শিল্পীদের জীবিকা সংস্থানে বাঁকুড়ার মিহারু

শিল্পীদের জীবিকা সংস্থানে বাঁকুড়ার মিহারু

Sunday January 03, 2016,

3 min Read

বাঁকুড়ার প্রাচীন শিল্প ডোকরা ও বালুচরি নিয়ে কাজ করে মিহারু। প্রাচীন শিল্পমাধ্যমকে ব্যবহার করে শিল্পীদের নানা আধুনিক জিনিস বানানোতে উৎসাহিত করেন তাঁরা, যোগাযোগ করিয়ে দেন ক্রেতাদের সঙ্গে। আসুন আলাপ করি মিহারুর প্রতিষ্ঠাত্রী পারুল বাজোরিয়ার সঙ্গে। পারুলের পড়াশোনা ফ্যাশন ডিজানিং নিয়ে। বিয়ের পর বাঁকুড়ায় থাকতে শুরু করেন পারুল।

image


হস্তশিল্পজাত দ্রব্য ও হ্যান্ডলুম কাপড়ে সমৃদ্ধ এই জেলায় থাকার সময়ই এই গ্রামীণ শিল্পীদের জন্য কিছু করার ইচ্ছে জোরদার হয়। নিজে ডিজাইনার হওয়ায় তাঁর পক্ষে কাজটা সহজ সেটাও উপলব্ধি করেন, কিন্তু সংসারের কাজের ব্যস্ততায় করে ওঠা হয় না। অবশেষে বছর তিনেক আগে মেয়েরা বড় হওয়ার পর নিজের এই সামাজিক উদ্যোগ সংস্থা তৈরি করেন পারুল।

“হস্তশিল্প আমাদের সম্পদ, সারা পৃথিবীতে কদর রয়েছে এই সব জিনিসের অথচ যারা এগুলো বানাচ্ছেন তাঁদের অবস্থা দেখুন, কী দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটান অধিকাংশ। নতুন প্রজন্ম ক্রমেই উত্সাহ হারাচ্ছে, শিল্পকে বাঁচাতে হলে বাঁচাতে হবে শিল্পীদের, সেই ভাবনার থেকেই শুরু মিহারু”, বললেন পারুল।

পারুল জানালেন, “একদিকে শিল্পীদের অবস্থা দেখতাম, অন্যদিকে দেখতাম আত্মীয় বন্ধুদের হস্তশিল্পজাত দ্রব্য নিয়ে উত্সাহ, তাঁরা এগুলি ব্যবহার করতে চান, কিন্তু সঠিক জিনিস পাননা। আমি নিজে একজন ডিজাইনার, আমার মনে হল আমি এই সেতু বন্ধনের কাজটা করতে পারি”।

আধুনিক ক্রেতার পছন্দ ও প্রয়োজন মতো জিনিস তৈরি করা ও তাঁদের কাছে তা পৌঁছে দেওয়াই উদ্দেশ্য মিহারুর।

“শুধুমাত্র ঘর সাজানোর জিনিস বা শখের জিনিস নয় আমরা চেষ্টা করি এমন জিনিস তৈরি করতে যা মানুষের কাজে লাগে, তাহলেই মানুষ আরো বেশি উত্সাহিত হবেন এগুলি কিনতে”, বললেন পারুল।

পণ্যে আধুনিকতা ও অভিনবত্বের ছোঁয়া আনতে নিয়মিত কাজ করে মিহারু, পারুল নিজে বর্তমানে দুর্গাপুরের বাসিন্দা কিন্তু শিল্পীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে কাজ করেন তিনি, পেয়েছেন FOSMI আউটস্ট্যান্ডিং উইমেন অ্যান্ত্রপ্রনয়্যারশিপ অ্যাওয়ার্ড।

