বৃহন্নলা জীবন নিয়ে কোমল আহুজার মরমী কলম

বৃহন্নলা জীবন নিয়ে কোমল আহুজার মরমী কলম

Wednesday June 22, 2016,

5 min Read

কিছুদিন আগে এক রূপান্তর-কামী নারীর কথা জানলাম। তিনি থাকতেন এই বাংলারই একটি অজ গ্রামে। তথাকথিত সমাজের অত্যাচারে বাড়ি থেকে বেরনই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। রাস্তায় বেরলেই স্থানীয় পানের দোকান, রিক্সা স্ট্যান্ড, গ্রামের বাসস্টপের পাশে চণ্ডীমণ্ডপের ধারে বাঁশের মাচায় বসে থাকা যুবকেরা তাঁকে দেখে টিটকিরি দিত। ঢিল ছুঁড়ত। চিৎকার করে ছুঁড়ে দিত নোংরা অপমানজনক গালিগালাজ। সময়ে অসময়ে দিনে, রাতে, সন্ধ্যায় যখনই সুযোগ পেত দিত কুপ্রস্তাবও। দীর্ঘদিন মুখ বুজে সয়ে গেছেন শ্যামল রূপান্তরে পূজা। যাকে ভালোবাসতেন সে থাকত বাড়ির কাছেই। ছোটবেলা থেকে এক সঙ্গে খেলেছেন। রান্নাবাটি, স্কুল স্কুল, একটু বড় হতেই মনের ভিতর জট বেঁধেছে। তাঁকেই তাঁর মনে হয়েছে ‘পরাণসখা বন্ধু হে আমার।’ রোজ সকালে বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে একবার হলেও খোঁজ নিত ছেলেটি, ‘কিরে শ্যামল কেমন আছিস?’ একদিন কি হল, মনের কথা বলতেই শ্যামল ওরফে পূজার গালে কষিয়ে চড়...। তারপর থেকে আর ও এমুখো হয় নি। কথা বন্ধ। অসম্মানে অপমানে নারী মনের অতল থেকে উঠে এসেছিল মৃত্যুর ইচ্ছে। নয় নয় করে নয় বারের চেষ্টাতেও মরতে পারেননি। বারবার রবীন্দ্রনাথের মুখটা ভেসে উঠেছে। দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারে তাঁর বাণী ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।...’

image


এখন পূজা আর ওই গ্রামে থাকেন না। কলকাতায় বাসা ভাড়া করে থাকেন। পড়াশুনো শেষ করেছেন। এখন চাকরি করেন। প্রেমে পড়ার ইচ্ছে নেই। কিন্তু নারীত্ব আর প্রেমের অহমিকাই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সম্প্রতি আর জি কর মেডিকেল কলেজ থেকে লিঙ্গান্তর করিয়েছেন পূজা। এখন তিনি স্পষ্ট একটি লিঙ্গের অধিকারিণী। এটুকুই তাঁর প্রাপ্তি।

তথাকথিত পিতৃতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থান যেখানে দ্বিতীয় স্তরের নাগরিকের সেখানে লিঙ্গান্তরিত নারীর স্থান কোথায়? এই প্রশ্নই তাঁকে একটা সময় অনেক ভাবিয়েছে। তবু তিনি আজ এটুকু ভেবে তৃপ্ত অন্তত তিনি নিজের কাছে পরিষ্কার। শত অপমান শত হিংসার এই সমাজে পূজা শুধু নিজের কথা ভাবেন না। ভাবেন তাঁর কমিউনিটির কথা। যুক্ত হয়েছেন সমস্ত সমমনস্ক গোষ্ঠীর সঙ্গে।

বলছিলেন মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ জীব। একা একা বাঁচা যায়না। কবিতা লেখেন। আর অনেক বই পড়েন। পূজাই আমায় দিলেন এক রাজস্থানি লেখিকার বই। Love no matter what লিখেছেন কোমল আহুজা।

বৃহন্নলা সমাজের যন্ত্রণা নিয়ে লিখেছেন। তাঁদের জীবনের হার্ডেলগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আর দেখিয়েছেন বৃহন্নলা মানেই ট্রেনে ট্রেনে তোলাবাজি করা নয়। আরও অনেক কিছু করার আছে। বইটার পাতায় পাতায় লাইনে লাইনে লাল নীল মার্কার পেন দিয়ে উজ্জ্বল করে রেখেছেন পূজা। প্রতি সপ্তাহে বইটা নেড়ে চেড়ে দেখেন। আর এগিয়ে যাওয়ার অক্সিজেন সঞ্চয় করেন।

পূজা বলছিলেন, কমিউনিটি টা জরুরি। কারণ দল বেঁধে থাকলে কেউ আক্রমণ করতে পারবে না। আর এগোনোও সম্ভব হবে। কারণ তাঁর মতে ভারতীয় সমাজে বৃহন্নলাদের অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। এমনকি মহাভারতের আমলেও শিখণ্ডী এবং বৃহন্নলাকে যেভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে তাতে এটাই স্পষ্ট যে স্বাভাবিক ভাবে এঁদের কোনও গ্রহণযোগ্য পরিচয় ছিল না। ভারতীয় সমাজে এরা দাবার একটি পদাতিক ঘুঁটি হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে এসেছেন।

