নতুন আলোর সন্ধানে ঊর্মি বাসুর নিউ লাইট
Monday September 28, 2015,
5 min Read
১১ বছর বয়েসে কলকাতার কালীঘাট এলাকা থেকে উদ্ধার হয় মীনা (নাম পরিবর্তিত)। মীনার বাড়ি উত্তর ২৪ পরগণার এক গ্রামে। গ্রামেরই এক পরিচিত মহিলা নানা লোভ দেখিয়ে বিহারে নিয়ে যায় মীনাকে, পাচারচক্রে জড়িত সেই মহিলা বিহারে কিছু লোকের হাতে তাকে তুলে দেয়। চলে যৌন হেনস্থা, তারপর বিভিন্ন বিয়ে বাড়িতে পূর্ণবয়স্কদের মত নাচতে বাধ্য করা হয় মীনাকে। দ্রুত শারীরিক বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত হরমোন ইঞ্জেকশনও দেওয়া হত তাকে। কোনওক্রমে সেখান থেকে পালিয়ে কালীঘাট চলে আসে মীনা, সেখান থেকে আসে নিউ লাইট-এর হোমে। অনেকগুলি বছর কেটে গেছে, এবছর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করল মীনা, তবে ক্ষত এতটাই গভীর যে এখনও পুরোটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই তরুণী। দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং চালিয়ে গেছেন নিউ লাইটের কাউন্সেলররা। এখন নিউ লাইটের সহায়তায়ই বৃত্তিমূলক ট্রেনিং নিচ্ছে মীনা।
হেমা (নাম পরিবর্তিত), নিউ লাইটের সোনার তরী হোমের আরেক বাসিন্দা। ১০ বছর বয়েসে কলকাতার কুখ্যাত নিষিদ্ধপল্লী সোনাগাছি থেকে উদ্ধার হয় হেমা। হেমাকে যৌন ব্যবসায় নামতে বাধ্য করে তার পালিকা মা। ১৮ বছর বয়েস পর্যন্ত সরকারি হোমে থাকত হেমা, তারপর আদালতের নির্দেশে মুক্তি পেয়ে সোনার তরীতে আসে সে। আপাতত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে হেমা। গুরুর কাছে নাচ শিখছে, ভবিষ্যতে নাচকেই নিজের পেশা করতে চায় সে।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে প্রতি আট মিনিটে একটি করে শিশু নিরুদ্দেশ হয়। ২০১১ সালে প্রায় ৩৫,০০০ শিশু নিরুদ্দেশের ঘটনা রিপোর্ট হয়েছে, এর মধ্যে ১১,০০০ পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা।
মনে করা হয় মোট যত ঘটনা ঘটে তার মাত্র ৭০ শতাংশই কোথাও রিপোর্ট হয় না, তাই আসল সংখ্যাটা অজানাই থেকে যায়। পাচার হওয়া নারী ও শিশুদের ৮০ শতাংশকে কাজে লাগানো হয় যৌন ব্যবসায়, চলে নানা শারীরিক, মানসিক ও যৌন অত্যাচার। তাই অনেক সময়ই উদ্ধারের পরও সুস্থ জীবনে ফেরাটা সহজ হয়না, অমানবিক জীবনের স্মৃতি, সামাজিক ছুৎমার্গ বাধা হয়ে দাঁড়ায় সুস্থ জীবনে ফেরার পথে। প্রয়োজন হয় সাহায্য, সহযোগিতা, ভালবাসা ও যত্ন। নারী ও শিশু পাচার, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ও সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া সংগঠিত অপরাধ।
আর্তের জীবনে নতুন আলো
মীনা, হেমা এবং ওদের মতোই আরও অনেক ছেলেমেয়ের জীবনে আক্ষরিক অর্থেই নতুন আলো পৌঁছে দিচ্ছে নিউ লাইট। ২০০০ সালে কলকাতায় সংস্থাটি তৈরি করেন ঊর্মি বাসু। টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্স থেকে অপরাধতত্ত্ব ও সংশোধনীয় প্রশাসন নিয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা ঊর্মির। ১৯৮৪ তে ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির দুর্গতদের কাছে ত্রাণ পৌঁছনোর কাজ করেন ঊর্মি, মুম্বই পুলিসের পীড়িত মহিলাদের সেলেও কাজ করেন বেশ কিছুদিন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা গভীরভাবে ভাবিয়েছিল ঊর্মিকে। ১৫ বছর উন্নয়ন ক্ষেত্রের নানা ছোট বড় সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেছেন ঊর্মি।
এছাড়াও ঊর্মির বড় হওয়ার মধ্যেও লুকিয়েছিল সমাজের জন্য কিছু করার তাগিদ। ঊর্মির দাদু নিজের বাড়িতে দলিত শিশুদের জন্য স্কুল চালাতেন। ঊর্মির কথায়, তাঁর পরিবার সবসময়ই পরম্পরাকে চ্যালেঞ্জ করে এসেছে।
