৪-০-তে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলের জয়কে আপনি কীভাবে বর্ণনা করবেন? বিরাটের দলটি সর্বকালের সেরা ভারতীয় দল? নাকি বিরাট সর্বকালের সেরা ভারতীয় ক্যাপ্টেন? নাকি বলবেন এবার ভারতীয় ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের সূচনা হতে চলেছে? ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৭০ কিংবা ৮০ দশকে বিশ্ব ক্রিকেটকে যেভাবে শাসন করেছিল, ভারতও কি এবার সেই কৃেতিত্বের অধিকারী হবে? গত এক সপ্তাহ ধরে আমি নিজে্কে নিজেই এই প্রশ্নগুলিই করেছি। আমার এ কথা বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে, এই দলটিই ভারতের সব থেকে সেরা দল। ১৯৮৩ সালে কপিলের নেতৃত্বে যে দলটি বিশ্বকাপ জয় করেছি্ল দল হিসাবে এটা তার চেয়ে ভালোই। এটা ধোনির দলের চেয়েও বড় – যাঁরা কিনা দুবার বিশ্বকাপ জয়ী হয়ে্ছে। এমনকি সৌরভের নেতৃত্বাধীন দলটি - যেখানে খেলেছেন সচিন, দ্রাবিড়, শেহবাগ, লক্ষ্ণণ, কুম্বলে কিংবা ভাজ্জির মতো শীর্ষস্থানীয়েরা তার চেয়েও ভাল দল এটি। আমি জানি, এ ব্যাপারে সমালোচকরা আমার সঙ্গে একমত হবেন না। ওঁরা বলবেন, আমি বিরাটের দলের গুণপনাকে বাড়িয়ে বলছি। কিন্তু বাস্তব একটি অন্য গল্প বলছে।
আমি নিজের জায়গাতে স্থির আছি। খুব ছেলেবেলা থেকেই আমি ক্রিকেট দেখে আসছি। সেটা এমন একটা সময় ছিল ভারতীয় দল যখন খেলত পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে। সেই সময়টা ছিল শুদ্ধভাবে টেস্ট ক্রিকেটের। ওয়ান ডে ক্রিকেটের যুগ তখনও শুরু হয়নি। পরে রঙিন জামাকাপড়় পরে ওয়ান ডে দেখতে যাওয়ার যুগ শুরু হল। টি টুয়েন্টি তখন ছিল অভাবনীয়। অনেক ক্রিকেটার মাঠে নিজে্দের প্রতিভার যথেষ্ট পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও ক্রিকেট তখনও যথেষ্ট অ্যাথলেটিক হিসাবে পরিচিতি লাভ করতে পারেনি। আজকের মতো হেলমেটটা সেকালে ফ্যাশান হয়ে উঠেনি। লাইভ টিভিও আজকের মতো এভাবে ঢুকে পড়েনি আমাদের জীবনের ক্ষেত্রে। রেডিও ভাষ্যই ছিল ক্রিকেট শোনার একমাত্র মাধ্যম। আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম, কখন ভাষ্যকার হিসাবে সুশীল দোশী কিংবা নরোত্তম পুরীর গলা শুনতে পাব।
৭০ দশকে ভারত তার স্পিনারদের জন্যে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। চন্দ্রশেখর, বেদি, প্রসন্ন ও ভেঙ্কটারাঘবন প্রতিপক্ষের কাছে্ সন্ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন। ভারতীয় পিচে বিশ্বে্র সেরা ব্যাটসম্যানরাও ওঁদের সামলাতে ভয় পেতেন। সুনীল গাভাসকার ও গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ রাওয়ের মতো বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান ছিল ভারতের। কয়েকজন জিনিয়াস স্পিনার এবং এই দুজন ব্যাটসম্যান থাকায় ভারতীয় দলের ভয় পাওয়ার মতো কিছু ছিল না। তবে বাইরের দেশে খেলতে গিয়ে আমাদের হার ছিল প্রায় অবধারিত। দেশের মাঠেও ম্যাচ জিততে আমাদের রীতিমতো লড়তে হয়েছে। আমরা তখন জেতার জন্যে খেলতে নামতাম না। আমাদের লক্ষ্য ছিল পরাজয় রোখা কিংবা ফলাফলটা ড্র করা।
