মফস্বলে রূপচর্চার সংজ্ঞা বদলে দিলেন পুরুলিয়ার অপর্ণা

মফস্বলে রূপচর্চার সংজ্ঞা বদলে দিলেন পুরুলিয়ার অপর্ণা

Sunday September 13, 2015,

4 min Read

সারাদিন দৌড়ঝাঁপ। দুটো স্যালোঁ আর সংসারের সব দায়িত্ব সামলে প্রায়শই মনে হয়, কেন যে দিনে মাত্র চব্বিশটা ঘণ্টা! এরই মধ্যে ওয়ার্কশপ বা কনফারেন্স যোগ দিতে দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত। পশ্চিমবঙ্গের মফস্বলের মহিলাদের সম্পর্কে আপনার যদি কোনও ক্লিশে ধারণা থেকে থাকে, তা নিমেষে বদলে দিতে পারেন পুরুলিয়ার অপর্ণা ব্যানার্জী।

অপর্ণা ব্যানার্জী

অপর্ণা ব্যানার্জী


অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া জেলা বলেই পরিচিত পুরুলিয়া। এখানকার মধ্যবিত্ত মুখার্জী পরিবারে জন্ম অপর্ণার। স্কুল, কলেজ। আর তারপর সরকারি চাকরি। সেই চেষ্টায় সফল না হলে বড় জোর টিউশন পড়ানো। এটাই এখনও ছোট্ট এই শহরের দস্তুর। তবে গতানুগতিক এই ধারা অপর্ণার মনে ধরেনি। কলেজে পড়তে পড়তে বিয়ে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মা হন। কয়েকবছর সংসার করে কাটলো। 

সালটা ১৯৯৮। মনের কোণে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছেটা একদিন সাহস করে স্বামীর কাছে প্রকাশ করেই ফেললেন। পরিবারের সম্মতি তো জুটল। কিন্তু করবেন টা কী? বাড়ির কাছেই বিউটি পার্লারে টুকটাক রূপচর্চার কাজ শিখেছিলেন। সেটাই সহায় হল। বাড়ির বসার ঘরে পার্টিশন দিয়ে আয়না আর চেয়ার পেতে শুরু হল কাজ। পাড়ার মহিলারাও আসতে থাকলেন। কাজের সুখ্যাতি ছড়াতে বেশি সময় লাগলো না। অপর্ণাও বুঝলেন, এভাবে বাড়িতে কাজ করা আর সম্ভব নয়। কাজ করার আলাদা জায়গা দরকার। নিজের এবং স্কুলশিক্ষক স্বামীর জমানো কিছু টাকা আর ডিআইসি-র লোনকে সম্বল করে, ১৯৯৯ সালের ১৪ই এপ্রিল, ৬০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করল 'লা- বেল লেডিজ বিউটি পার্লার'। অপর্ণার সঙ্গী তখন মাত্র একজন সহকারি। কাজের সূত্রেই কলকাতায় আসা ‌যাওয়া বাড়তে লাগলো। অপর্ণা বুঝলেন, সত্য়িই যদি এই ব্য়বসাকে বড় করে গড়ে তুলতে হয়, তাহলে পেশাদারি শিক্ষা দরকার। নিজের রোজগারের টাকা দিয়ে ভর্তি হলেন সিটি অ্যান্ড গিল্ডস লন্ডনের কলকাতার একটি শাখায়। দুই মেয়ে, স্বামী, সংসার সঙ্গে পার্লার। সব সামলে প্রতি মাসে বাইরে গিয়ে ক্লাস করা সহজ ছিল না। টানা তিন বছর ছুটির দিন পাননি বললেই চলে। তবে এই কঠোর পরিশ্রমের ফল মিলল হাতেনাতে। মফস্বলের ছোট্ট একটি শহরে খুব সহজেই অপর্ণা পৌঁছে দিতে পারলেন ইন্টারন্যাশনাল বিউটি ট্রিটমেন্টের হরেকরকম পদ্ধতি। কাজ করতে শুরু করলেন বহু নামী ব্র্যান্ডের সঙ্গে। নিজে হাতে কাজ করার পাশাপাশি পুরুলিয়া শহরের বহু মেয়েকে কাজ শেখাতেও লাগলেন। অনেককেই চাকরি দিলেন নিজের পার্লারে।

