যেন হাজার বছর ধরেই হাঁটবেন কলকাতার স্ট্রিট ফটোগ্রাফাররা

যেন হাজার বছর ধরেই হাঁটবেন কলকাতার স্ট্রিট ফটোগ্রাফাররা

Monday March 07, 2016,

3 min Read

স্ট্রিটস অব ক্যালকাটা। একটি ফটোগ্রাফি সংস্থা। শীতগ্রীষ্মবসন্ত স্ট্রিটস অব ক্যালকাটার সদস্যরা কলকাতার আনাচ-কানাচে লুকিয়ে থাকা ছবিগুলি তোলার জন্য ক্যামেরা কাঁধে করে চষে বেড়ান কলকাতা। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে কৃতী ফটোগ্রাফার সৌম্যশঙ্কর ঘোষাল স্ট্রিটস অব ক্যালকাটা প্রতিষ্ঠা করেন। এর খুব অল্পদিনের মধ্যেই সৌম্যশঙ্কর সহযোগী হিসাবে পেয়ে যান অন্য একজন কৃতী ফটোগ্রাফার ইন্দ্রজিত লাহিড়িকে।

image


সৌম্যশঙ্কর, ইন্দ্রজিত বা স্ট্রিটস অব ক্যালকাটার সদস্য অন্য ফটোগ্রাফারদের কেউই সেইঅর্থে পেশাদার ফটোগ্রাফার নন। সৌম্যশঙ্কর নিজে ম্যানেজমেন্ট পেশাদার। কনসালটেন্ট হিসাবে কাজ করেন। আর তাঁর প্রধান সহযোগী ইন্দ্রজিতের নিজের ব্যবসা রয়েছে। ওই ফটোগ্রাফিই পেশাদার কাজের বাইরে নেশা। সময় পেলেই কলকাতার রাস্তায় কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ নিয়ে টইটই করে ঘোরা। আর লেন্সবন্দি করা মহানগরীর জনজীবনের নানান মুহূর্ত।

সংস্থার অন্য সদস্যরা বেশিরভাগই ছাত্র অথবা ছাত্রী। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরে পড়ছেন, কেউবা স্নাতকোত্তরের ছাত্রী। লক্ষ্য করার মতো বিষয় এই যে, স্ট্রিটস অব ক্যালকাটার সদস্যদের ভিতর একটা বড় অংশই মেয়ে।

কলকাতার রাস্তাকে ছবির বিষয় হিসাবে ভেবে নিয়ে ফটোগ্রাফির পাঠ নিচ্ছেন ওঁরা। ওঁদের কথায়, কলকাতা শহরটা এখনও ভীষণ ভদ্র। কাজ করতে গেলে বেশিরভাগ সময়েই মানুষের সহযোগিতা পাওয়া যায়। সৌম্যশঙ্কর বললেন, তবে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষের এলাকায় ছবি তুলতে গেলে অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে। কারণ, এইসমস্ত এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই বিশ্বাস করেন, ফটোগ্রাফার ছেলেটা কিংবা মেয়েটা এই ছবিগুলি বিদেশে লক্ষ লক্ষ টাকায় বেচে লাল হয়ে যাবে। তাতে ওঁদের কোনও ভাগ থাকবে না। এধরনের ভুল ধারনাবশত অনেকক্ষেত্রে ছবি তুলতে গেলে আপত্তি করেন ওঁরা।

সৌম্যশঙ্কর নিজে একজন প্রতিষ্ঠিত স্ট্রিট ফটোগ্রাফার। আর ইন্দ্রজিতের ঝোঁক খবরের দিকে। প্রথম শ্রেণির একটি দৈনিক সংবাদপত্রের হয়ে ছবি তোলেন তিনি।