কপিল আসার পরেপরেই স্পিনারদের যুগটা শেষ হয়। তরুণ প্রজন্মের প্রায় সকলেই কপিলকে অনুসরণ করতেন। ওঁর মতো হতে চাইতেন। স্পিন বোলিংয়ের জমানা ফুরিয়ে গেলেও স্পেস বোলিং তখনও সেই জায়গাটা নিতে পারেনি। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কিংবা অস্ট্রেলিয়ার লিলি কিংবা থমসনের মতো স্পেস বোলারও ভারতের ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে মহম্মদ নাসিরই সম্ভবত নামকরা ফাস্ট বোলার ছিলেন। গাভাসকার অবসর নেওয়ার পরে সচিন এলেন। সৌরভই ভারতীয় ক্রিকেট দলকে প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন করে তোলার প্রয়োজন বোধ করেন।
সৌরভ নিজে বেশ ভালো ব্যাটসম্যান ছিলেন। পূর্ববর্তী অনেকের চেয়ে ভালো ক্যাপ্টেনও ছিলেন সৌরভ। সৌরভ মারমুখী। জেতার জন্যে খেলতে নামতেন তিনি। তবে সৌরভের কপালটা ভালো ছিল বলেই হয়তো তাঁর দলে সেরা ব্যাটসম্যানরা ছিলেন। যদি শেহবাগ ওপেনার হিসাবে নামতেন, সেক্ষেত্রে রাহুল দ্রাবিড় নামতেন তিন নম্বরে। অনিল কুম্বলে, হরভজন ছিলেন বিশ্বমানের স্পিনার। যে কোনও ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়ার মতন ক্ষমতাধরও ছিলেন। পরে জাহির খানও তাঁদের মতোই নির্ভরযোগ্যভাবে খেলতেন। আর ছিলেন শ্রীনাথ। এই দলটা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারত বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে সেরা দল হিসাবে চিহ্নিত স্টিভ ওয়াগ কিংবা রিকি পন্টিংয়ের টিমকে। কিন্তু সৌরভের দলে বলবার মতো তেমন কোনও অল রাউন্ডার ছিলেন না, যাঁরা একটা সামঞ্জস্য তৈরি করতে সক্ষমতা পরিচয় দিতে পারতেন।
মহেন্দ্র সিং ধোনি দলকে আলাদা মাত্রা দিতে সমর্থ হতে পেরেছেন। এই সময়েই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট টিমের অবস্থা তুলনায় খারাপ হতে থাকে। ধোনি হলেন বলবার মতো একজন ক্যাপ্টেন – যিনি নিজে থেকে এগিয়ে নেতৃত্ব দিতে পারেন। ওঁকে বলা হয়ে থাকে, ঠাণ্ডা মাথার ক্যাপ্টেন। টি টুয়েন্টি আর আইপিএল এখন এই সময়ের ধারা। ধোনি প্রথমে টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপে জয়লাভ করেছেন। পরে ওয়ান ডে বিশ্বকাপেও জয়লাভ করেন। কিন্ত ক্ষমা চেয়ে নিয়েই বলছি, ভারতের বোলিংয়ের মান এখনও বিশ্বমানের নয়। বলবার মতো অল রাউন্ডারও নেই। তাছাড়া বিকল্প হিসাবে সম্ভাবনাও তেমন কিছু নেই।
ধোনির মতো বিরাটও অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। ও-ও এগিয়ে এসে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাছাড়া, চ্যালে্ঞ্জ গ্রহণ করতেও সর্বদাই প্রস্তত। তাছাডা, অনেকটা সৌরভের মতো ও-ও নিজে্কে প্রকাশ করতে পারে্ স্পষ্টভাবে। তবে্ ধোনি বা সৌরভের চেয়ে ব্যাটসম্যান হিসাবে ও-ও অনেক শক্তিশালী। বিরাটই একমাত্র ভারতীয় ক্যাপ্টে্ন যে কিনা এক বছরের ভিতর তিন-তিনটে ডবল সেঞ্চুরি করেছে। কোনও কোনও পরিস্থিতিতে সচিনের চেয়েও তুলনায় ভালো বিরাট। সচিন ক্যাপ্টেন হিসাবে কাজ করাটা উপভোগ করতেন না। ওটা সচিনের দুর্বলতা ছিল। তবে বিরাট সেটাও পারেন।