লা-বেল-এ মহিলাদের স্কিন ট্রিটমেন্ট সেকশন

লা-বেল-এ মহিলাদের স্কিন ট্রিটমেন্ট সেকশন


এপর্যন্ত পুরোটাই উত্থানের গল্প। কিন্তু ভাগ্য চিরকাল সহায় হয় না। অপর্ণার জীবনেও হঠাৎ ছন্দপতন ঘটল। আচমকা বাড়িতে ঘটে ‌যাওয়া এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন তাঁর স্বামী। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল তাঁর জীবেনর সাপোর্ট সিস্টেম। বড় মেয়ে পড়াশুনো শেষ করে চাকরিসূত্রে কলকাতায়। ছোট মেয়ে সবে ক্লাস নাইন। মাথার উপর সদ্য কেনা ফ্ল্যাটের লোনের বোঝা। সব কিছু সামাল দেবেন কী করে? ব্যবসা না সংসার, কোনটা সামলাবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তবে লড়াকু মানসিকতা সহজে হার মানেনি। মাসখানেকের মধ্যেই সামলে উঠলেন। কাজে ফিরলেন। ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় গড়ে তুললেন লা-বেলের দ্বিতীয় শাখা। 'লা-বেল ফ্যামিলি জোন'। এত বড় কর্মকাণ্ড একা সামলানো সম্ভব নয়। তাই পেশাদারিভাবে প্রশিক্ষিত হেয়ার এবং স্কিন এক্সপার্টদের আনলেন বাইরে থেকে। রুজি-রোজগারের টানে অনেকেই মফস্বল থেকে শহরে আসেন। কিন্তু জামশেদপুর, আসানসোল এমনকী আহমেদাবাদের মতো জায়গা থেকেও পুরুলিয়ায় তাঁর নতুন এই স্যালোঁয় কাজ করতে অনেককেই নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন অপর্ণা। স্কিন ট্রিটমেন্ট, হেয়ার কালার ও ট্রিটমেন্ট, প্রফেশনাল মেক-আপ, পিয়ার্সিং-এর পাশাপাশি এখানে যুক্ত হয়েছে নানা প্রকারের স্পা, নেল আর্ট, বডি আর্ট, ট্যাটুর মতো পরিষেবাও।

লা-বেল ফ্যামিলি জোন

লা-বেল ফ্যামিলি জোন


সঠিক এবং অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে কাজ করতে চান। তাই এখনও মাঝেমাঝে মুম্বই, দিল্লিতে ক্লাস করতে যেতে হয়। পুরুলিয়ার অপর্ণা ব্যানার্জী এখন বহু বিউটি এক্সপার্টের কাছেই পরিচিত নাম। বিভিন্ন ব্র্যান্ড তাঁর সঙ্গে টাই-আপ করতে চায়। শুধু নিজের নয়, আরও অনেকগুলি পরিবারের দায়িত্ব পরোক্ষভাবে তাঁর কাঁধেই। এতসব জানার পর জিজ্ঞেস করলাম, 'তাহলে কি এবার ছোট শহরের গণ্ডি ছেড়ে লা-বেল কলকাতায় পাড়ি দেবে?' সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল,'না। কলকাতার মতো বড় শহরে এইসব পরিষেবা তো সকলের দোরগোড়ায়। আমি চাই অন্যান্য জেলায় বা ছোট শহরগুলিতে লা-বেলের পরিধি বাড়াতে।' যেখানে মানুষ এই ধরণের সুযোগ-সুবিধা পান না সেখানে পৌঁছতে চান অপর্ণা। সত্যিই তো, প্রথা ভেঙে যিনি এগোতে চান, তিনি তো এভাবেই ভাববেন। তা নাহলে কি এত মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠা যায়?