ভেঙে পড়ল সেতু, কান্নায় ভেঙে পড়ল কলকাতা

ভেঙে পড়ল সেতু, কান্নায় ভেঙে পড়ল কলকাতা

Thursday March 31, 2016,

5 min Read

image


গণেশ টকিজের সংলগ্ন এলাকা রবীন্দ্রসরণী অন্যান্য দিনের মতো বৃহস্পতিবার সকালেও ছিল ব্যস্ত। কাজের দিনের ভিড়। কর্মব্যস্ত এলাকায় নির্মীয়মাণ বিবেকানন্দ সেতু হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল বহু পথচারীর চোখের সামনে। যানবাহন আর বহু মানুষ চাপা পড়লেন সেতুর ধ্বংসাবশেষের নীচে। দুর্ঘটনা বলে কয়ে আসে না। কিন্তু এমন যে হতে পারে দূরদূরান্ত পর্যন্ত ভাবেনি এই শহর। বেলা ১২ টা নাগাদ দুর্ঘটনাটি ঘটে। স্থানীয় মানুষই প্রাথমিকভাবে উদ্ধারের কাজে হাত লাগায়। সব মিডিয়ার মত আমরাও ছুটে যাই। সাংবাদিকদের যা কাজ তাই করছিলাম আমরা, পাশাপাশি উদ্ধারের কাজেও লেগে পড়েছিলাম। ফেসবুক স্যোশাল মিডিয়ায় আমরা প্রচার করছিলাম হেল্পলাইন নম্বর। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোথায় কোথায় পাওয়া যেতে পারে অ্যাম্বুলেন্স। রক্তের প্রয়োজন, কার কোন গ্রুপের রক্ত দরকার সেসব তথ্য। 

দুর্ঘটনা যা ঘটার তাতো ঘটেই গিয়েছে কিন্তু যারা আহত হয়েছেন তাঁদের উদ্ধারের কাজটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। চিরকালই কলকাতা মানবিকতার ইন্ডেক্সে এগিয়ে। আজও সেই দৃশ্যই চোখে পড়ল। ধর্ম বর্ণ রাজনৈতিক রং নির্বিশেষে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উদ্ধার কাজে। ওই ভিড়ের ভিতর থেকে দু'জন তরুণ স্টার্টআপ আন্ত্রেপ্রেনিওরের সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল। যাঁরা এসেছিলেন টিভির পর্দায় এই বিভৎস দৃশ্য দেখে। কিভাবে উপকারে আসা যায় সে কথাই মাথায় ঘুরছিল ওদের। আমার সঙ্গে দেখা হতেই এগিয়ে এলেন। এরই মধ্যে খবর পেলাম ওলা ক্যাব কর্তৃপক্ষও যুদ্ধ কালীন তৎপরতায় এগিয়ে এসেছে ওই অঞ্চলে ক্যাবের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। সস্তা ভাড়ায় আটকে পড়া জনতাকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে। মনে পড়ে গেল চেন্নাই বন্যার মত দুর্যোগের সময় এই সব স্টার্টআপরাই এগিয়ে এসেছিল। বিপন্ন কলকাতাতেও একই স্পিরিট দেখলাম। এরই মধ্যে সেনাবাহিনি এলাকা কর্ডন করে দিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমকে সরিয়ে দিচ্ছে। আমাকেও পিছু হটতে হল। কিন্তু টিম ইওরস্টোরি বাংলা পিছু হটার পাত্র নয়। ইতিমধ্যে আমাদের প্রতিনিধিরা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করার কাজে লেগে পড়েছেন। ওরা তখন শুধু সাংবাদিক নয় বরং স্বেচ্ছাসেবী।

দুর্ঘটনার কিছু পরে খড়গপুরের নির্বাচনী জনসভা বাতিল করে কলকাতায় ফিরে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ঘটনাস্থলে উদ্ধারের কাজের তদারকি করছেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রয়েছেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব ও মুখ্য সচিব। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুভার্গ্যজনক এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্দেশে শোকপ্রকাশ করেছেন। কেন্ন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সের বা এনডিআরএফ-এর ডিরেক্টর জেনারেলকে উদ্ধারের কাজে যাবতীয় সহযোগিতার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন। সেই মতো এনডিআরএফ উদ্ধারের কাজে হাত লাগিয়েছে। এছাড়া, উদ্ধারের কাজে হাত লাগিয়েছেন অন্ততপক্ষে ‌৪০০জন সেনা। রয়েছেন দমকল কর্মীরাও।

