প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে জুবেইদার ‌‘জন্ম’

প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে জুবেইদার ‌‘জন্ম’

Tuesday August 25, 2015,

6 min Read

image


সমস্ত রকমের সামাজিক, আর্থিক বাধা ‌যেন শুধু মেয়েদের জন্য বরাদ্দ। যেমন সংসারে হাড় ভাঙা খাটুনি যেন একা মায়ের জন্য তুলে রাখা আছে। চোখের সামনে দেখেছেন খুড়তুতো পিসতুতো বোনেরা অথবা পাশের বাড়ির বন্ধবীরা হাতে পায়ে একটু বড় হলেই জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ সময়ে পড়াশোনার সুযোগই দেওয়া হয়নি। এই সবকিছুর মধ্যে থেকেও এক্কেবারে আলাদা জুবেইদা বাই। 

চোন্নাইয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেও আশেপাশের পরিবেশ তাঁর বেড়ে ওঠায় আঁচড় কাটতে পারেনি। নিজেকে তৈরি করেছেন। অন্যদের সুস্থ জীবনের পথ দেখিয়েছেন। তাঁর হাত ধরেই আলো দেখেছে ‍ ‘জন্ম’,মা ও নবজাতকের জন্য সুরক্ষার অনন্য সমাধান। বলা ভালো, সুরক্ষা কবচ।

বরাবরই প্রতিবাদী জুবেইদা নিজের পথ খুঁজে নিয়েছিলেন অন্যভাবে। শিক্ষা থেকে আশপাশের মেয়েরা ‌যখন বহু যোজন দূরে, জুবেইদা তখন ইঞ্জিনিয়র। অধ্যবসায়ের জোরে সুইডেনের দালারনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপ পান। সেখান থেকেই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর হন। ২৪ বছর বয়সে হাবিব আনোয়ারকে বিয়ে করে চলে ‌যান কানাডা।

কিন্তু সংসার পেতে চুপ করে বসে থাকার পাত্রী নন জুবেইদা। স্বামী আনোয়ার কানাডায় ‌যে সংস্থায় কাজ করেন,তারই একটি শাখা খোলা হয় ভারতে। তারপরই জুবেইদা ফিরে আসেন চেন্নাই। রুরাল ইনোভেশন নেটওয়ার্কে (আরআইএন) কাজ শুরু করেন। এটি এমন একটি সংস্থা,যারা গ্রামীণ উদ্ভাবনী শক্তিকে গুরুত্ব দেয় এবং কোনও ব্যক্তি বা সংস্থাকে পণ্য বাজারজাতকরণের নানা পরামর্শ দিয়ে থাকে। আরআইএন-এ কাজ করতে গিয়ে জুবেইদা লক্ষ্য করেন, অনেক ভালো ভালো সৃষ্টি সেভাবে বাজার পাচ্ছে না বানিজ্যিকীকরণের অভাবে। পরিস্থিতি বদলাতেই হবে, ভেবে নিলেন প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়ে বড় হয়ে ওঠা সেই মেয়েটি। নিজের অদ্ভুত উদ্ভাবণী ক্ষমতা আর স্বামী আনোয়ারের আর্থিক স্বচ্ছলতার জোরে দু‍’জনেই সিদ্ধান্ত নিলেন,কিছু একটা করতে হবে।

শিকাগোয়  ভাষণ দিচ্ছেন জুবেইদা

শিকাগোয় ভাষণ দিচ্ছেন জুবেইদা


জুবেইদা বাই সবসময় চেয়েছিলেন মহিলাদের, বিশেষ করে গ্রামের মহিলাদের পাশে দাঁড়াতে। সবসময় পাশে পেয়েছেন স্বামী আনোয়ারকেও। নিজের মা, বাড়ির আরও মহিলাদের ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখেছেন আনোয়ার। সেটাই ওঁকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ফোর্ট কোলিনসে কোলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে সোশ্যাল অ্যন্ড সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ নিয়ে এমবিএ করেন। তাবলে থেমে থাকেনি ব্যবসার কাজ। তারই অংশ হিসেবে বিভিন্ন জায়গা যখন ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন,তখন বাই লক্ষ্য করেন গ্রামে নবজাতদের জন্য অপিরচ্ছন্ন আঁতুড়ঘর। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় যেসব ‌যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয় অনেক সময় সেগুলি ঠিকমতো জীবাণুমুক্ত পর্যন্ত করা হয় না । জুবেইদা নিজেকেও সেই আয়নায় দেখতে পান। মনে পড়ে যায় নিজের প্রথম সন্তান জন্মানোর পর সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা। এক বছর সময় লেগেছিল সুস্থ হতে। কী করবেন ভাবতে আর সময় নেননি। মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে আমরা কাজ করতে ২০০৯ সালে আমেরিকায় তাঁদের সংস্থা নথিভুক্ত করেন, নাম রাখেন ‘আয়জ’। এভাবেই জন্ম নেয় ওঁদের স্বাস্থ্য পণ্য সংস্থা।

