এলজিবিটি আন্দোলন কী নারী অধিকার আন্দোলনের থেকে এগিয়ে?

এলজিবিটি আন্দোলন কী নারী অধিকার আন্দোলনের থেকে এগিয়ে?

Tuesday January 05, 2016,

4 min Read

“নারী অধিকারের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে সমকামী অধিকার”, মাস কয়েক আগে এমনই মন্তব্য করেছেন এলজিবিটি আইকন ও বিশ্বখ্যাত গায়িকা ম্যাডোনা। অতি-সরলীকরণ ও রাজনৈতিকভাবে ভ্রান্ত হলেও এই মন্তব্যের মধ্যে কিছুটা হলেও সত্যতা রয়েছে।

image


কয়েক দশক আগের কথা ভাবুন, সারা বিশ্বে সমাজের একদম প্রান্তিক অবস্থানে ছিলেন এলজিবিটি গোষ্ঠীর মানুষরা। বিকৃতি, অসুস্থতা ইত্যাদি নাম দিয়ে মূলস্রোত থেকে তাঁদের দূরে রাখতেই অভ্যস্ত ছিল সমাজ। স্বাভাবিকভাবেই পুঞ্জীভূত হচ্ছিল ক্ষোভ, ঘৃণা, রুখে দাঁড়ানোর আকাঙ্ক্ষা এবং তারই ফলশ্রুতি ১৯৬৯ এর স্টোনওয়াল দাঙ্গা। আধুনিক সমকামী অধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত এই দাঙ্গা। আজও এই আন্দোলনের বার্ষিকীতে সারা পৃথিবী জুড়ে হয় গে প্রাইড মার্চ। দীর্ঘদিনের এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এলজিবিটি গোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক আত্মীয়তা।

এমন কী জাতীয় নীতি নির্ধারণ স্তরেও প্রভাব ফেলতে সক্ষম হচ্ছে এই আন্দোলন। আয়ারল্যান্ডের মত গোঁড়া রোমান ক্যাথলিক দেশও সম লিঙ্গ বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সম লিঙ্গ বিবাহকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় নেদারল্যান্ড এবং তাও মাত্র দেড় দশক আগে ২০০১ সালে। আজ পর্যন্ত মাত্র ১৪টি দেশ সম লিঙ্গ বিবাহকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং আয়ারল্যান্ড এদের মধ্যে একটি। আবার এই আয়ারল্যান্ডই গর্ভপাতকে নিষিদ্ধ করেছে। সেদেশের সংবিধান অনুযায়ী, গর্ভপাত তখনই করা যাবে যেখানে গর্ভবতীর জীবন আশঙ্কা রয়েছে, এবং এটি যে কতটা ভয়ানক যুক্তি তা আমরা দেখতে পাই সবিতা হলপ্পানাভরের মৃত্যুতে। গর্ভপাতের অনুমতি না পাওয়াতেই মৃত্যু হয়েছিল এই তরুণীর।

এমন কোন একটি নির্দিষ্ট ঘটনা বোধহয় নেই যা সারা বিশ্বে একটি সুসংহত নারী আন্দোলন গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছে। বৈষম্য বা নারীদের ওপর চলা অত্যাচারের নেপথ্যে প্রায়শই দেখা যায় তাঁর বাবা, ভাই, স্বামী বা ছেলেকে।

নারীদের সমস্যা তা শিক্ষার অধিকার, পণ, সম্মান রক্ষার্থে খুন, ধর্ষণ বা অন্য যৌন হেনস্থা যাই হোক প্রতিটি ঘটনাকে আলাদা করে দেখার একটা প্রবণতা দেখা যায়। কাজ হয় এক একটি ঘটনাকে ধরে।

সমাজ একভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে মেয়েদের, যেখানে তারা নির্দিষ্টভাবে চলবে, এমন কিছু করবে না যাতে ‘পরিবারের সম্মান’ নষ্ট হয়। মেয়েরাও অভ্যস্ত হয়ে পড়ে চুপ থাকতে, চেপে রাখতে যতক্ষণ না পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়।