সৌরভের দলে যে নামজাদা খেলোয়াররা ছিলেন, তাঁদের সমতুল্য খেলোয়াড় রয়েছেন বিরাটের দলে। বিরাটকে যদি সচিনের সমতুল্য হিসাবে ধরা যায়, তাহলে পূজারাকে তুলনা করা যেতে পারে রাহুলের সঙ্গে। রাহুলের মতো রানের খিদে ওঁরও। অন্যদিকে, লক্ষ্ণণ বেরিয়ে যাওয়ার পরে যে শূন্যতা দেখা দিয়েছিল, রাহানে সেটিকে ভরাট করেছেন। বিজয়, শিখর ধাওয়ান এবং কে এল রাহুলের সঙ্গে অনায়াসে তুলনা টানা যায় ওপেনিং জুটি হিসাবে শেহবাগ ও গৌতম গম্ভীরের। কুম্বলে ও হরভজন বোলার হিসাবে যত ম্যাচ জিতিয়েছেন তার চেয়ে বেশি ম্যাচ অশ্বিন ও জাডেজা একত্রে জিতিয়ে দিয়েছেন। পে্স অ্যাটাকের ক্ষেত্রে উমেশ যাদব, শামি, ইশান্ত শর্মা, ভুবনেশ্বর কুমার উল্লেখ করার মতো নাম। ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার গতিবেগে বল করতে পারেন ওঁরা।
বিরাটের দলকে এপর্যন্ত ভারতের সেরা অ্যাথলেটিক দল বলা যেতে পারে। ফিল্ডিংয়েও সেরা। এছাড়া এদেশে আর কারও নাম তো আমি মনে করতে পারছি না। অন্য দুটি ক্ষেত্রে দুটি দলই কিন্তু সেই হিসাবে খেলোয়াড়ের অভাবে বেশ ভুগেছে।
অশ্বিন ও জাডেজার মতো দুজন বিশ্বমানের অল রাউন্ডার পেয়েছেন বিরাট। তাছাড়া, ওঁরা দুজনে বোলার হিসাবেও বিশ্বমানের। নতুন বোলার হিসাবে দারুণ বলতে হবে জয়ন্ত যাদবকেও। এসবই ভারতের ব্যাটিংয়ে শক্তপোক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছে। ভারতে্র এখন ৯জন এমন ব্যাটসম্যান রয়েছেন – যাঁরা শতরান করে ফেলতে পারেন। এর আগে ভারতীয় দল কখনও এতটা সমৃদ্ধশালী ছিল না। বিশ্ব ক্রিকেটের সঙ্গে তুলনা করলেও এটা এক বিরল উদাহরণ।
তবে সবথেকে বড় প্লাস পয়েন্ট হল এর বেঞ্চ স্ট্রেনথ। প্রতিটি ক্ষেত্রে দু থেকে তিনজন করে বিকল্প থেলোয়াড় রয়েছেন। যদি শিখর দেওয়ান জখম হন, তাহলে সেক্ষেত্রে খেলবার মতো রয়েছেন কে এল রাহুল কিংবা পার্থিব প্যাটেল। রাহানা যদি খেলতে না পারেন, সেক্ষেত্রে খেলানো যেতে পারে করুণ নায়ারকে। আবার যদি বৃন্দাবন সাহা ফিট না থাকেন, তাহলে ব্যাটিংটা সামলে দেবেন পার্থিব। এছাডা, সমমানের পাঁচ-পাঁচজন ফাস্ট বোলার রয়েছেন। অশ্বিন ও জাডেজার সঙ্গে রয়েছেন জয়ন্ত যাদব, অমিত মিশ্র। অশ্বিন ও জাডেজা তো বিশ্বমানের খ্যাতিসম্পন্ন বোলার।
আর একটা কথা বলবার, ৪-০-তে এর আগে কোন ভারতীয় দল ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে। জয়ের মার্জিনটাও অনেকটা। ইংল্যান্ড দলটিকে যতটা গরিব মনে করা হচ্ছে – আসলে তো ওঁরা ততটা গরিবও নয়। ওঁদের অনেক ভালো খেলোয়াড় রয়েছেন। পাশাপাশি, এও মনে রাখবেন, দলের কয়েকজন খেলোয়াড় জখম থাকার জন্যে বিরাটের দলও তার ক্ষমতা পূর্ণমাত্রায় দেখাতে পারেনি। নতুন খেলোয়াড়দের নিয়ে বিরাটের দল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। সিনিয়রদের থেকে ইতিমধ্যে সকলেই ভালো ফল করেছে। এটাই এই দলটির শক্তি। তাই আসুন বিরাটের সতীর্থদের সেলাম জানাই। ওঁদের জয় চিরস্থায়ী হোক।