ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম অখিল। বাড়ির নিয়ম মেনে পড়াশোনা করতে হত বটে, অখিলের মন পড়ে থাকত পড়ার বাইরে সৃজনশীল জগতের দিকে। পুরো নাম অখিলবন্ধু পাল। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজে জন্ম এবং বড় হওয়া। কালিপুর বয়েজ স্কুলে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের পর কলকাতায় চলে আসেন। চারুচন্দ্র কলেজে সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হন। কিন্তু ওই যে গতানুগতিক পড়াশোনা তাঁর কোনও দিনই ভালো লাগত না। প্রথম বর্ষের পর সেটা আর এগোয়নি।
স্কুল, কলেজের পড়ার বাইরেও যে একটা জগৎ আছে সেটাই দেখিয়ে দিয়েছেন অখিল। স্কুলে প্রথম সেরা পাঁচ পড়ুয়ার মধ্যে একজন হওয়ায় এইচএসে পড়ার সময় বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজির উদ্যোগে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পান। মূলত গ্রাফিক্স এবং প্রযুক্তি বিদ্যায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ট্রেনিং শেষ হলে ইন্টার ডিস্ট্রিক্ট প্রতিযোগিতা হয়। তাতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্কলারশিপ পান। কলেজের পড়া এবং স্কলারশিপ দুটোই সমান তালে চলছিল। পোষালো না অখিলের। কলেজের পড়া ছেড়ে গ্রাফিক্স ডিজাইনিংকেই বেছে নেন। চলে যান বম্বে। আন্ধেরিতে একটি সংস্থায় গ্রাফিক্সেই আরও উন্নত প্রশিক্ষণের পর সেখানেই ট্রেনার হিসেবে যোগ দেন। তিন বছর ছিলেন। কাজ করতে করতে মনে হয়েছে সেখানে গ্রাফিক্স ডিজাইনারদের অধিকাংশই বাঙালি। ‘তখন মনে হল, এখানে পড়ে থাকা কেন। কলকাতার ছেলেমেয়েরা এত ভালো গ্রাফিক্স ডিজাইন করে, সেখানে গিয়েই কাজ করি’, বলেন অখিল। ফিরে আসেন কলকাতা। বন্ধুদের সঙ্গে মিলে খুলে ফেলেন নিজের সংস্থা মায়বিয়াস। মায়াবিয়াস নামের এই স্টার্টআপ থেকে আরও এক স্টার্টআপের জন্ম। তাঁতি ডট বিজ। অখিলেরই আরেক স্টার্টআপ তাঁতের শাড়ির ব্যবসা ঘিরে।
মায়াবিয়াসেরই পার্টনার রানা বসাক। বাড়ি ফুলিয়ায়। তাঁতের তীর্থ ক্ষেত্র বলা যায়। রানার পৈত্রিক ব্যবসা তাঁতের শাড়ি। রানাদের এই পৈত্রিক ব্যবসা নিয়ে কথা বলতে বলতেই আইডিয়াটা আসে অখিলের মাথায়। ‘তাঁতের শাড়ির নকশাগুলি অনেকটা গ্রাফিক্স ডিজাইনের মতোই। নকশার গ্রাফটা দেখে আকৃষ্ট হই। ভাবলাম ভালো ডিজাইন দিয়ে দিলে তাঁতিদের এই শাড়িতেই সোনা ফলবে’, বলেন অখিল। আর দেরি করেননি। শুরু করলেন tanti.biz।
অখিলের মতে, ‘যেখানে যত তাঁত তৈরি হয় তার মধ্যে বাংলার তাঁত সারা দেশে সবচেয়ে নিখুঁত। ইউরোপীয়ান বাজারেও যে কোনও পণ্যকে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় ফেলে দিতে পারে বাংলার এই তাঁত। কম দামে এত ভালো মানের তাঁত আর কোথাও পাওয়া যায় না। ধরতে পারলে এই বাজারের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল’। ব্যবসায় নামার সময় দুটো জিনিস মাথায় ছিল অখিলের। এক নিজের ব্যবসায় লাভ। আর দ্বিতীয়ত, চিরকাল আড়ালে থাকা তাঁতিদের বাজারে তুলে এনে তাঁদের পরিচিতি তৈরি করা।