ব্যবসা শুরুর আগে একপ্রস্থ গবেষণা সেরে নেন স্বামী-স্ত্রী। সেই সময় নানা জায়গা ঘুরে তাঁরা কথা বলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, মাতৃস্বস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং গ্রামের বয়স্কদের সঙ্গে। কাজ করতে করতে উপলিব্ধ করেন এক তিক্ত সত্য। বুঝতে পারেন গ্রামের গরিব-গুর্বরা ‌যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় হাল তাঁদের শিশু জন্মের সময় আঁতুড়ঘর কতটা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হবে, যেখানে রাখা হয়েছ সেখানে মা ও শিশু কতটা নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যসম্মত বন্ধত্যকরণের কথা ভাববার উপায়ই নেই। সেই তিক্ত সত্য থেকেই পথ খুঁজে পায় ‘জন্ম’, ক্লিন বার্থ কিট, অর্থাৎ মা ও নবজাতকের জন্য পরিচ্ছন্ন সরঞ্জাম। ওই কিটেই প্রসূতিদের জন্য মিলবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত নানা সরঞ্জাম ‌‌যা নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করবে।

image


ক্লিন বার্থ কিট

ক্লিন বার্থ কিট


‘ জন্ম’ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন জুবেইদা।লড়াইয়ের সেই দিনগুলির কথা মনে করে বলেন, ‘ আমরা আমাদের সমস্ত জমানো টাকা, আমার গয়না, সবটাই তুলে দিই অজানা পথের হাতে।চেন্নইয়ের উপকেণ্ঠ একটি গ্রাম কুথাম্বকমকে জড়িয়ে নিই ব্যবসার সঙ্গে। সেখানকার মহিলাদের ‘জন্ম ’র কিট তৈরির কাজে লাগাই।‘ খুব সামান্য বানিজ্যিকীকরণ সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত ভারত, হাইতি, আফগানিস্থান এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ৫০,০০০ কিট বিক্রি করতে পেরেছে ‘আয়জ’। অন্যান্য দেশেও ‘ জন্ম’র চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে। গ্রহকের কাছে সরাসরি অথবা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালে ‘জন্ম’ কিট বিক্রি হয়। ‘জন্ম ’র পাশাপাশি আরও কয়েকটি পন্য বাজারে আনার কথা ভাবছে ‘আয়জ’। ‘জন্ম ’ কিটে থাকে নবজাতকের কিছু প্রয়েজনীয় জিনিসপত্র, প্রসূতির স্যাইনটেশন ও হাইজিন প্যাক,পরিশ্রুত জলের জন্য একটা ওয়াটার ফিল্টার।

একটা স্বপ্ন তো প্রায় সফল। কিন্তু এখানেই থেমে থাকা নয়। এবার আরও এগিয়ে ‌যাওয়া। ৫০,০০০ ডলার তোলার লক্ষ্য নিয়ে ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে। এই শিবিরে পণ্য নিয়ে আলোচনা, মোবাইলের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ, গ্রামীণ স্বস্থ্যকর্মীদের মোবাইলে ভয়েস মেসেজের মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন ধাত্রীবিদ্যা চর্চা সহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে ‘আয়জ’। ‘ক্রাউডফান্ডিং থেকে টাকা তুলে শুধু তহবিল বাড়ানোই নয়, এই মঞ্চকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সচেতনতার মঞ্চ হিসেবেও ব্যবহার করতে চাই। ‘আয়জ’এর তহবিল বাড়ছে সামাজিকভাবে প্রভাবিত বিনিয়েগকারীদের মাধ্যমে। আরও দুটি নতুন বিষয় নিয়ে আমরা ভাবছিলাম। তাতে আরও ৫০,০০০ ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা আছে। ‌যেভাবে আমাদের ক্লিন বার্থ কিটের চাহিদা বাড়ছিল আমরা বুঝতে পারছিলাম এটাই ঠিক সময়,‌ ‌যাঁরা পরিবর্তন চান,তাঁদের আরও বেশি করে এই কাজে নিয়ে আসা। এবং পরিচ্ছন্ন মা ও সুরক্ষিত নবজাতকের জন্য বিশ্বজুড়ে বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়া ’, বলছিলেন বাই।

