দুবাইয়ের চাকরি ছেড়ে উদ্যোগপতি উত্তরপাড়ার প্রদ্যুৎ

দুবাইয়ের চাকরি ছেড়ে উদ্যোগপতি উত্তরপাড়ার প্রদ্যুৎ

Saturday June 04, 2016,

5 min Read

বাবা একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ছিলেন। ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে প্রয়াত হন। অবসরের অনেক আগেই...। বাবা যখন মারা যান তখন প্রদ্যুতের বয়স সবে আঠেরো। মাত্র উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছেন। চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে অতলান্ত অন্ধকার। কী করবেন... কীভাবে চালিয়ে নিয়ে যাবেন এই সংসার তা নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তা। অনেক অনিশ্চয়তা। তার মধ্যে থেকেই একটা পথ বেরল। বাবার ব্যাঙ্কেই করণিকের কাজ পেলেন। কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ড।

কিন্তু প্রদ্যুতের স্বপ্ন ছিল অন্যরকম। জীবনের কাছে প্রতিশ্রুতিও ছিল অন্য। এগোবেন... এবং আকাশ ছোঁবেন... নিজের হিম্মতে। কোনও কমপ্যাশন বয়ে বেড়াবেন না। কেউ আহা... উঁহু করুক এটা তাঁর কখনওই পছন্দের তালিকায় ছিল না। মমতা, মায়া এসব থাকুক অন্য জায়গায়, নিজের মেরুদণ্ডে ভর দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলেন বাবা, আর বাবার মৃত্যুজনিত মায়া-মাখা চাকরি তাই ধাতে সইল না। আদ্যোপান্ত পেশাদার প্রদ্যুৎ ব্যানার্জি কিছু দিন পর চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। সবাই রে রে করে উঠেছিল। 'পাগল নাকি! ব্যাঙ্কের চাকরি কেউ ছাড়ে! মাথা খারাপ আছে!!! কেউ এটা করে!' এভাবেই অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন সেদিন। কিন্তু সে অনেক দিন আগের কথা। তারপর দুবাই গেছেন। বিভিন্ন সংস্থায় মোটা বেতনের চাকরি করেছেন। কোম্পানি সেক্রেটারি হিসেবে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করেছেন। আবার সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে খুলেছেন নিজের ফার্ম। যেন মারের সাগর পারি দেবেন ভীষণ ঝড়ের বায়ে...

উত্তরপাড়ার প্রদ্যুৎকে এখন তাই সবাই একডাকে চেনে। উদ্যোগপতি হিসেবে। আইনজীবী এবং স্বনির্ভরতার প্রতীক হিসেবে। আজ আমরা ওর লড়াইয়ের গল্প শুনব।

১৯৭৭-এ জন্ম। ১৯৯৫ সাল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন। বাবা মারা গেলেন। ১৮ বছরের ছেলেটা অথৈ পাথারে পড়ল। চাকরি পেল ঠিকই কিন্তু সেটা মনের মতো কিছু নয়। ব্যাঙ্কের কেরানির চাকরি করতে করতেই চালিয়ে গেলেন পড়াশুনো। বি.কম পাশ করলেন। তারপর কোম্পানি সেক্রেটারি-শিপ নিয়ে পড়লেন। এলএলবি, এলএলএম করলেন। চাকরি করতে করতেই উতরে গেলেন একের পর এক হার্ডেল। ২০০৪ সালে বিয়ে করলেন প্রদ্যুৎ। সে বছরই ছাড়লেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চাকরি। কোম্পানি সেক্রেটারি হিসেবে এবং আইনি পরামর্শদাতা হিসেবে বিভিন্ন কর্পোরেট হাউসে কাজ করা শুরু করলেন। টানা চার বছর এই কাজ করার পর তিনি চাকরি পেলেন দুবাইয়ের একটি কর্পোরেট হাউসে। ২০০৮ সাল। চলে গেলেন দুবাই। কিন্তু মন টিকল না। কলকাতায় ফিরে আসার জন্যে মন ছটফট করতে থাকল। ২০১০ এ ফিরে এলেন। আবারও বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন বলতে থাকল, মাথাটা একেবারেই গেছে! কেউ ফিরে আসে!

জীবনে যতবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সদর্পে মনের ডাকে সাড়া দিয়েছেন প্রদ্যুৎ। কখনও ঝুঁকি নিতে পিছপা হননি। কখনও নঞর্থক চিন্তা তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। তিনি এগিয়েছেন স্বপ্নের পথে। স্বপ্নই তাঁকে নির্মাণ করেছে।

