অ্যাপসে সাধারণজ্ঞান, সাত সমুদ্রের পাড়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখে ইমরানের নাম

অ্যাপসে সাধারণজ্ঞান, সাত সমুদ্রের পাড়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখে ইমরানের নাম

Sunday November 22, 2015,

4 min Read

রাজস্থানের এক প্রত্যন্ত গ্রাম আলওয়ার। সেখানকারই বাসিন্দা ইমরান খান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দৌলতে ইমরানের নাম এখন লোকের মুখে মুখে, টিভিতে, সংবাদপত্রে চর্চার বিষয়। বলা হয়, লোকের আগে নাকি তার সুনাম ছোটে, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইমরানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। দেশের বাইরে তো দূর, রাজ্যের বাইরে কতটা যেতে পেরেছেন মনে করতে পারেন না আলওয়ারের বাসিন্দা, অথচ সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখে তাঁর নাম-কজনই বা ভাবতে পারেন!

image


প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন ভিড়ে ঠাসা ব্রিটেনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে গর্বে বুক ঠুকে বলছিলেন, ইমরান খানের মতো লোকের বাস তাঁর দেশে, আলওয়ারের খানেদের তখন ভিমড়ি খাওয়ার জোগাড়। সাংবাদিকরা দ্রুত গুগুল সার্চে ইমরানের নাম বসিয়ে খুঁজে দেখছিলেন কে তিনি? ইয়োরস্টোরিও আর দেরি করেনি। দ্রুত ইমেল পাঠিয়ে, পরদিন সকালে ফোন করে ইন্টারভিউর সময় চেয়ে নেয়। ‘দারুন অনুভূতি’, প্রধানমন্ত্রীর মুখে আদর্শ ভারতীয় হিসেবে নিজের নাম শুনে কেমন লেগেছিল, তার উত্তরে বলেন আলওয়ারের মাস্টারমশাই। ‘স্বপ্নেও আশা করিনি’, মুখে বিব্রত হাসি নিয়ে বলেন তিনি। ‘এই মুহূর্তে আমার বাড়ির সামনে মিডিয়া, সাংবাদিক, ওবি ভ্যানের লম্বা লাইন। বাবা-মা বুঝতে পারছেন না এইসব কী চলছে? ছেলে এমন কী করে ফেলল’? বলছিলেন ইমরান।

বছর চৌত্রিশের ইমরান আলওয়ারের গভর্নমেন্ট ইউপিএস কাঠুমার স্কুলের প্রাথমিকের শিক্ষক। ২০১২ সালে আলওয়ারের কালেক্টর আশুতোষ এ পাদনেকর ইমরানের তৈরি করা সাধারণজ্ঞানের ওয়েবসাইট দেখে উৎসাহিত হন। ‘অ্যাপ বানানোর আইডিয়াটা কালেক্টর সাহেবই দেন। অ্যাপ কী তখনও জানতাম না। আমার মোবাইলও ছিল সাধারণ। কালেক্টর নিজের স্মার্টফোনে কিছু অ্যাপ দেখান’, মনে পড়ে ইমরানের। এখান থেকেই সুখ্যাতির পথের যাত্রা শুরু।

বই পড়ে, অনলাইন সার্চ করে প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক ইমরান অ্যাপস নিয়ে বেশ খানিকটা পড়াশোনা করে নেন। ইমরানের ভাই ইদ্রিস আমাদের জানান, ‘আমার কম্পিউটার সায়েন্সের বইটা ঘেঁটে ফেলেছিল দাদা’। ২০১২ সালে NCERT এর জন্য সায়েন্স অ্যাপ বানিয়ে ফেলেন। তারপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘নানা বিষয়ে, যেমন-ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক, প্রাথমিকের বিজ্ঞান, মাধ্যমিক স্তরের বিজ্ঞান এবং যারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসছে তাদের জন্যও অ্যাপস বানাই’, বলেন ইমরান। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকে তার অ্যাপস নিয়ে আসার জন্য মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির আমন্ত্রণ পেয়েছেন। ‘আমর সব আ্যাপস দেশের জন্য দান করেছি’, গর্বের সঙ্গে বলেন প্রাথমিক শিক্ষক।

উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরই শিক্ষকতাকে পেশা হেসেবে বেছে নেন ইমরান। ‘আমার বাবা একজন কৃষক। তাই আমি অঙ্ক, বিজ্ঞানে ভালো হওয়া সত্বেও তার গুরুত্ব বুঝতে পারেননি বাবা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরকারি চাকরি ধরে নেওয়ার জন্য তাড়া দিতে থাকেন সবাই’, পুরনো কথা মনে করে বলেন ইমরান। আটকানো যায়নি মেধাবী ইমরানকে। পরে প্রাইভেটে ইংরেজি এবং অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর হন তিনি। রাজস্থানের সারিসকা ব্র্যাঘ্র প্রকল্পের সীমানায় খারেদা গ্রামে ছোটবেলা কেটেছে ইমরানের। একটু বড় হতেই বুঝতে পারেন এখানে থাকা যাবে না। কারণ, বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার কোনও সুযোগ নেই। ‘বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলাম। অঙ্ক, বিজ্ঞান আমার কাছে নেশার মতো ছিল। কিন্তু উৎসাহ বা ভরসা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। আমাদের দেশে চাকরি পাওয়াটাই যেন সবকিছু।চাকরি পেলেই সব নিশ্চিন্ত’, ক্ষেদোক্তি ইমরানের। ‘দাদা আমাদের বাড়ির আবদুল কালাম’, বলেন ইমরানের ২৫ বছরের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ভাই ইদ্রিস। জানান, তিনি আজ যা তার সবটাই দাদার জন্য সম্ভব হয়েছে। ‘তিনি আমার আদর্শ। আমরা সব ভাই বোনেরা চাই দাদার মতো পরিবার ও দেশের নাম উজ্জ্বল করতে’, বলেন গর্বিত ভাই ইদ্রিস। ৪ ভাই তিন বোনের মধ্যে ইমরান তৃতীয়।

গুগুল প্লে স্টোরে ‘gktalk_Imran’ নামের অধীনে ইমরানের ৫৩টি আ্যাপস রয়েছে। হিন্দিতে সাধারণজ্ঞানের অ্যাপ সবচেয়ে জনপ্রিয়। পাঁচ লাখের ওপর ডাউনলোড হয়েছে এই অ্যাপ। কাজ করার জন্য ইন্টারনেট সংযোগেরও দরকার নেই। আপাতত হিন্দিতে লাইফ সায়েন্স নিয়ে ৩০০টি প্রশ্ন রয়েছে। ইমরানের অ্যাপের ব্যবহার নিয়ে প্লে-স্টোর বলেছে, ‘এই অ্যপ্লিকেশন বেসিক সায়েন্স সহজে বুঝতে সাহায্য করবে। এটা ছাত্রছাত্রীদের যেমন কাজে লাগবে, তেমনি আইবিপিএস, আইএএস, স্টেট পিএসসি, এসএসসি এবং অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষাতেও সাহায্য করবে’। এক লাখেরও বেশি ডাউনলোড নিয়ে ইমরানের অন্যান্য জনপ্রিয় অ্যাপসগুলি হল-ইতিহাস সাধারণজ্ঞান, হিন্দি ব্যাকরণ, হিন্দিতে ভূগোলের সাধারণজ্ঞান, ভারতীয় রাজনীতির সাধারণজ্ঞান এবং তাঁর প্রথম অ্যাপ ‘NCERT Science in Hindi’, যেটা ২০১২ সালে লঞ্চ করেন তিনি। এই অ্যাপসগুলি ছাড়াও পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, সৌরশক্তি, রচনা লিখন, কম্পিউটার ফান্ডামেন্টালস, মানবশরীর, মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে ইমরানের আরও কিছু অ্যাপস রয়েছে।বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই যুবকের উপদেশ, যুবসমাজকে ধৈর্য্যশীল হওয়ার শিক্ষা নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘যা নিয়ে তোমার উৎসাহ, সততার সঙ্গে তাকে অনুসরণ কর। যদি তাৎক্ষণিক ফল না আসে তবুও। একদিন জয় হবেই’।

লেখক-দীপ্তি নায়ার

অনুবাদ-তিয়াসা বিশ্বাস