দক্ষিণ ভারতের একটি সংস্থার হাতে বিবেকানন্দ সেতু নির্মাণের দায়িত্ব ছিল। দুর্ঘটনার পরে ওই সংস্থার কর্তারা কার্যত দায় এড়িয়ে গিয়েছেন। আইভিআরসিএল নামে ওই সংস্থার এক কর্তা সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, সেতুর ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। এরপরে এই দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটল, তা তাঁদের কাছেও একটি প্রশ্ন। সংস্থা তরফে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। এরপরেই সংস্থার কলকাতার অফিসটি তালাবন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হায়দরাবাদ অফিসেও সংস্থার কোনও কর্মকর্তার হদিশ মিলছে না বলে সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে নাতো?

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মৃতদের পরিবারের জন্যে ইতিমধ্যেই ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছেন। জখমদের রাজ্য সরকারের তরফে ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

যা শুনলাম যা দেখলাম

ঘটনাস্থল পোস্তার কাছে। এটি কলকাতা শহরের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যিক এলাকা। কাছেই বড়বাজার। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, কাল রাতেও সেতুর ঢালাইয়ের কাজ হয়েছে। স্থানীয় এক যুবক বললেন, সকালে হঠাৎ শুনতে পেলাম বিকট আওয়াজ। তখন বারোটা বেজে গিয়েছে। সেতুর আশপাশে কর্মব্যস্ত মানুষজন আর যানবাহন। ঘরের জানলা দিয়েই দেখতে পেলাম সেতুটা ভেঙে পড়ল। আশেপাশের মানুষ, যাত্রীবোঝাই বাস, ট্যাক্সি সেতুর লোহার বিম আর ধ্বংসাবশেষের নীচে নিমেষে চাপা পড়ে গেল।

প্রাথমিক হতচকিত অবস্থা কাটিয়ে স্থানীয় যুবকরাই উদ্ধারের কাজে হাত লাগান। অথচ, ওই ভারি লোহার বিম সরানো মানুষের সাধ্য নয়। দরকার শক্তিশালী ক্রেন। সেই ‌ক্রেন আসতেও এদিন বেশ কিছুটা দেরি হয়েছে।

এদিকে কোথাও কোথাও ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বের করে আনা হচ্ছে রক্তাক্ত দেহ। অ্যাম্বুল্যান্স ছুটছে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দিকে। বেলা তিনটে নাগাদ জানা গিয়েছে, অন্ততপক্ষে ১৫জন মারা গিয়েছেন। সন্ধ্যার কিছু আগেও ক্রেন দিয়ে লোহার বিম তোলার কাজটায় সফল হওয়া গেল না। দুএকটি ক্রেনকে ভারি লোহার বিমগুলি সরানোর কাজে লাগানো গেলেও বাকিগুলি দিয়ে ওই কাজ করা সম্ভব নয় বলে প্রশাসনের একাংশ জানিয়েছেন।

উদ্ধারের কাজের জন্যে তাই ব্যবহার করা হচ্ছে গ্যাসকাটার। একটি শক্তিশালী ক্রেন দিয়ে ওই কাজটা করানো সম্ভব হলেও শেষমুহুর্তে সেটি বিকল হয়ে পড়েছে।

ফলে, এক নারকীয় পরিস্থিতি। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে একের এক এক অ্যাম্বুল্যান্স সার দিয়ে ঢুকছে। আহতদের পরিজনরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উৎকণ্ঠিতভাবে প্রতীক্ষা করছেন।

কেউ কেউ স্বজনের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া মারোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটির হাসপাতাল এবং আরজিকর হাসপাতালে জখম ও গুরুতর জখমদের চিকিৎসা চলছে। সেখানেও ওই একই ছবি।