কলকাতায় ফিরে এসে একজন আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিস শুরু করার কথাই তিনি ভেবেছিলেন। এতদিন কর্পোরেট দুনিয়ায় কাজ করে এসেছেন। ফলে কর্পোরেট দুনিয়ার আইনি মারপ্যাঁচে তিনি দারুণ দক্ষ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইন থেকে শুরু করে দেশের বাণিজ্য আইন তাঁর নখদর্পণে। একজন উদ্যোগপতি হতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই উদ্যোগই তাঁকে সব থেকে বেশি টানে। তাই ২০১০ এ যখন দেশে ফিরলেন তখন তাঁর দরজার বাইরে মোটা বেতনের চাকরি সার দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ওই যে বললাম প্রদ্যুৎ স্বপ্নের দিকে যাচ্ছে যে রাস্তা সেই রাস্তাই বেশি পছন্দ করেন। তাই সব চাকরির ভাবনা নাকচ করে শুরু করলেন তাঁর আইনজীবীর পেশা। পাশে পেলেন স্ত্রীকে। পরিবার ছাড়া তাঁর পরিচিত বৃত্তের প্রত্যেকটি মানুষ খ্যাপাই ভেবেছিল। একা হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল প্রদ্যুৎ ধীরে ধীরে একা একাই খুলে ফেললেন তাঁর ল ফার্ম। এই পাঁচ ছ বছরে। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন। এখন তাঁর ল-ফার্মে যুক্ত গোটা চারেক অ্যাডভোকেট। কাজ করেন আরও জনা তিনেক মানুষ। বলছিলেন, শুরুটা খুবই কঠিন ছিল। এক তো স্বপ্নের কথা কান পেতে শুনতে গেলে পকেটে টান পড়ে। পড়েও ছিল। প্রথম দিকে পরিবারের লোকজনেরা দারুণ সাহায্য করেছেন। সবসময় পাশে থেকেছেন। সাহস কমতে দেননি। আর ঝুঁকি নেওয়ার হিম্মত দিয়েছেন। তারপর তাঁর নিজের আত্মবিশ্বাস দেখে এগিয়ে এসেছেন বন্ধুরাও। ক্লায়েন্টের খোঁজ খবর দিয়ে সাহায্য করেছেন প্রচুর। আর নিজের সততা, দক্ষতা আর লক্ষ্যে অবিচল থাকার অদম্য উৎসাহে ভর করেই এগিয়েছে প্রদ্যুতের বাণিজ্য তরণী। যত কাজ পেয়েছেন তত অভিজ্ঞতা বেড়েছে। তত বেড়েছে আত্মবিশ্বাস। এবং ধীরে ধীরে ল ফার্ম তৈরি করার দিকে এগিয়েছেন। এমন একটা ফার্ম যেখানে আইনি যেকোনও সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। ফলে শুধু বাণিজ্য নয়, পাশাপাশি ফৌজদারি এবং দেওয়ানি জটিলতাও সামাল দেওয়ার জন্যে তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এভাবেই তৈরি হয়ে যায় ব্যানার্জি ল চেম্বার্স। ২০১৩ থেকে দেখতে দেখতে তিনটে বছর দুর্দান্ত দৌড়চ্ছে তাঁর ল চেম্বার্স। এখন সেখানে পাবেন, সিভিল, ক্রিমিনাল, কর্পোরেট সব ধরণের দক্ষ আইনজীবী। শুধু তাই নয় এই ল চেম্বার্সের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস এবং কোম্পানি সেক্রেটারিরাও। ফলে এই চেম্বার্সে গেলে এক দরজায় প্রায় সমস্ত রকম আইনি এবং বাণিজ্যিক জটিলতার সমাধান দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন প্রদ্যুৎ।

বলছিলেন, অধিকাংশ সময়ই আদালতের আইনি ঝুট-ঝামেলা এড়িয়ে সমাধান দেওয়ার ব্যবস্থাই করেন ওঁরা। ক্লায়েন্টকে সত্যিকার সমাধানের রাস্তা বাতলে দেন। প্রয়োজনীয় স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে দেন। আইনের সমস্যায় যাতে কখনও পড়তে না হয় সেই মন্ত্রই দেন ক্লায়েন্টদের। ব্যবসায়িক সংস্থার জন্যে রয়েছে নানান প্যাকেজ। আইনি সমস্যা এড়ানোর নানান রক্ষাকবচ। এবং গোটাটাই সহজ সরল ভাবে কিভাবে করা যেতে পারে তাই ই বাতলে দেন প্রদ্যুৎ। এবার তাঁদের ফার্মের নতুন সংযোজন হতে চলেছে জনস্বার্থ মামলার আইনি সহায়তা কেন্দ্র।

প্রদ্যুৎ আরও স্বপ্ন দেখছেন, তাঁর এই ল-ফার্মকে আরও বড় করে তুলতে চান তিনি। খুলতে চান বেশ কয়েকটি শাখাও। ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক বেড়া টপকে পৌঁছে যেতে চান পৃথিবীর অন্য-প্রান্তে। ইতিমধ্যে উত্তরপাড়া থেকেই দুবাই, মরিশাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের জটিল আইনি সমস্যার সুরাহা করে দিয়েছেন ওঁরা। এবার নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডের মত দেশগুলোতেও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা তৈরি করতে চাইছেন প্রদ্যুৎ।

এত যে বিস্তার, এত যে ছড়িয়ে পড়তে চাওয়া... কখনও ক্লায়েন্টদের সামাল দিতে অসুবিধে হতে পারে কিনা প্রশ্ন করায় চটজলদি উত্তর তৈরি। বলছেন, “We treat every client as our only client.”