রিক্সা টেনে ভক্তিপদ মাইতি চালাচ্ছেন অনাথ আশ্রম

রিক্সা টেনে ভক্তিপদ মাইতি চালাচ্ছেন অনাথ আশ্রম

Saturday April 29, 2017,

3 min Read

আজ একজন মানুষের কথা বলব। ভদ্রলোক পেশায় দিন মজুর। অল্প জমি আছে। চাষ করেন। ভ্যান রিক্সা আছে সেটা টেনে সংসার চালান। কিন্তু সংসার তো এভাবে অনেকেই চালান। এই ভদ্রলোকের গল্পে টুইস্ট এখানেই, সংসার মানে ৫১ জন অসহায় অনাথ শিশুকে নিয়ে গড়া একটি আশ্রম। নিজের জীবন দিয়ে এই সব শিশুদের আগলে রেখেছেন ভক্তিপদ মাইতি। কাহিনির শুরু ২০০৬ সালে। সেসময় আয়লায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী এলাকা। ভেসে গিয়েছিল কয়েকশ পরিবার। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের হয়ে দুঃস্থদের উদ্ধারের কাজে যে শয় শয় যুবক ছুটে গিয়েছিলেন তাদের দলেই ছিলেন খেজুরির এই ভক্তিপদ মাইতি।

image


বাবা-মা স্বজন হারিয়ে সহায় সম্বলহীন অসহায় ছোট্টছোট্ট মুখগুলি দেখে বুকটা হাহাকার করে উঠেছিল ভক্তিপদর। ওদের ওই অথৈ সাগরে ফেলে ফিরে আসতে পারেননি। যে কজনকে পেরেছেন উদ্ধার করেছেন। জনা পনের শিশুকে দু হাতে করে তুলে এনেছেন কৃষ্ণনগরে নিজের ঘরে। তারপর গত দশ বছরে অসম লড়াই করেছেন ভক্তিপদ। মানুষের জন্যে কাজ করতে গিয়ে মাসুলও গুনেছেন অনেক। রিক্সা চালিয়ে, নিজের সামান্য জমিতে চাষ করে, প্রয়োজনে ভিক্ষা করে তিলতিল করে বড় করে তুলছেন এই শিশুদের। সরকার ফিরেও তাকায়নি। প্রশাসনও কোনও সাহায্যের হাত এগিয়ে দেয়নি। মানবিকতার দায়ে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন এই দিনমজুর। জনা পনেরকে নিয়ে শুরু করা তাঁর মিশন এখন আরও বড়। সংসারের বহরও বেড়েছে। এখন সংখ্যাটা ৫১। মা নেই বাবা নেই আত্মীয় স্বজন নেই ছোট ছোট ছেলে মেয়েগুলো যায় কোথায়! তাই নিজের বাড়িতেই মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছেন ভক্তি। দুবেলা দুমুঠো খাবারের সংস্থান করতে রাত দিন এক করে ফেলেছেন। এই দশ বছরে কী না করেননি। এই বাচ্চাদের জন্যে নিজেই স্কুল খুলেছেন। নিজের বাড়িতেই। অল্প শিক্ষিত ভক্তি চান তার সন্তানরা মানুষের মত মানুষ হয়ে উঠুক। কিন্তু পয়সা না দিতে পারলে যে মাস্টার মশাই পালিয়ে যায়। কখনও আসেন কখনও আসেন না। কোনও ক্রমে পড়াশুনো চলছে। গান শেখানোরও চেষ্টা করেন ভক্তি। প্রার্থনার গান। ভক্তিমূলক গান। ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন এই সমাজকর্মী। বলছিলেন, খাওয়া পড়ার মতো জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণ করতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত। তারপর ওদের পড়াশোনার খরচ। বাড়ির সামনের এক ফালি জমিতে সামান্য চাষবাস করে আর দিনভর ভ্যান চালিয়ে যা আয় তাতে আর কতটুকুই বা চলে। তাই তাঁকে গ্রামের মানুষের কাছে হাত পাততে হয়। সরকার চোখ বুজে থাকলে কী হবে গ্রামের মানুষ সাহায্য করেন। তাতেই কোনও মতে চলে যায় ওদের সংসার।

ভক্তি জেঠুর দারুণ ভক্ত এই ক্ষুদেরা। ওদের কথায় কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ছিল। ওরা বলছিল ওদের ভক্তিজেঠু নাকি নিজে না খেয়েও ওদের মুখে অন্ন যুগিয়ে যান। পড়াশোনার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। যার যখন যা প্রয়োজন দিয়ে যাচ্ছেন। শ্রাবণী নায়েক, গৌতম মাইতি, সুরঞ্জনা চক্রবর্তীরা দশ বছরে দেখে দেখে ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছে। ওদের সাফ কথা, জেঠুর ভার লাঘব করতে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত ছিল। ওরা জানে বেসরকারি সংস্থাগুলিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারত। সোজা সাপ্টা ভাষায় প্রশাসনকে আরও সহানুভূতিশীল হওয়ার পরামর্শ দিল ওই ছোট্ট আয়লা বিধ্বস্ত শিশুরা।

আর অন্যদিকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সন্তানসমদের প্রতিপালন করে চলেছেন ভক্তিবাবু। কিন্তু সেই লড়াইয়ের আঁচ এতটুকুও লাগতে দেননি ছেলেমেয়েদের গায়ে। ভক্তিজেঠুর আশ্রয়ে ওরা নিরাপদে দিন কাটাচ্ছে। আর অভিভাবক হিসেবে চিন্তার ভাঁজ আরও গাঢ় হচ্ছে ভক্তিপদর কপালে। চিন্তা একটাই সবাইকে পড়াশোনা শিখিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যোগ্য করে তুলতে পারবেন তো! সত্যিই জানেন না ভিক্ষাবৃত্তি করে ভ্যান চালিয়ে রিক্সা টেনে এই অসাধ্যসাধন করতে আদৌ পারবেন কিনা। সত্যিই ভক্তি জানেন না তার লড়াইয়ের কাহিনিটি আদৌ কেউ কখনও জানবেন কিনা! জানলে সরকারের কানে সেটা তুলবেন কিনা। ভক্তির অনেক সংশয়ের মধ্যে আরও একটি সেটি হল সত্যিই কি সরকারের কোনও কান থাকে! থাকলেও সরকার বাহাদুর ভক্তিপদদের কথা কি আদৌ শুনতে চাইবে!