প্রশিক্ষিত ধাত্রী

প্রশিক্ষিত ধাত্রী


২০১০ এ শুরু করে ‘আয়জ’এ এখন কর্মী সংখ্যা আট। ভারত এবং আফ্রিকার দেশগুলির বাজার ধরাই মূল লক্ষ্য। বাজারে ‘জন্ম ’র চাহিদা ‌যেভাএব বাড়ছে,তা পূরণ করতে প্রয়েজন ভালো সেলস টিম। সেটাই এখন জুবেইদাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হতে চলেছে। স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। পাশাপাশি সংস্থার ব্যবস্থাপনাতেও পরিবর্তন আনছেন। নতুন নতুন আরও পণ্য তৈরির কথা ভাবছেন। শুধু তাই নয়, আরও বড় অফিস, কাজে নিয়মিত নজরদারি, এবং আলোচনার মাধ্যমে আরও ভলো কিছু করার নিরন্তর চেষ্টা চলেছ। বাই জানান, ‘আগামী ৫ বছর আমাদের লক্ষ্য পণ্য বিক্রি বাড়ানো এবং ভারত ও আফ্রিকার দেশগুলিতে রিজিওনাল হাব অর্থাৎ শাখা অফিস খুলে ব্যবসা ছড়িয়ে দেওয়া যাতে পণ্যের বিক্রি বাড়িয়ে দ্রুত ব্রেকইভেন পয়েন্টে পৌঁছানো যায়।‘

ব্যবসা বাড়াতে আয়জ এবার ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলে ‌যাওয়ার কথা ভাবছে। ফলে আরও বেশ করে গরিব মহিলারা কাজ পাবেন। ‘আয়জ’ এর সেলস টিমের মাধ্যমে আঞ্চলিক বাজার ধরার চেষ্টা চলছে। জুবেইদার চ্যলেঞ্জ টাকা বা ফান্ড নয়,‌ যেটা সবরকম সামাজিক উদ্যেগে সবচেয়ে বড় বাধা। বরং শিশুর জন্মের সময় সংক্রমণ নিয়ে সচেতনতার অভাব এবং প্রসবের সময় পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অজ্ঞতা বেশি ভাবাচ্ছে উদ্যোক্তা দম্পতিকে। কম দামে ভালো মানের পণ্য গ্রাহকের হাতে ‌যাতে তুলে দেওয়া ‌যায়,সেই চেষ্টাই করছে ‘আয়জ’। আর সেটাই মহিলা এবং আরও ‌ারা সুবিধা পাবেন তাঁদের ‘আয়জ’এর পণ্য কিনতে উৎসাহিত করবে। ভারতে বছরে ২০ মিলিয়ন শিশুর জন্ম হয়। এতবড় বাজার থেক কতটা আয় হবে তার একটা লক্ষ্য আছে সংস্থার। সেটা আরও বাড়াতে ২০১৪র শেষে দ্বিতীয় দফা বিনিয়োগ হয়।

বাইয়ের লক্ষ্য আগামী পাঁচ বছরে বাজারে পাঁচ মিলিয়ন (৫০ লক্ষ)পণ্য বাজারে নিয়ে আসা। আরও একটা লক্ষ্য আছে। ২০১৮র মধ্যে ২০ মিলিয়ন মানুষকে ‘আয়জ’এর পণ্যের মাধ্যমে প্রভাবিতকরা। ‘ফেলে আসা দিনগুলির কথা ভেবে বুঝতে পারি, আমাদের অধ্যবসায় বৃথা‌ যায়নি। প্রসূতিরা, তাদের পরিবার, স্বাস্থ্যকর্মীরা ‘আয়জ’এর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এবং কিট ব্যবহার করে বুঝতে পারছেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং বন্ধত্যকরণ কতটা প্রয়েজন...কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি। মনে পড়ে যায় ‘স্টপিং বাই উডস অন অ্যা স্নোয়ি ইভনিং’এ রবার্ট ফ্রস্টের সেই লাইনগুলি...দ্য উডস আর লাভলি, ডার্ক অ্যন্ড ডিপ। বাট আই হ্যভ টু প্রমিজ টু কিপ। অ্যন্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।অ্যন্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ...গভীর ঘুমে তলিয়ে ‌যাওয়ার আগে আরও অনেকটা পথ আমাকে হাঁটতে হবে...’ বলে চলেন জুবেইদা বাই।