কালীঘাটের নিষিদ্ধপল্লীর রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতেই যেন জীবন বদলে গিয়েছিল ঊর্মির। কালীঘাটের কৃষ্ণা মণ্ডল ও শিব নারায়ণ ভট্টাচার্যকে সঙ্গী করে ১০,০০০ টাকা নিয়ে, সাফল্যের কোনও ব্লু-প্রিন্ট ছাড়াই নিউ লাইট শুরু ঊর্মির।
শহর ও গ্রামের আর্থিক উন্নয়ন এবং পাচার হওয়া শিশু শ্রমিক, পথ শিশু, নির্যাতিত কিশোর-কিশোরী, যৌনকর্মী, হিংসার শিকার মহিলা ইত্যাদি বিভিন্ন অংশের মানুষকে সুরক্ষা প্রদান ও তাদের ক্ষমতাবৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে নিউ লাইট।
নিরাপদ আশ্রয়
নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবন শিশুর মৌলিক অধিকার. কিন্তু পাচার বা আরও অন্যান্য অপরাধের মূল শিকার তারাই. তাই প্রথম থেকেই শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন ঊর্মি। নিষিদ্ধপল্লীতে মায়েদের সন্ধ্যে বা অনেক সময়ই সারারাত কাজ করতে হয়, সেই সময় তাঁদের শিশুরা পড়ে থাকে অযত্নে। “এইসব শিশুদের একটি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সান্ধ্য ক্রেশ শুরু করি আমরা. এখন নিউ লাউটের অন্যান্য প্রকল্পের শিশুদেরও এই সুবিধা দেওয়া হয়, যাতে সব শিশুরাই পায় একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত আশ্রয়। এখন নিউ লাইট দুটি মেয়েদের ও একটি ছেলেদের হোম চালায়,” বললেন ঊর্মি।
সমর্থন নয় যৌন ব্যবসাকে আইনসিদ্ধ করার দাবি
ঊর্মি যোগ করলেন, “আমাদের শহরে প্রতি বছর প্রায় ৪০,০০০ নতুন পাচার হওয়া যৌনকর্মী যুক্ত হন। শিশু, মহিলা, পাচারে উদ্ধার মানুষ, এইচআইভি এইডস্ রোগী, এদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় তৈরি। কাজটা সহজ নয়। খুবই স্বল্প সংস্থান ও পরিকাঠামো নিয়ে এই কাজটাই করে চলেছে আমাদের নিউলাইটের টিম”।
যৌন হেনস্থা ও হিংসার ক্ষততে প্রলেপ দিয়ে শিক্ষা ও জীবন শৈলী সম্পর্কে তাঁদের দক্ষ করে তুলে লিঙ্গবৈষম্য দূর করাই লক্ষ্য নিউ লাইটের। “আমরা যৌন ব্যবসাকে আইনসিদ্ধ করার পক্ষে নই, অভিজ্ঞতা বলছে যৌনকর্মীদের বেশিরভাগই বাধ্য হয়ে এই ব্যবসায় যুক্ত হন, তাঁরা পরিস্থিতির শিকার, সুযোগ পেলে অন্য জীবন বেছে নিতেন তাঁরা,” জানালেন ঊর্মি।
যৌনপল্লীর মতো প্রান্তিক এলাকায় প্রায়শই পৌঁছয় না সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা। গত ১৪ বছর ধরে যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে আসছে নিউ লাইট। এরমধ্যে রয়েছে আপতকালীন চিকিৎসা, টিকাকরণ, জীবনধারণের পদ্ধতির ফলে হওয়া রোগের চিকিত্সা ইত্যাদি। যৌনকর্মীদের পাশাপাশি তাঁদের সন্তান এমন কি নিষিদ্ধপল্লীর বাইরে থাকা মানুষদেরও এই পরিষেবা দিয়ে থাকে নিউ লাইট। শহরের দু’টি জায়গার ক্লিনিকে সপ্তাহে পাঁচ দিন এই পরিষেবা দেন জেনারেল প্র্যাকটিশনার, পেডিয়াট্রিশিয়ান ও গাইনোকোলজিস্ট। যৌনকর্মী ও তাঁদের শিশুদের আপতকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য ২৪ ঘন্টা কাজ করেন ছ’জন স্বাস্থ্যকর্মী, একজন পূর্ণ সময়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত নার্স ও একজন সহযোগী নার্স।
বিকল্প জীবিকার সংস্থান
ঊর্মির মতে, জীবনে কোনও উদ্দেশ্য না থাকলে সুস্বাস্থ্য কোনও কাজের নয়, তাই উদ্ধার হওয়া মহিলাদের জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে দিতেও উদ্যোগী নিউ লাইট। প্রকল্পের নাম ‘আঁচল’। যৌন ব্যবসা থেকে বেরিয়ে এসেছেন বা বেরোতে প্রস্তুত মহিলা ও দলিত সম্প্রদায়ের মহিলাদের কাঁথা স্টিচের কাজের ট্রেনিং দেওয়া হয় এই প্রকল্পে। পুরোনো শাড়ি, ধুতি, সুতির কাপড় থেকে তৈরি হয় নানা পণ্য, ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিস। এইভাবেই একটি বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় তাঁদের।
এপর্যন্ত ৪০ এরও বেশি পাচার হওয়া বা যৌন অত্যাচারের শিকার মহিলা ও শিশুকে উদ্ধার করেছে ঊর্মি বাসুর নিউ লাইট।