অতিথিদের সেবায় তিব্বতি উদ্বাস্তু পরিবারের হক’স নেস্ট

অতিথিদের সেবায় তিব্বতি উদ্বাস্তু পরিবারের হক’স নেস্ট

Friday November 06, 2015,

4 min Read

ভারত নেপাল সীমান্তে হিমালয়ের কোলে এক ছোট্ট মায়াবী গ্রাম চিত্রে। পাঁচটি পরিবার ও একটি বৌদ্ধ মঠ, জনবসতির আয়তন বলতে এইটুকুই। মেঘের দেশ এই চিত্রে সান্দাকফু ট্রেক পথে প্রথম জনবসতি। ট্রেকের শুরুর চড়াই ভাঙার ক্লান্তি কাটাতে প্রায় প্রত্যেকেই খানিক জিরিয়ে নেন এই গ্রামে। অনেকেই আবার প্রথমদিনটি চিত্রেতেই কাটিয়ে শুরু করেন ট্রেক। আর এই সকলকেই আতিথেয়তা দিয়ে চলে এক তিব্বতি উদ্বাস্তু পরিবার, ফুংসক ও দোলমা ভুটিয়া।

হক’স নেস্ট, চিত্রে

হক’স নেস্ট, চিত্রে


১৯৬০ সালে দলাইলামাকে অনুসরণ করে যে ৮০,০০০ তিব্বতি দেশ ছেড়ে ছিলেন ফুংসকের বাবাও তারই একজন। পশুচারণকেই নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি। আস্তে আস্তে পথটি ট্রেকিংএর জন্য জনপ্রিয় হওয়াতে তিনি ঘোড়া ভাড়া দিতে শুরু করেন। বাড়তে থাকে পর্যটকের সংখ্যা। এরই মধ্যে হল্যান্ডের এক পর্যটক আসেন, পছন্দ হয় ফুংসকের দিদিকে, বিয়েও হয়ে যায় তাঁদের। ২০০২ সাল নাগাদ বাবার সাহায্যে বাড়িতেই একটি চায়ের দোকান খোলে ফুংসক। “এই রাস্তায় তখন অনেক পর্যটক আসতে শুরু করেছে, চিত্রে অবধি ওঠার রাস্তা খুবই চড়াই, আসে পাশে কোনও জনবসতিও নেই, পর্যটকরা খানিক জিরিয়ে নিতে চাইতেন, আমরা চা-জল খাওয়াতাম। তাই ভাবলাম দোকান খুলে অল্প কিছু খাবার দাবার যদি রাখা যায়”, বললেন ফুংসক। পরের বছরই একটি ঘরকে হোম স্টে হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন ফুংসকরা। সাড়া মেলে অসাধারণ, অনেকেই মানেভঞ্জনের ভিড় এড়াতে চলে আসেন চিত্রেতে। ২০০৪ এ নিজেদের ১২ টি ঘোড়া বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সিরিং ফুংসক ভুটিয়া ও তাঁর পরিবার। “তখন এ রাস্তায় গাড়ি চলছে, ঘোড়ার প্রয়োজনীয়তা কমেছে, অন্যদিকে জায়গাটির জনপ্রিয়তা বাড়াতে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছিল, একটা ঘরে সবাইকে জায়গা দিতে পারছিলাম না, অনেক সময়ই নিজেদের শোবার ঘরটিও ছেড়ে দিতে হত অতিথিদের”। ঘোড়া বিক্রি করে ৯০,০০০ টাকা পায় ভুটিয়া পরিবার, তা দিয়ে দোতলা একটি বাড়ি করে, তৈরি হয় হোম স্টে হক’স নেস্ট। জায়গার সৌন্দর্য ও ভুটিয়া পরিবারের উষ্ণ আতিথেয়তায় দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে হোম স্টে, ট্রেকারদের পাশাপাশি নিছক বেড়ানোর উদ্দেশ্যেও আসতে থাকেন অতিথিরা। আর্থিক সাচ্ছল্যের মুখ দেখেন ফুংসকরা।

