জঙ্গলে যখের ধনের প্রহরী 'মিঠুদি'

আজ আপনাদের সঙ্গে মিঠুদির আলাপ করিয়ে দেব। আপনার পরিচিত কিনা জানি না কিন্তু এই মিঠু দি, প্রত্নতাত্বিক সংরক্ষণের বেনজির দৃষ্টান্ত। প্রাণ দিয়ে আগলে রেখেছেন পুরুলিয়ার মন্দির নগরীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রত্ন সামগ্রী।

জঙ্গলে যখের ধনের প্রহরী 'মিঠুদি'

Thursday March 24, 2016,

3 min Read

পুরুলিয়া শহর থেকে সাতাশ কিলোমিটার দূরে কংসাবতীর দুই পাড়ে করম-কুসুম-পলাশ-অর্জুন-শিমুলের ঘন জঙ্গল। আর সে জঙ্গলের গভীরে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অন্তত হাজার বছরের পুরনো দুর্মূল্য সব প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন। এককালে এখানে অনেক দেউল ছিল। তবে এখন দাঁড়িয়ে আছে শুধু দুটি। কিছুদিন আগেও দেউল ছিল তিনটি। ২০০২ সালে ভেঙে পড়ে সবথেকে বড় দেউলটি। দেউল থেকেই এলাকার নাম দেউলঘাটা। দেউলের অনন্য স্থাপত্যের পাশাপাশি এখানে রয়েছে একাধিক অনুপম বিগ্রহ। কখনও সময়ের নিয়মে, কখনও হানাদারদের আক্রমণে অনেক বিগ্রহই টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। তবে এখনও ধ্বংস হয়নি সবকিছু। আর যা বেঁচে আছে, তাকেই সযত্নে সামলাচ্ছেন মিঠুদি। একা, গভীর জঙ্গলের মধ্যে।

image


প্রত্নতাত্ত্বিক মূর্তি পাচারের রাজধানীর নাম সংশয়াতীত ভাবেই ভারতবর্ষ। জাতীয় মিউজিয়াম থেকেও এদেশে চুরি হয়ে যায় দুমূর্ল্য বৌদ্ধমূর্তি। সেখানে জঙ্গলের মধ্যে এই প্রত্নতাত্ত্বিক সাম্রাজ্য পাহাড়া দিচ্ছেন একা মিঠুদি। এ এক অনন্য নজির। এই মডেলে বিগ্রহকে মিউজিয়ামের ঠাণ্ডাঘরে বন্দি থেকে চুরি যাওয়ার আশঙ্কায় থাকতে হয় না। এখানে বিগ্রহ আছে খোলা আকাশের নিচে। পলাশ আর শিমুল রোজ ঝরে পড়ে তাঁদের মাথায়, পিঠে, বুকে, পায়ের কাছে।

১৯৭৮ সাল। বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ঘর ছেড়েছিল মিঠু নামের মেয়েটি। ধর্মকর্মে উৎসাহের পাশাপাশি প্রচলিত রাস্তায় না হাঁটার প্রবল ইচ্ছে তাঁকে নিয়ে আসে দেউলঘাটায়। প্রথম দর্শনেই প্রেম। তারপর অবশ্য এ তল্লাটে কাটিয়ে দিয়েছেন প্রায় চল্লিশ বছর। আস্তে আস্তে সমস্ত বিগ্রহগুলিকে ধ্বংসস্তুপ থেকে তুলে এনে একজায়গায় রাখতে শুরু করেন একাই। স্থানীয় এক সাধু তাঁকে শুরুতে সাহায্য করলেও পরে সব একার হাতেই। চোর-ডাকাতের হুমকি, মূর্তি পাচারকারীদের প্রলোভন কোনও কিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি। তবে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে গিয়েছিলেন জঙ্গলের আদিবাসী মানুষদের। তাঁদের জন্যই হোমিওপ্যাথি শিখে শুরু করেছিলেন ফ্রি মেডিক্যাল প্র্যাকটিস। বিপদে আপদে এই মানুষরাই মিঠুদির সবথেকে বড় সহায়। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অফিসারেরা এসেছিল একবার। কোমরে হাত দিয়ে এ মূর্তি সে মূর্তি দেখে তুলে নিয়ে যাবে সব ঠিক। কিন্তু সেগুড়ে বালি দিয়েছেন মিঠুদি। তাঁর দাবি গ্রামের মানুষের সম্পদ গ্রামেই থাকবে। স্থানীয় মানুষও কাছছাড়া করতে চায়নি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই মূর্তিগুলিকে। তাই কোনওরকম সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই পুরাতাত্বিক নিদর্শন এখানে সুরক্ষিত। দেবতারাও আছেন তাঁদের বাস্তুভিটেতেই। একদিনের জন্যও উদ্বাস্তু না হয়ে।

শুরুর কয়েকবছর একা থাকতে ভয় করলেই বাঁকুড়ায় বাড়ি চলে যেতেন। তখন মনে হত মূর্তির দেখভাল কে করবে! সেই চিন্তাতে দু-একদিনের মধ্যেই ফিরে আসতেন দেউলঘাটায়। এখন অবশ্য মন্দির চত্বরেই একটি ছোট আশ্রম করে ফেলেছেন এই অসীম সাহসী দৃঢ়চেতা ভদ্রমহিলা। আরও একটি পরিচয় আছে বৈকি! তাঁর অনাড়ম্বর আতিথেয়তার কথা মুখে মুখে ঘোরে। হিসেব দেখে বলছিলেন, শুধুমাত্র ২০১৫ সালে এই ছোট্ট আশ্রমে নিশিযাপন করেছেন প্রায় পাঁচ হাজার পর্যটক, ভক্ত, দর্শনার্থী।

আমাদের দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক গৌরব বোধহয় বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। সেই সম্পদ সযত্নে সুরক্ষিত রাখার মত জাদুঘর ভূ-ভারতে নেই। মিঠুদির এই মডেল তাই স্বাভাবিকভাবেই দিচ্ছে এক অনন্য পথের খোঁজ।

image


Related Story

1. আয়ুবস্যারের সংগ্রহে সমৃদ্ধ প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা

2. পুরুলিয়ার ‘মন্দিরনগরী’ কেন ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন নয় !

3. গণিত শিক্ষকের ইতিহাস চর্চা

4. ভারতকে চিনতে চিনতেই রাজীবের মুদ্রা ভাণ্ডার