ঋতু-সংকোচ কাটাতে ইকো ডেভের ‘সম্পূর্ণা’

ঋতু-সংকোচ কাটাতে ইকো ডেভের ‘সম্পূর্ণা’

Saturday October 24, 2015,

4 min Read

ঘনবসতির মধ্যে স্কুল। চারদিকে বাড়ি। রাস্তায় সব সময় লোক। এই অবস্থায় ব্যবহার করা ন্যাপকিন কীভাবে বাইরে ফেলা হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না ছাত্রীদের। স্কুলে এমন পরিস্থিতি। বাড়িতেও অস্বস্তির শেষ নেই। সেখানেও কেউ দেখে ফেলতে পারে, এমন লজ্জার চোরাস্রোত সবসময় থেকে যায়। এমন বিড়ম্বনা থেকে এবার মুক্তির পথ মিলেছে। ‌পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ৯টি স্কুলে দুটি করে মেশিন বসানো হয়েছে। যার মধ্যে একটি স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন। যে যন্ত্রে পাঁচ টাকার কয়েন ফেললেই বেরিয়ে আসবে দু’টি ন্যাপকিন। ব্যবহৃত ন্যাপকিন নষ্ট করে দেওয়ার জন্য রয়েছে ইনসিনেরটর মেশিন। যেখানে ব্যবহার করা ন্যাপকিন ফেলে দিলে কয়েক মিনিটের মধ্যে তা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ‘সম্পূর্ণা’ প্রকল্পের মাধ্যমে শুরু হয়েছে এই নিঃশব্দ বিপ্লব।


স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন উদ্বোধনে সাংসদ

স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন উদ্বোধনে সাংসদ


কৈশোরে শুরু। চল্লিশের কোঠায় গিয়ে শেষ। এই দীর্ঘ সময়, এতগুলো বছরে মহিলাদের ঋতুস্রাবের মুহূর্তগুলো অস্বস্তির। আসলে দেশের সামাজিক পরিস্থিতিতে বছরের পর বছর ধরে এভাবেই অনেক কিছুর সঙ্গে ওদের ‘সমঝোতা’ করতে হয়। লজ্জা, সংকোচ, ভীতি যেন এই সময়ের সঙ্গী হয়ে থাকে।

২০১১ সালে এসি নিয়েলসেনর একটি সমীক্ষা বলছে দেশের প্রায় ৩৬ কোটি মহিলার মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। তাহলে ৮৮ ভাগ মহিলারা কী করেন। এদের একটা বড় অংশ এই সময় কাপড় ব্যবহার করেন। কেউ অন্য কিছু। সেগুলো ব্যবহারের পর অস্বাস্থ্যকর অবৈজ্ঞানিকভাবে শুকিয়ে ফের ব্যবহার করা হয়। যার ফলে শরীরে রোগের বাসা বাঁধে। শুধু অজ্ঞতা নয়, এর পিছনে রয়েছে আর্থিক সমস্যাও। এমন অনেক পরিবার রয়েছে যাদের কাছে ন্যাপকিন কেনার জন্য মাসে ১০০ টাকা খরচ করা বিলাসিতা। পাশাপাশি ন্যাপকিন পাওয়ার সমস্যাও তো একটা বড় বিষয়। অনেক প্রচার হলেও গ্রামীণ ভারতের একটা বড় অংশ এখনও হাতে পায়নি স্যানিটারি ন্যাপকিন।

ইকো ডেভ-এর কর্ণধার সুতনু ঘোষ ও সুব্রত রানা

ইকো ডেভ-এর কর্ণধার সুতনু ঘোষ ও সুব্রত রানা


সব থেকে বড় সমস্যা স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে। অনেক বোঝালেও অস্বস্তি এড়াতে অনেক ছাত্রীই এই সময়টায় স্কুল এড়িয়ে চলেন। মফঃস্বলে এই প্রবণতা বেশি।

