তপনের ছটায় প্রকৃতি-মানুষের চিরন্তন সম্পর্ক

তপনের ছটায় প্রকৃতি-মানুষের চিরন্তন সম্পর্ক

Monday October 19, 2015,

3 min Read

নিয়তির কালচক্রে ওপার বাংলা থেকে এপারে আসা। কখনও লেদ মেশিনের কারখানায় কাজ, কখনও মাথায় বোঝা নিয়ে হাঁটা। দিনের শেষ দমদমের একটি ক্লাবে রাত্রিবাস। জীবনযুদ্ধের এই সংগ্রাম আর দারিদ্রের মধ্যেও বেঁচে ছিল শিল্পীর হৃদয়। মনে মনে বিকশিত হচ্ছিল শিল্পভাবনা। তাই কাঠ পেন্সিল হাতে পেলেই কিছু একটা আঁকার চেষ্টা করেন। ক্যানভাস নয়, কাগজের ওপরই তাঁর যত শাসন। কখনও তাঁর আঙুলের নিপুণ টানে উঠে আসে ম্যালথাসের তত্ত্বের চিত্ররূপ। একখানা কাঁঠালের ওপর দাঁড়িয়ে অজস্র কোয়া-রূপী মানুষ। পৃথিবীর জনসংখ্যা বিস্ফোরণের এ ছবির চিত্রকর তপন কর্মকার। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কই তাঁর ছবির বিষয়।


image


জন্ম বরিশালের চরামন্দী গ্রামে। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ত‌পন। ছোট থেকেই অভাব-অনটন ছিল তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। লেখাপড়া বলতে ক্লাস ফোর। এরপর আর এগোনো হয়নি। অভাবের কাছে কোথাও যেন হেরে গিয়েছিল শিক্ষা। বাছতে হয়েছে শ্রমের কঠিন পথ। এর‌ই মধ্যে পূর্ব ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে। দিনে শ্রম, রাতে শিল্প। অন্যান্যরা যখন শ্রমের ভারে ন্যুব্জ, তপনকে তখন হাতছানি দিয়ে ডাকছে সাদা কাগজ। এদিক-ওদিক থেকে কুড়োনো কাগজই তখন তাঁর ক্যানভাস। কাঠ পেন্সিলের আঁচড়ে কিছুক্ষণেই সেখানে প্রকাশ ঘটছে অসাধারণ শিল্পরূপ। প্রথাগত আঁকিবুকির শিক্ষা ছিল না তাঁর। অথচ নিজের অজান্তেই কাগজে জন্ম দিতেন এক অনন্য শিল্পসত্তা। যা দেখে প্রশংসা না করে পারেন‌নি বিকাশ ভট্টাচার্য, প্রকাশ কর্মকার, বিজন চৌধুরীর মতো শিল্পীরা।


image


মন যার রঙে ভর্তি তাঁকে কি আর পেন্সিলে রোখা যায়। সে কারণে আর্থিকভাবে সামান্য থিতু হতেই পেন্সিল ছেড়ে জল রঙে কাগজ ভরিয়েছেন তপন। কখনও আবার কাঠ কয়লা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন ব্যতিক্রমী শিল্পকর্ম। তেলরঙ দিয়ে ক্যানভাসে ফুল ফোটাচ্ছেন। একদিন সেই মনের জানালার ছবি বাস্তবায়িত হবে। এমনই একরাশ স্বপ্ন রয়েছে তপনের। অভাবের কাছে আপাতত হারলেও ম্যারাথন লড়াইয়ে জিততে নিভৃতে তৈরি হচ্ছেন তপন। সুযোগ পেতেই নিজের ছবি দেখিয়ে এসেছেন সমাজের নামজাদা ব্যক্তিত্বদের। জীবন সংগ্রামী তপনের কাজ দেখে অবাক হয়েছেন অনেকেই। যার মধ্যে মহাশ্বেতা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেমন রয়েছেন, আছেন মাদার টেরেসা, সঙ্গিতশিল্পী অজয় চক্রবর্তী এবং সুচিত্রা মিত্রও।


image


তবে এতসব প্রশংসাতেও জীবন সংগ্রামের চিড়ে ভেজেনি। এখনও টাকার অভাবে বড় গ্যালারিতে নিজের ছবি প্রদর্শনী করতে পারেননি তপন। মাঝেমধ্যে কোনই বইমেলায় পেয়ে যান প্রদর্শনীর স্থান। সেখানেই পৌঁছে যান ছবি নিয়ে। বড় প্রদর্শনী বলতে ১৯৯৫ সালে টালিগঞ্জ মেট্রোর আর্ট গ্যালারি। তবে ওটাই শেষবার। এরপরই এসেছিলেন সংবাদের শিরোনামে। ব্যস ওইটুকুই। সরকারের তরফে কোনও সুবিধা জোটেনি তাঁর কপালে। জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়েও শিল্প সৃষ্টির পথ নিশ্চিত করে চলেছেন তিনি। একটু আধটু লেখালেখিও করেন। ‘কবির দেশ’ বলে তাঁর লেখা বইতে উঠে এসেছে চড়াই ডিঙানোর না বলা কথা। নিজের দেখানো পথে হাতেখড়ি দিচ্ছেন কচিকাঁচাদেরও‌। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে তাদের শিল্পের পাঠ দিচ্ছেন ‘আঁকিবুকির কারিগর’। ইতিমধ্যেই তাঁর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২০ ছাড়িয়েছে। মাস্টারমশাই হয়েও ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে ‘গুরুদক্ষিণা’ চান না তপন। শিক্ষার্থীদের কাগজ-পেন্সিলের জন্য চাঁদা মাত্র ১০ টাকা। তাও এর মধ্যে অনেক সময়ই লজেন্স কিনে দিতে হয়। এরকম দিলদরিয়া মাস্টারমশাই পেয়ে বেজায় খুশি ছাত্র-ছাত্রী সহ তাদের অভিভাবকরা।


image


তপনের এই ‘দাতাকর্ণ’ ভাবমূর্তিতে যদিও খুশি নন তাঁর পরিচিতরা। প্রকাশ্যে না বললেও আড়ালে তপনকে কটূ কথা শোনাতে ছাড়েন না তাঁরা। যদিও পরিচিতদের এই কথা কানেই আনেন না কচিকাঁচাদের গুরু। স্মিত হেসে শুধু বলেন, ‘এই দুয়ার দেওয়া সরে, কভু আঁধার নাহি করে।’