেমে থাকবেনা। বরং তা মেরুকরণকেই আরও দৃঢ় করবে এবং দুর্বল করে দেবে ভারতীয় রাজনীতির চিরাচরিত ঘরানাকে। এর থেকে আমাদের সকলেরই শিক্ষা নেওয়া উচিত।

(বিশ্লেষণ লেখকের নিজস্ব মতামত)