সিরিং ফুংসক ভুটিয়া

সিরিং ফুংসক ভুটিয়া


বাঙালির উচ্চারণ অপভ্রংশে কবে যেন ফুংসকের নাম হয়ে গেছে ভিঞ্জো, আনন্দের সঙ্গে তা মেনেও নিয়েছেন তিনি, বললেন “ওটা ভালবাসার নাম”। ২০০২ সালেই ফুংসকের বিয়ে হয় দার্জিলিঙের মেয়ে দোলমার সঙ্গে, কনভেন্ট শিক্ষিত দোলমার আদৌ পছন্দ ছিলনা এই প্রত্যন্ত গ্রাম। “প্রথম প্রথম খুব মনখারাপ হত, এখানে তো কিছুই নেই। কিন্তু নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছি, আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে গেল। এখন ভালই লাগে, লোকজনও আসতেই থাকে, ওরাই শহরের গন্ধ নিয়ে আসে আমার জন্য। মরসুমের সময় তো দম ফেলার ফুরসৎ পাইনা”, বললেন দোলমা।

দোলমা ভুটিয়া

দোলমা ভুটিয়া


“আমাদের এখানে জিনিসপত্র সব পাওয়া যায় না, জলেরও সমস্যা রয়েছে কিছুটা, ইলেকট্রিক সবসময় থাকেনা, ইন্টারনেট নেই, ফোনের সিগন্যালেরও সমস্যা হয়, অনেক পরিষেবাই এখানে অমিল, তবু মানুষ আসেন, কেউ ট্রেক করতে তো কেউ শান্তিতে দু-চারদিন কাটিয়ে যেতে, অনেকেই ফিরে ফিরে আসেন, আমরা আমাদের ক্ষমতা অনুযায়ী যথাসাধ্য করার চেষ্টা করি”, বললেন ফুংসক।

গত বছরই আরও দুটি নতুন ঘর করেছেন ফুংসকরা, তাতেও জায়গার সমস্যা মিটছে না, জানালেন, “আমাদের এখানে যোগাযোগের অভাব রয়েছে, তাই অনেক সময়ই যোগাযোগ না করেই চলে আসেন অতিথিরা, তাঁদের তো ফিরিয়ে দেওয়া যায় না, যাবেনই বা কোথায়, পরবর্তী গ্রাম আড়াই কিলোমিটার দূরে, তাই নিজেদের ঘরে, খাবার জায়গায় ভাগাভাগি করে থাকার ব্যবস্থা করতে হয়ে, গাইড ভাইরাও থাকেন”।

image


কলকাতার নাকতলার বাসিন্দা অর্ণব বললেন, “আমি বছরে দু-তিনবার তো আসিই, কখনও একা, কখনও বন্ধুদের সঙ্গে, কখনও স্ত্রী-র সঙ্গে, অদ্ভুত একটা শান্তি রয়েছে, আর ভিঞ্জো-দোলমার আতিথেয়তা, সেবিষয় যাই বলি কম বলা হয়. আমি রাত একটায় পৌঁছেয় ওদের উষ্ণ আতিথেয়তা পেয়েছি এখানে। আরও যে অনেকবারই আসব সে কথা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখেনা”।

কলকাতারই আরেক বাসিন্দা অনন্যা বললেন, “এবারই প্রথম এলাম এদিকে ট্রেক করতে, তাই একদিন থেকেই চলে যেতে হচ্ছে, তবে আবার এসে কয়েকদিন থেকে যাওয়ার ইচ্ছে রইল”।

জিগমে

জিগমে


ফুংসক-দোলমার একমাত্র ছেলে জিগমে দার্জিলিঙের স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে, ছুটিতে বাড়ি এসে বাবা মায়ের সঙ্গে সেও হাত লাগায় অতিথি সেবার কাজে। রান্না থেকে ঘর পরিষ্কার, দুষ্টুমির ফাঁকে সব কাজেই সাহায্য করে জিগমে। ছোট থেকেই বছরের একটা বড় সময় বাড়ি ভর্তি লোক দেখতে অভ্যস্ত সে। “কত রকমের লোক আসে, সবাই ভাল, মজা করে, আনন্দ করে, আর লোকজন থাকলে বাবা মা পড়াশোনা নিয়ে বেশি চাপও দেয় না”, হাসি মুখে উত্তর জিগমের।

৫০০ মিটার দূরে আপার-চিত্রে থেকেই দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় এমন দুটি ঘর বানানোর ইচ্ছে ফুংসকের, তবে টাকা জোগাড় কবে হবে জানা নেই, হতে হতে ২০৮০ ও হতে পারে, হাসতে হাসতে বললেন সিরিং ফুংসক ভুটিয়া।