এই পরিস্থিতি বদলানোর চেষ্টা শুরু করেছে ইকো ডেভ। পশ্চিম মেদিনীপুর দিয়েই নীরবে শুরু হল এই বিপ্লব। কলকাতার কেষ্টপু‌রের ইকো ডেভ কনসালটেন্সি নামে একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মেয়েদের এই সমস্যার সমাধানের খোঁজে দীর্ঘ গবেষণা করেছে। স্বচ্ছ ভারত প্রকল্প থেকে প্রেরণা নিয়ে তারা এমন একটা যন্ত্র তৈরি করতে চেয়েছে যা হবে সহজলভ্য, দামে নাগালের মধ্যে এবং সহজে গ্রহণ করা যাবে। এই তিন বৈশিষ্ট্য মিলেই তৈরি হয় স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন এবং ইনসিনেরটর মেশিন। স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিনে একটি পাঁচ টাকার কয়েন ফেললেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে দুটি স্যানিটারি ন্যাপকিন। আর ব্যবহৃত ন্যাপকিন নষ্ট করে দেওয়ার জন্য রয়েছে ইনসিনেরটর মেশিন। যেখানে ব্যবহার করা ন্যাপকিন ফেলে দিলে কয়েক মিনিটের মধ্যে তা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।সংস্থার দুই মাথা সুতনু ঘোষ ও সুব্রত রানা কাজটা শুরু করেছিলেন কয়েক মাস আগে। এই প্রকল্পের কথা জানানো হয়েছিল অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে। অনির্বাণবাবু মেদিনীপুরের সাংসদ সন্ধ্যা রায়ের আপ্ত সহায়ক। সন্ধ্যাদেবী এই অভিনব মেশিনের বিষয়টি জানতে পেরে তাঁর এমপি ল্যাডের টাকায় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ৯টি স্কুলে এই ধরনের মেশিন বসানোর সিদ্ধান্ত নেন। জাতির জনকের জন্মদিন ২ অক্টোবর সূচনা হয় এই স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন-এর। যার পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে ‘সম্পূর্ণা’।


এক ছাত্রীর সঙ্গে সন্ধ্যা রায়

এক ছাত্রীর সঙ্গে সন্ধ্যা রায়


স্বয়ং সাংসদ মেয়েদের হাতে করে দেখিয়ে দেন কীভাবে মেশিনে ৫ টাকার কয়েন ফেললে দুটি ন্যাপকিন বেরিয়ে আসবে। আবার ব্যবহৃত ন্যাপকিন কীভাবে নষ্ট করে দিতে হবে। মেদিনীপুর কলেজিয়েট বালিকা বিদ্যালয় ও খড়গপুরের অতুলমণি হাইস্কুলে এই যন্ত্রের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন সন্ধ্যা রায়। স্কুলের টয়লেটে থাকবে এই মেশিনগুলি। শুধু মেশিন বসিয়েই কাজ শেষ হওয়া নয়, ওই যন্ত্রের মাধ্যমে কতটা মেয়েদের কাজ হচ্ছে, কীভাবে আরও ছাত্রীদের কাছে পৌঁছানো যাবে তার নিরন্তর গবেষণা, সমীক্ষা চালাচ্ছে ইকো ডেভ। এই সংস্থা ইতিমধ্যেই কলকাতার বিনোদনী গার্লস স্কুল, শাখওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে এধরনের মেশিন বসিয়েছে। কলকাতার আরও সাতটা স্কুলে এই পরিষেবা তারা দিতে চলেছে। কাপড়ের বদলে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহারটা ছোট থেকেই যাতে অভ্যাসটা হয়ে যায় সেই ব্যাপারটাই নিশ্চিত করতে চাইছে ইকো ডেভ। রোটারি ক্লাবের ডি‌স্ট্রিক্ট গর্ভনর (‌৩২৬১) ঝুলন বসুরও প্রকল্পটি পছন্দ হয়েছে। তিনি কলকাতা ও দুই চব্বিশ পরগনায় ১০টি মেশিন বসিয়েছেন। এবং আরও এধরনের শতাধিক মেশিন তারা বসাতে চলেছেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের দুটি সরকারি হোমের পাশাপাশি আরও অনেক স্কুল এই প্রকল্পের জন্য উৎসাহ দেখিয়েছে। পাশের জেলা পূর্ব মেদিনীপুর থেকেও ডাক আসছে তাদের কাছে। বাইরের রাজ্যগুলিও ইকো ডেভের এই ধরনের মেশিন নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে।

সাংসদ সন্ধ্যা রায়ের কথায়, এই নিয়ে আতঙ্ক ও সমস্যা পুরোপুরি কাটেনি। তবে এই প্রকল্প মেয়েদের সমস্যা দূর করতে অনেকটাই সাহায্য করবে। মেয়েরা রোগের হাত থেকেও বাঁচবেন। যাদের জন্য এত আয়োজন তাঁরা কী বলছেন। মেদিনীপুরের এক স্কুলছাত্রী বলছেন, এই সময় আগে স্কুলে আসতেই ভয় করত। চর্তুদিকে এত লোক। ন্যাপকিন ফেলা ছিল যত মাথাব্যাথা। মনে হয় সেই অস্বস্তির দিন এবার কাটতে চলেছে। স্কুলের শিক্ষিকারাও বলছেন এর ফলে তাঁরাও উপকৃত হবেন। আর এর ফলে স্কুলের পরিবেশও ভাল থাকবে। সম্পূর্ণার হাত ধরে মেয়েদের এই সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান এখনই না হলেও সেই লক্ষ্য পৌঁছানোর সলতে পাকানোর কাজ কিন্তু এভাবেই গ্রাম বাংলার মাটি থেকে শুরু হয়েছে।