আমাদের দেশে,এলজিবিটি অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলি কী নারী সংগঠনগুলির থেকে বেশি সক্রিয়? সাম্প্রতিককালে কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের ৩৭৭ ধারাকে খারিজ করে সমকামিতাকে আইনি বৈধতা দেওয়ার যে উদ্যোগ নেন তা এলজিবিটি আন্দোলনের জন্য নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

“বিষয়টা এতটা সহজ নয়”, বললেন ড. অ্যাঞ্জেলা চৌধুরি. ড. চৌধুরি, স্বস্তি নামক এক এনজিও-এর কর্মী। তিনি বললেন, “এই দু’টি গোষ্ঠীরই বহু ধরণের সমস্যা রয়েছে, এবং তার সমাধানের জন্য প্রয়োজন আইনি ও নীতি স্তরীয় সহায়তা। তাঁর মতে, প্রাইড মার্চের মত ইভেন্টগুলো সমকামীদের অনেকটাই দৃশ্যমান করলেও তাদের বাস্তবতা পরিবর্তন করেনি। বরঞ্চ অধিকার ও বৈষম্যের প্রশ্নে মহিলাদের আইনি নিরাপত্তা অনেক বেশি। যেমন- ভারতে একজন অবিবাহিত মহিলা শিশু দত্তক নিতে পারেন কিন্তু সমকামী যুগলের সেই অধিকার নেই। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দীর্ঘদিনের লিভ-ইন সম্পর্কেও সুরক্ষিত হয়েছে মহিলাদের অধিকার। এই রায় অনুযায়ী দীর্ঘদিনের লিভ-ইন সম্পর্কে থাকা একজন মহিলা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট ২০০৫ এর সুবিধা নিতে পারেন, যা তার খোরপোষের অধিকারকে সুরক্ষিত করে। অন্যান্য অনেক দেশে সমকামীদের এইধরনের অধিকার থাকলেও আমাদের দেশে তা একেবারেই অনুপস্থিত।

একটা জিনিস পরিষ্কার, নারী অধিকার বা সমকামী অধিকার দুটি ক্ষেত্রে কাজ করা সংগঠনগুলি তৃণমূল স্তরে প্রচুর কাজ করছে, প্রয়োজন ম্যাক্রো স্তরে সেগুলির সংহতিকরণ। মহিলাদের ভোটাধিকার যা এখন খুবই স্বাভাবিক ও সাধারণ তাও কিন্তু অর্জিত হয়েছে দীর্ঘদিনের লড়াই আন্দোলনের মাধ্যমে। ইউএসএতে মহিলাদের ভোটাধিকার সুরক্ষিত হয় ১৯১৯এ, সুইজারল্যান্ডে মহিলারা ভোট দেওয়ার অধিকার পেয়েছেন ৫০ বছরও হয়নি, ১৯৭১ এ সেখানে মহিলারা ভোটাধিকার পান।

১৯৭৫ এর ২৪ অক্টোবর আইসল্যান্ডের মহিলারা একদিনের জন্য ধর্মঘট করেন, তাঁরা ঘোষণা করেন ওইদিন কোনও কাজ বা ঘরের দায়িত্ব পালন করবেন না তাঁরা। একদিনের জন্য গোটা দেশ থমকে যায়, নিথর হয়ে যায়। সেই সময় তিনজন মাত্র মহিলা সাংসদ ছিলেন সে দেশে, যা সম্পূর্ণ সংসদের পাঁচ শতাংশ। একটি মহিলাদের দল প্রথম এই ধর্মঘটের প্রস্তাব দেয়, নাম দেয় ‘উইমেনস ডে অফ’। নারী অধিকার আন্দোলনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই ধর্মঘট। বর্তমানে সেই দেশে ৬৩ জন সাংসদের মধ্যে ২৮জন মহিলা (৪৪%)। আজ নাগরিকদের জীবনের মানের দিক থেকে সবথেকে এগিয়ে থাকা দেশ এই আইসল্যান্ড। যদি তারা পারে তাহলে অন্যরাও পারবে ঠিকই।

লেখা-শাকিরা নায়ার

অনুবাদ-সানন্দা দাশগুপ্ত