ফুলিয়ার কয়েকজন তাঁতিকে বেছে নিয়ে কাজ শুরু করেন অখিল এবং তাঁর সঙ্গীরা। ডিজাইন দিয়ে দেওয়া হত। সেই মতন তাঁত বুনে নকশা করে দেন তাঁতিরা। অখিল মনে করেন, ‘ইদানীং তাঁতের মান অনেক পড়েছে। পুরনো সেই মান ফিরিয়ে আনাই আমাদের লক্ষ্য’। সেটা করতে গিয়েই পুরনো তাঁত জোগাড় করছে টিম ‘তাঁতি’। পুরনো সেই ডিজাইনগুলিকে নতুন করে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে ‘তাঁতি ডট ভিজ’ এর শাড়িতে। এক একটা শাড়ি তৈরিতে কারিগরদেরও পরামর্শ নেন অখিলরা। ‘কোন সুতোর কী মান, কীসে ভালো রং খুলবে, সুতির সুতো নাকি সিল্কের সুতো কোন শাড়িতে কী ভালো হবে এই অভিজ্ঞ তাঁতিদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হয়’, জানান অখিল।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা অখিল বললেন সেটা হল, যে কারিগররা কাজ করছেন তাঁরা নিজেরাই নিজেদের বাজারে তুলে ধরবেন। কীভাবে? অখিল জানান, ‘আমরা সব তাঁতিকে একটা করে ডিভাইস দিয়ে দেব। তাঁরা যে কাজ করবেন তার ছবি উঠতে থাকবে। তারপর একটা অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে সেটাকে tanti.biz এর ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়া হবে । তিনটি স্তরে কারিগররা নিজেই সেটা করবেন। তার জন্য বিরাট টেক সেভি হওয়ারও প্রয়োজন নেই। ঠিক যেমন উবের বা ওলা বা মেরু এই ট্যাক্সিগুলির ক্ষেত্রে করা হয়’। অখিল বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য তাতিঁদের পরিচিতি দেওয়া। কারিগররা নিজেরাই নিজেদের কাজের প্রদর্শনী করবেন, দাম ঠিক করবেন। এর ফলে ফড়েদের খপ্পরে পড়ে তাঁতিরা যে তাঁদের সৃষ্টির যথেষ্ট মূল্য পান না, সেটা আর হবে না’। আসলে তাঁতিরা সরাসরি যাতে বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন তার জন্যই এই ব্যবস্থা।
কোনও ব্যাংক লোন নয়। বাইরের কোনও বিনিয়োগও নয়। সম্পূর্ণ নিজেদের পুঁজির ওপর ভরসা করে ব্যবসায় নামেন অখিল, রানারা। তাঁতি ডট বিজ এর বয়েস মাত্র কয়েক মাস। যদিও তার ভাবনা চিন্তা এবং চালু করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল বছর খানেক আগে। ইতিমধ্যে বালিগঞ্জ ও সল্টলেকে আউলেট খুলে ফেলেছেন। পুজোর পর আরও ৫টি আউলেট খোলার কথা। এগুলি হবে দিল্লি, বাঙ্গালুরুতে একটি করে এবং কলকাতায় বাকি ৩টি। কলকাতার ৩ টি আউটলেট কোথায় হবে তাও ঠিক হয়ে গিয়েছে। এবার তাঁতির শোরুম হবে বেহালা, দমদম এবং মধ্য কলকাতা। এই বছরের শেষে তাঁতির ব্যবসা ৫ কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে মনে করছেন কলকাতার তরুণ এই উদ্যোক্তা।