হেনরি কার্টিয়ের ব্রেসো নামে এক প্রসিদ্ধ ফরাসী ফটোগ্রাফার স্ট্রিট ফটোগ্রাফারের সংজ্ঞা সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯০৮ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হেনরি। মারা গিয়েছেন ২০০৪ সালে। স্ট্রিট ফটোগ্রাফার ব্যাপারটা বোঝাতে গিয়ে ইন্দ্রজিত বলছিলেন, আসলে জিনিসটা যেমন আছে, তার ছবি তেমনভাবে তুললেই সেটাকে বলা হয় স্ট্রিট ফটোগ্রাফি। স্ট্রিট ফটোগ্রাফির জনক মনে করেছিলেন, মানুষের জীবনে কোনও একটা মুহূর্ত আছে, যা মানুষ বারংবার দেখতে চায়। অবিকৃত সেই মুহূর্তটি। হয়তো বা কোনওভাবে শাশ্বতও। তাছাড়া, আর একভাবে ছবি তোলা যেতে পারে। চরিত্রকে শিখিয়ে-পড়িয়ে, সাজিয়ে তোলা যেতে পারে ফটোগ্রাফ। ওটা কিন্তু স্ট্রিট ফটোগ্রাফি নয়।

স্ট্রিটস অব ক্যালকাটার সদস্যদের সবাই নিজেকে স্ট্রিট ফটোগ্রাফার হিসাবে পরিচিত করাতে ভালোবাসেন। কয়েকদিন আগেই প্রায় জনা পঁচাত্তর তরুণ-তরুণী সকাল সকাল দলবেঁধে বেড়িয়ে পড়েছিলেন কলকাতার রাস্তায়। সকলেরই কাঁধে ক্যামেরা। ভোরের কলকাতার ছবি তুলছিলেন ওঁরা।

কথায় কথায় সৌম্যশঙ্কর জানালেন, মোবাইলে ছবি তুলতে ভালোবাসলে তিনিও কিন্তু আমাদের সংগঠনের সদস্য অথবা সদস্যা হতে পারেন। আসল কথা হল, সেই মানুষটি ছবি তুলতে ভালোবাসেন কিনা। এব্যাপারে ইন্দ্রজিতের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানা গেল, ফটোগ্রাফি ভালোবাসেন এমন কাউকে স্ট্রিটস অব ক্যালকাটার তরফে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে বলা হয়। এক্ষেত্রে একটা দামী ক্যামেরা আচমকা কেনার কোনও দরকার নেই।

স্ট্রিটস অব ক্যালকাটা মাঝেমধ্যে কলকাতা কিংবা কলকাতার বাইরে গিয়ে স্ট্রিট ফটোগ্রাফি নিয়ে ওয়ার্কশপেরও আয়োজন করে থাকে। সম্প্রতি এধরনের ওয়ার্কশপ হয়ে গিয়েছে দার্জিলিং, কালিম্পং ও সিকিমে।

ইতিমধ্যেই সৌম্যশঙ্করের ক্লিকের ছবি একাধিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়েছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, বিশ্বব্যাঙ্ক, নিকন অ্যাওয়ার্ড-সহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়েছে ওঁর ছবি।

স্ট্রিট অব ক্যালকাটার মহিলা সদস্যদের অধিকাংশ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পডুয়া। যেমন, ঈশিতা দে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আর পূর্ণশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় বিকম পড়েন। তবে একটি মেয়ে পথে পথে ঘুরে জনজীবনের ছবি তুলবে, তা সহজে মেনে নিতে পারেন না অভিভাবকরা। ঈশিতা ও পূর্ণশ্রী অভিভাবকদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে এই সমস্যার সমাধান করেছেন। ওঁরা দুজনেই এখন স্ট্রিট ফটোগ্রাফার।

কবি‌গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, তুমি কি কেবলই ছবি? একটি ছবি মানে আসলে অনেককিছুই বোঝায়। চোখের সামনে অজস্র মানুষ, সমাজ ও তার দৈনন্দিনতা লেন্সবন্দি করাটা আসলে ইতিহাসকে প্রত্যক্ষভাবে দেখা।

স্ট্রিট ফটোগ্রাফির জনক হেনরি কার্টিয়ের ব্রেসোর দেখানো পথে হাঁটছেন‌ সমগ্র পৃথিবীর স্ট্রিট ফটোগ্রাফাররা।

ও পথের পথিক মেট্রো কলকাতার নবপ্রজন্মও।