লোকাল খাবারের স্বাদ দিতে হাজির নিতেশের অ্যাপেতি

লোকাল খাবারের স্বাদ দিতে হাজির নিতেশের অ্যাপেতি

Friday January 08, 2016,

5 min Read

দেশে বসে বিদেশী খাবারের স্বাদ যেমন বেশ ভালো লাগে, তেমনি যারা বাইরে কোথাও রয়েছে তারাই বোঝে নিজের এলাকার লোকাল খাবারের কি মহিমা। চাকরি বা পড়াশুনার সূত্রে যারা অন্য শহরে রয়েছে, ছুটি থেকে ফেরার সময় মায়ের পাঠানো খাবার যখন প্রায় শেষ, তখন যেন কোনকিছুই সেই দুঃখ মেটাতে পারেনা। আই.আই.টি কানপুরে পড়াকালীন এই ব্যাপারটাই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল বছর পঁচিশের নিতেশ প্রজাপত। আসলে মুম্বাই বা ব্যাঙ্গালোরে থেকেও কলকাতার রসগোল্লা পাওয়া সম্ভব কিন্তু সেটা কখনোই স্বাদে কলকাতার মতো হবে না। আর নিতেশের এই অনুভূতিটাই তাকে একটা ব্যবসার পরিকল্পনা রুপায়নে সাহায্য করেছে পরবর্তীতে।

image


২০১২ সালে আই.আই.টি কানপুর থেকে পাশ করে নিতেশ হিরো মোটর কর্পে চাকরি শুরু করে। প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টের কাজের জন্য তাকে মাঝে মাঝেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়া আসা করতে হতো। আর এই যাওয়া আসার মাঝেই নিতেশ বিভিন্ন জায়গার লোকাল খাবারের বিষয়ে জানতে শুরু করে। এরপরেই সে ভাবতে শুরু করে যে যারা খুব বেশি ঘোরাঘুরি করেনা তাদের কিভাবে বিভিন্ন জায়গার এই আঞ্চলিক খাবারের স্বাদ দেওয়া সম্ভব। যেমন ভাবা তেমন কাজ, সে তাঁর কাকা নরেন্দ্র প্রজাপতের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করে কারণ তিনিও একজন বেশ খাদ্য রসিক মানুষ আর সাথে ব্যবসায়ী। পরবর্তীতে এই আলোচনা থেকেই গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে জন্ম নেয় অ্যাপেতি।

নিতেশ তখন আই.আই.এম কলকাতায় প্রথম বছরের ছাত্র। আসলে অ্যাপেতি খোলার ইচ্ছাটা প্রবল হতেই সে ম্যানেজমেন্টের কোর্সে ভর্তি হয়ে যায়। কিন্তু আর সবার মতো মোটা মাইনের চাকরি করার ইচ্ছা ওর ছিলনা কারণ ব্যবসার প্রতি একটা অদম্য আগ্রহ ছিল নিতেশের। তাই, সেই একমাত্র ছাত্র ছিল, যে ক্যাম্পাস প্লেসমেন্ট ফর্মে সই না করে শিখতে চেয়েছিল তাঁর স্টার্ট-আপ কে প্রতিষ্ঠিত করার উপায়গুলো, জানতে চেয়েছিল ব্যবসার ওঠানামার বিষয়গুলো, ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে ঠিক যে যে বিষয়গুলো জরুরী, শুধু সেগুলো নিয়েই নাড়াচাড়া করত সে।

image


আসলে অ্যাপেতি হল এমন একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যেখানে বিভিন্ন ধরণের খাঁটি ভারতীয় আঞ্চলিক খাবার এক লহমায় পৌঁছে যাবে আপনার হাতের মুঠোয়। গুজরাতি ফেফ্লা হোক বা আগ্রার পেঁড়া, কলকাতার রসগোল্লা হোক বা পানিপথের পাঁচরঙ্গা আচার, যেকোনো কিছুই হাতের মুঠোয় পাওয়া সম্ভব এখান থেকে। আমাদের সাথে কথা বলার সময় নিতেশ বলছিলেন যে দেশের যেকোনো প্রান্তে ক্রেতার দোরগোড়ায় তাঁর পছন্দমাফিক খাবার পরিবেশন করাই তাদের আসল উদ্দেশ্য। তাদের মতে সারা দেশের বিভিন্ন শহরে প্রায় ২৭ জন বিক্রেতার সাথে তাদের ব্যবসায়িক যোগাযোগ আছে এবং তাঁরা খুব সক্রিয়ভাবে নিজেদের কাজ করে চলেছে। লুধিয়ানা, আগ্রা, আহমেদাবাদ, পুনে, গোয়া বা কলকাতা, আপনি যেখানকার খাবার নিজের ঘরে বসে খেতে চাইবেন, সেটাই এরা পৌঁছে দেবে আপনার হাতে। নিতেশ বলছিলেন যে,

‘খাবারই আমাদের আসল চালিকা শক্তি, তাই এটা আমাদের দায়িত্ব যাতে আমাদের ক্রেতারা ভালো ভালো আঞ্চলিক খাবার খাওয়ার সুযোগ পায় এবং সবথেকে বড় বিষয় হল সেসব খেয়ে যাতে তৃপ্তি পায়’