কোমল হয়ত জানেনও না যে তাঁর এত বড় ভক্ত কলকাতায় থাকেন। জয়পুরের আহুজা গ্রুপের কর্ণধার ললিত আহুজার স্ত্রী কোমল শুধু যে শিল্পপতির গৃহবধূ। এটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তাঁর স্বতন্ত্র পরিচয়েই তিনি সমুজ্জ্বল। লেখিকা। শিক্ষিকা। এবং স্বামীর পাশে থেকে যোগ্যতার সঙ্গে সামলাচ্ছেন ব্যবসাও। এবার শুনব তাঁর উপন্যাসোপম কাহিনি Love no matter what এর কথা। কেন পূজা এই বইয়ের এত ভক্ত!

বইটায় একটি চকচকে ঝকঝকে পরিবারের ছবি আছে। রাজস্থানের প্রেক্ষাপটে লেখা। সম্ভ্রান্ত পরিবারের একটা নিটোল ছবি। সেখানে প্রেম আছে। প্রণাম আছে। ঘোমটা টানা গৃহবধূর সম্ভ্রম আছে। টায়রা-টিকলি-কঙ্কণের ঝনঝনানি আছে আর আছে একটি মায়ের কান্না। মেয়ের হাহাকার। এবং সামাজিক দীর্ঘদিনের সমস্যার একটি যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান। ভালোবাসার একটি অনন্য উপাখ্যান লিখেছেন কোমল আহুজা।

নয়না এবং নবীন দম্পতি। একে অপরের প্রতি গভীর প্রেম। গভীর সম্মানবোধ। গল্পটা শুরু হচ্ছে যেখান থেকে সেখানে নয়না মা হচ্ছেন। সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। ডাক্তার নবীনকে ডেকে জানাচ্ছেন তাঁর সন্তান ইন্টার-সেক্স চাইল্ড। নবীনের মাথায় বজ্রাঘাত। নয়নার চোখের জলে রাজস্থানের মরুভূমি ভেসে যাওয়ার উপক্রম। এরকম পরিস্থিতিতে নয়নার শাশুড়ি ভীষণ সাপোর্টিভ একটি মহিলা। অথচ শিশুর জন্মের পর ভারতীয় পরিবারে হিজড়াদের আসার ঘটনাটাও সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। হিজড়ারা দেখেই খবর পাঠায় তাঁদের গুরু চাঁদনির কাছে। গোটা কাহিনি আবর্তিত হয়েছে ওই চাঁদনির জীবন এবং সদ্যোজাত সন্তানটিকে মায়ের কোল থেকে নিয়ে যাওয়া মানুষ করাকে কেন্দ্র করে। এই কাহিনিতে দেখানো হয়েছে চাঁদনি এবং নয়না দুই মানুষের ভিতর পারস্পরিক গভীর মর্যাদা বোধ। মেয়েটির নাম রাখা হয় দেবী। দেবী বড় হয়ে কীভাবে এক দুর্দান্ত মহিলা উদ্যোগপতি হয়ে উঠলেন সেই কাহিনি সুন্দরভাবে বর্ণনা করা আছে এই উপন্যাসে।

পূজার মুখে গোটা গল্পটা শুনেছিলাম। তারপর পড়ি। ভীষণ প্রেরণা জাগানো কাহিনি। পরে যোগাযোগও হয়েছে কোমলের সঙ্গে। জানলাম কোমলের কাহিনি। সাধারণ ঘরের মেয়ে কোমল। রাজকীয় আহুজা পরিবারে বিয়ে হয়। তার আগে সামাজিক বিভিন্ন কাজে নিজেকে লিপ্ত রাখতেন কোমল। বিয়ের পরও সে কাজ ছাড়েননি। তাঁদের বড় হাবেলির লাগোয়া একটি বস্তিতে এখনও সকালে একটি স্কুল চালান। দুপুরে অফিসের কাজ করেন। আহুজা গ্রুপের সিওও বলে কথা। কর্পোরেট মিটিং থেকে শুরু করে ব্যবসার খুঁটিনাটি সবই কোমলের নখদর্পণে। পাশাপাশি ঘর সামলান। পরিবারে কে কখন কী ওষুধ খান, কার কোন খাবার পছন্দের সেটা তৈরি হচ্ছে কিনা। সব দিকেই নজর দেন কোমল। আর রাতে ঘুমোতে যাওয়ার কিছু আগে ল্যাপটপ খুলে বসেন তাঁর লেখালেখির কাজ করতে। মানুষের ভিতর জমে থাকা অনেক ভুল ধারণা কাটানোর চেষ্টা করেন তাঁর লেখায়।

পূজার প্রশ্ন, ‘সমাজ নামের বাস্তুতন্ত্রে ওঁরা-আমরার প্রভেদ ঘোচানো হয়ত সম্ভব নয়। তবু পর্দার একপাড় থেকে অপর পাড়ের প্রতি সহমর্মী হওয়াও কি সম্ভব নয়?’ তাঁর লেখায় উত্তর দিয়েছেন জয়পুরের গৃহবধূ কোমল আহুজা।