স্থানীয় মানুষজন উদ্ধারের কাজে প্রাথমিকভাবে হাত লাগিয়েছিলেন। কোথাও ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে রক্তাক্ত হাত সাহায্যের প্রত্যাশায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। স্থানীয়রা তাঁদের সর্বতোভাবে সহায়তা করার চেষ্টা চালিয়েছে। পরে সেনা, দমকল ও এনডিআরএফ এই কাজে হাত লাগায়।

বিপদ যাতে আর না ছড়ায় এজন্যে নির্মীয়মাণ বিবেকানন্দ সেতুর আশপাশের এলাকার বাড়িগুলি থেকে বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বুধবার গভীর রাত পর্যন্ত সেতুর ঢালাইয়ের কাজ হয়েছে। সেই সময় বিপদের কোনও আশঙ্কা করেননি কেউই।

সকালে এই দুর্ঘটনার পরে এলাকাটি শ্মশানে পরিণত হয়েছে। বাড়ি থেকে সুস্থ, স্বাভাবিকভাবে কাজে বেরনো মানুষজনের মধ্যে অনেকেই এক-একটি লাশে পরিণত হয়েছেন। অথবা, গুরুতর আহত হয়েছেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং টুইট করে এই দুভার্গ্যজনক ঘটনার জেরে যে সমস্ত মানুষ স্বজন হারিয়েছেন, তাঁদের পরিবারের উদ্দেশে সমবেদনা জানিয়েছেন।

image


এই দুর্ঘটনার সাথে জড়িয়ে ছিল অন্যরকম একটা বিবমিষাও 

রাজ্যপাল এসেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী এসেছিলেন, বিরোধীরা এসেছিলেন, আর ছিল ভোটের আগে রাজনীতির ভরপুর সুযোগ। কিন্তু এত মানুষের মৃত্যু গোটা কলকাতাকে বিমোহিত করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। টিভির পর্দায় থেঁতলে যাওয়া মৃতদেহ দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে মানুষ। কান্নায় ভেঙে পড়েছে কলকাতা। মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসেবে ততক্ষণে ১৪ ছাড়িয়ে গিয়েছে। আহতের সংখ্যা অন্ততপক্ষে ৭৮। পরিসংখ্যান গুলো এমন ভাবে ফুটে উঠছে। যে আর মানুষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত শব্দগুলো নিতে পারছে না। রাজনীতিবিদদের সাজানো শব্দগুলো স্টিরিওটাইপ লাগতে শুরু করেছে কলকাতার। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার হুঙ্কার শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। ফোনে ফেসবুকের হুঙ্কারের নোটিফিকেশন ঢুকছে। মৃত্যুর কারণ নিয়ে নয়, দুর্ঘটনা নিয়ে নয়, বরং টিকা টিপ্পনি নিয়ে। আমার ফোনের ব্যাটারি ফুরিয়ে এসেছে। পাওয়ার ব্যাঙ্কেও চার্জ নেই। ভেঙে পড়া সেতুর ধ্বংসাবশেষের নীচে কত মানুষ শীতল মৃত্যুর দেশে চলে গিয়েছে কারও কাছে ঠিক তথ্য নেই। তবে দুর্ঘটনার পরের আকস্মিক বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে স্থানীয় মানুষজনের ক্ষোভ কয়েকটি প্রশ্নে‌র সদুত্তর চায় কলকাতা পুরসভা তথা প্রশাসনের কাছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কলকাতা পুরসভার মেয়র ও স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছে শোকার্ত প্রিয়জনহারারা এই প্রশ্নের সদুত্তর পাননি এখনও। অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশ মনে করেন, যে সমস্ত কার‌ণগুলির জন্যে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তার ভিতর অন্যতম হল সেতুর নকশায় ক্রুটি।পুঞ্জীভূত হচ্ছে ক্ষোভ। তারই ভিতর চলছে উদ্ধারের কাজ। আর মধ্যেমধ্যে ধ্বংসস্তূপের ভিতর মিলছে মানুষের প্রাণের স্পন্দন।