সাত জন ফ্রিল্যান্সার নিয়ে মোট দশ জনের একটা দল নিয়ে সে এই কাজ শুরু করেছে। অর্ডার সংগ্রহ থেকে শুরু করে ডেলিভারি সবটাই এদের দায়িত্ব। ডেলিভারির বিষয়ে নিতেশ বলছিলেন যেসব খাবার অন্তত দশদিন ঠিকঠাক থাকে, সেরকম খাবারই আপাতত তাঁরা ডেলিভারি করে, যে ক্যুরিয়ার কোম্পানির সাথে তাদের পার্টনারশিপ আছে, তাঁরা সাধারণত ৪ দিনের মধ্যেই ডেলিভারি করে দেয় কিন্তু এই সময়টাকে দুদিনে নামিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করছে তাঁরা। সাথে প্যাকেজিং এর বিষয়েও তাঁরা ভাবনা চিন্তা করছে যাতে আরও ভালোভাবে জিনিস গুলো পৌঁছে দেওয়া যায় ক্রেতার কাছে। নিতেশ বলছিলেন যে তাদের ওয়েবসাইটে এখনও পর্যন্ত প্রায় দুহাজার নতুন ভিজিটর আছে এবং তাদের অ্যাপও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আসতে আসতে। এছাড়াও এখনও পর্যন্ত প্রায় সাতশ জন ক্রেতা আছে এই ফার্মের যারা নিজেদের সাবস্ক্রাইব করেছেন তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে।

image


গত দিওয়ালী থেকেই আসলে এরা ঠিকঠাক কাজ শুরু করেছে আর ইতিমধ্যেই প্রায় সাতশ অর্ডার সাপ্লাই করেছে তাঁরা। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এটা পুরোটাই সম্ভব হয়েছে কোনরকম মার্কেটিং ছাড়াই। গড়ে যদি ৬০০ টাকার অর্ডার পাওয়া যায় তাহলে মোটামুটি ১০-১৫% লাভ থাকে প্রত্যেক অর্ডারে কিন্তু লাভের ব্যাপারটা আসলে পুরোটাই নির্ভর করে অর্ডার সাইজের ওপর। যদি পাঁচশো টাকার কম অর্ডার থাকে তাহলে লাভের পরিমাণটা বাড়ে কারণ সেক্ষেত্রে শিপিং খরচ পুরোটাই ক্রেতাকে বহন করতে হয়। এছাড়াও পার্টনার বিক্রেতারা সাধারণত অ্যাপেতি কে ৪০-৪৫% ডিসকাউন্ট দিয়ে থাকে বিভিন্ন খাবারের ওপর। এখনও পর্যন্ত প্রায় আশি হাজার টাকার মতো লাভ করতে পেরেছে তাঁরা আর এই অঙ্কটা আরও বাড়বে সে বিষয়ে বেশ কনফিডেন্ট নিতেশ। আসলে প্রাথমিক বিনিয়োগের প্রায় পুরোটাই প্যাকেজিং আর টেকনোলজির মতো খাতে খরচ হয়ে গেছে।

আগামী দিনে আরও কিছু লক্ষ্য রয়েছে ওদের নিজেদের আরও প্রসারিত করার জন্য। ৬ মাসের মধ্যে আরও ত্রিশটা শহরে পৌঁছে যাওয়ার সাথে সাথে টীম সাইজও বাড়ানোর বিষয়ে ভাবছে তাঁরা। নতুন নতুন প্রোডাক্ট নিজেদের প্ল্যাটফর্মে যোগ করতে হবে। এছাড়াও দেশের বাইরে লন্ডন, নিউ ইয়র্কের মতো শহরের সাথেও ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের ভাবনা চিন্তা রয়েছে তাদের। এছাড়া প্রত্যেক শহরের প্রথম পাঁচ বিক্রেতা তাদের নিজেদের পছন্দমাফিক পেজ তৈরি করতে পারবে এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। টায়ার – ২ এবং টায়ার – ৩ শহরগুলোতে ঘরের মেয়ে বউরা যাতে স্বনির্ভর হতে পারে সেই কারণে তাদের তৈরি বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার আরও বেশি সংখ্যক ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে তাঁরা।

image


নিতেশকে এই পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের জন্য ইওর স্টোরি জানায় অনেক অভিনন্দন কিন্তু এই সময়টা আসলে ফুড টেক স্টার্ট আপের জন্য খুব কঠিন সময়। অনেক বড় স্টার্ট-আপ যেমন বন্ধ করে দিয়েছে তাদের ব্যবসা তেমনি টিনি আউলের মতো ফার্ম তাদের ব্যবসার সীমা ছোট করে শুধু মুম্বাই আর ব্যাঙ্গালরে তাদের আউটলেট রেখেছে। আসলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা সীমাবদ্ধতা এসে গেছে এই ইন্ডাস্ট্রিতে। ইওর স্টোরির নিজস্ব রিসার্চ দেখাচ্ছে যে গত বছর এপ্রিল মাসে ৭ টা ডিলের মাধ্যমে বিনিয়োগ হয়েছিল প্রায় ৭৪ মিলিয়ন ডলার, আগস্ট মাসে সেটা নেমে আসে ১৯ মিলিয়ন ডলারে এবং এরপর ক্রমাগত বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে। কিন্তু অ্যাপেতির জন্য ভালো খবর যেটা সেটা হল এরা প্রথম কয়েক মাসের অপারেশন চালানোর পর লাভের মুখ দেখতে পেয়েছে। আসলে সঠিক ক্রেতা পাওয়া এবং তাদের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রাখাটাই হল বড় চ্যালেঞ্জ। ইন্ডিয়া কোশেন্টের প্রতিষ্ঠাতা আনন্দ লুনিয়ার মতে যদি এক দশক ধরে সাফল্যের সাথে এই ব্যবসা করা যায় তবেই পুরো ছবিটা পালটানো সম্ভব আর সেটার জন্য চাই ঠিকঠাক আবেগ আর ধৈর্য।

( লেখা - তরুশ ভাল্লা, অনুবাদ - নভজিত গাঙ্গুলী )