“আমি সব সময়ই এমন কিছু একটা করতে চাইতাম যা মানুষের কাজে লাগে ও আমারও করতে ভাল লাগে, এটাই ছিল সবথেকে উপযুক্ত। আমার শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করতে, নতুন ডিজাইনের জিনিস বানাতে ভাল লাগত, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমি বুঝতে পারি প্রথমে আমাকে সঠিক বাজার বেছে নিতে হবে, তারপর সেই বাজারের উপযুক্ত পণ্য বানাতে হবে। শুরুর দিকে শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা হয়েছে, সময়ে অর্ডার সরবরাহ করতে পারিনি, কিন্তু ধীরে ধীরে বিষয়গুলি বুঝেছি”, বলছিলেন পারুল।

নিজেদের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক, ট্যুইটার ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যেই দেশ ও বিদেশের ক্রেতাদের কাছে পৌঁছয় মিহারু। এছাড়াও কাজ করতেই করতেই তৈরি হয় নতুন যোগাযোগ। ফ্যবইন্ডিয়া সহ বিভিন্ন লাইফস্টাইল স্টোর ও অনলাইন স্টোরের মাধ্যমে শহরের সচেতন মানুষের কাছে হস্তশিল্পজাত দ্রব্য ও তাদের গল্পগুলিকে পৌঁছিয়ে দেয় মিহারু।

ভুলে গেলে চলবে না হস্তশিল্পের বিরাট সম্ভার এই ভারত। বিভিন্ন এলাকার মানুষের নিজস্ব শিল্প রয়েছে, যা তাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বানিয়ে আসছেন। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে এর প্রতিটিরই উৎপত্তি হয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের জন্য নয়তো দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য। হাতের কাছে পাওয়া উপাদান দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস বানিয়েছে মানুষ, পরবর্তী প্রজন্ম শিখে নিয়েছে উৎপাদন কৌশল। কিন্তু সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে প্রয়োজন, এসেছে নতুন সামগ্রী আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শতাব্দী প্রাচীন এই সব জিনিস হয়ে উঠেছে নেহাতই শৌখিন, নান্দনিক। সেই বাজারেও পরিবর্তন ঘটে চলেছে দ্রুত, শুধুমাত্র নিজেদের এলাকা নয় প্রয়োজন হয়েছে বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়ার। কিন্তু শিল্পীরা মূলত গ্রামীণ এলাকার সাধারণ মানুষ হওয়ায় বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার দৌড়ে প্রায়শই পিছিয়ে পড়েন। যোগাযোগ তৈরি করে উঠতে পারেন না বাইরের বাজারে, দরকার মতো পরিবর্তন আনতে পারেন না নিজেদের উৎপাদনে। এখান থেকে তৈরি হয় একদল মধ্যস্বত্ত্বভোগীর, লাভের গুড় খেয়ে যান তাঁরাই। ধুঁকতে থাকেন শিল্পী। শিল্প ও শিল্পীর উন্নতি নয়, নিজেদের পকেট ভরানোই একমাত্র উদ্দেশ্য এই শ্রেণির। হস্তশিল্প কেন্দ্রের এই অবস্থার পরিবর্তনে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে নানা ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা চলছে।

কিন্তু মিহারু এর ব্যতিক্রম। শিল্পীদের বাজারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করিয়ে দিতে, তাঁদের বাজারের জন্য প্রস্তুত করে দিতে উদ্যোগী হয়েছে এই সংস্থা।

পারুল বাজোরিয়ার লক্ষ্য শুধু বিক্রি নয় সচেতনতা গড়াও। হস্তশিল্পজাত দ্রব্য তো শুধু কতগুলি ব্যবহার্য জিনিস নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্য, ইতিহাস, প্রতিভা ও শ্রম। এই সবকিছু মিলেই তৈরি হয় একেকটা জিনিস, আর এই শিল্পী গোষ্ঠীদের বাঁচিয়ে রাখাটা তাঁর কর্তব্য বলে মনে করেন।