দেশের শিক্ষার হাল বদলে দিতে মরিয়া রাখী

দেশের শিক্ষার হাল বদলে দিতে মরিয়া রাখী

Tuesday December 08, 2015,

4 min Read

অঙ্কের প্রতি দুর্বলতাটা সব কিছুর পরও কাটিয়ে উঠেত পারেননি রাখী। আগ্রার আশপাশে বিভিন্ন স্নাতক, ইঞ্জিনিয়ারিং ও এমবিএ কোর্সে অঙ্ক ও কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ানো শুরু করেন রাখী চাওলা। 

প্রথম জীবনে সফটঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, পরে মা এবং তারও পরে একজন সফল উদ্যোগপতি। এভাবেই জীবন বদলেছে আগ্রার মেয়ে রাখির। এমটেক পড়াকালীন শেষ সেমিস্টার শেষ হওয়ার আগেই হায়দরাবাদে একটা দারুণ চাকরি পান রাখি। সেখানেই একমাসের মধ্যে আলাপ হয় বিকাশের । শ্লামবার্গারে কাজ করতেন বিকাশ। ছুটির দিনে দেখা হত। প্রেম গড়ালো বিয়েয়। এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন রাখী। ছেড়ে দেন চাকরি। হায়দরাবাদ থেকে চলে আসেন নিজের শহর আগ্রার কাছে নয়ডায়। নয়ডায় একটি নতুন সংস্থায় যোগ দেন তিনি। একবছর পর তাঁর স্বামী বিকাশ ভারতে ফিরে আসেন। এই সময়ে রাখীর সামনে দুটি রাস্তা খোলা ছিল। এক, সবকিছু ছেড়েছুড়ে স্বামীর সঙ্গে দেশে বিদেশ ঘুরে বেড়ানো। অথবা নিজের শহর আগ্রায় ফিরে গিয়ে ছেলের বড় হয়ে ওঠাকে প্রতি মুহুর্তে অনুভব করা। আর সেই খুশিতে জীবন কাটিয়ে দেওয়া। অনেক ভেবে দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিলেন রাখী।

image


অঙ্কের প্রতি দুর্বলতাটা সব কিছুর পরও কাটিয়ে উঠেত পারেননি রাখী। আগ্রার আশপাশে বিভিন্ন স্নাতক, ইঞ্জিনিয়ারিং ও এমবিএ কোর্সে অঙ্ক ও কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ানো শুরু করেন রাখী চাওলা। আর এই পড়াতে গিয়ে রাখী অনুভব করেন গোটা পঠনপাঠন ব্যবস্থাটাই কী ভয়ংকর দুরাবস্থার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। ছাত্রছাত্রীরা বোঝে তো শুধু নম্বর আর ডিগ্রি। তাদের জ্ঞানের বিস্তার হচ্ছেনা মোটেই। এজন্য বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকেই কাঠগড়ায় চাপান রাখী। অবস্থা বদলানোর চিন্তাকে হাতিয়ার করে রাখী প্রায় দু’বছর একটানা বিভিন্ন জায়গায় পড়ানো চালিয়ে যান। বিভিন্ন নতুন নতুন পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের ভীত গড়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থার কাছে কার্যত হার মানতে হয় তাঁকে।

রাখী বুঝতে পারেন গলদটা লুকিয়ে আছে একদম গোড়ায়। ছাত্রছাত্রীরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াকালীনই এই স্কুল ও কোচিং সেন্টারের গোলকধাঁধায় পড়ে যাচ্ছে। যার থেকে কখনই আর বেরিয়ে আসেত পারছে না। অভিভাবকরাও এর সঙ্গেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের মধ্যে আকাশচুম্বি আশা, প্রবেশিকা পরীক্ষা এবং দেশের সেরা শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে ভর্তির হওয়ার চাপ তাদের প্রচলিত ব্যবস্থার অঙ্গ করে তুলেছে। রাখী বুঝতে পারেন ছাত্রছাত্রীদের দরকার আধুনিকমনস্ক শিক্ষক, আধুনিক পঠন ব্যবস্থা ও আধুনিক মন। যে মন এই নতুন ধারাকে দ্রুত মেনে নেবে। এই লক্ষকে সামনে রেখেই রাখী চাওলা তাঁর ছোটবেলার শহর আগ্রায় তৈরি করেন নিজের সংস্থা ইডিথ্রিডি। অঙ্ক ও যুক্তিবিজ্ঞান, কম্পিউটার ও বিজ্ঞানের আধুনিক প্রশিক্ষণের জন্য তিনটি গবেষনাগারও তৈরি করেন রাখী। অঙ্কভিত্তিক পরীক্ষানিরীক্ষা, তার কৌশলগত দিক ও দ‌ৃশ্যগত দিক নিয়ে একটি কোর্সও ইডিথ্রিডিতে যুক্ত করেন রাখী। ২০১৩ সালের শেষের দিকে ৫ থেকে ১৩ বছরের বাচ্চাদের জন্যও একটি নতুন কোর্স ইডিথ্রিডিতে চালু করেন তিনি।

আগ্রার মেয়ে রাখী চাওলার অঙ্কের প্রতি গভীর প্রেম তাকে অঙ্ক নিয়ে স্নাতোকত্তর ডিগ্রি পাওয়ায় উৎসাহ যুগিয়েছিল। মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আইআইটি মুম্বইতে অনুষ্ঠিত ম্যাথেমাটিক্স ট্রেনিং এন্ড ট্যালেন্ট সার্চ প্রোগ্রামেও ডাক পান রাখী। সেখানে একমাস ক্লাস করতে গিয়ে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন তিনি। জানতে পারেন অঙ্কের অনেক গুঢ় বিষয়। সেই প্রথম আগ্রা ছেড়ে বার হন রাখী। এখন তাঁর মনে আছে মুম্বই যাওয়ার দিন তাঁর মা কী ভীষণ কেঁদেছিলেন। অঙ্কের কোর্স শেষ করে একটি গবেষণার কাজে রাখী চলে যান আইআইটি কানপুরে। সেখানে একাই জিএটিই পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করেন তিনি। একার চেষ্টায় সর্বভারতীয় স্তরে ৬৬ তম স্থান অধিকরা করেন রাখী চাওলা।

image


প্রতিটি বাচ্চারই আলাদা আলাদা ক্ষমতা থাকে। তাই একটা বিষয় সকলেই একইভাবে বুঝতে পারবে তা ভাবাই অন্যায়। সেকথা মাথায় রেখে রাখীর ইডিথ্রিডিতে একটি প্রবেশিকা পরীক্ষা চালু আছে। যেখানে একটি বাচ্চা কোন শ্রেণিতে পড়ে সেকথা মাথায় রেখে তার আইকিউ লেভেল ও ম্যাথেমেটিক্যাল রিজনিং পরীক্ষা করা হয়। রাখীর দাবি, ইডিথ্রিডিতে এখনও পর্যন্ত ৫০টির বেশি টেস্ট নেওয়া হয়েছে। যেখানে পাশের হার মাত্র ৪ শতাংশ। প্রচলিত পঠন পদ্ধতিই এই অবস্থার কারণ বলে মনে করেন রাখী। আর তাই ছাত্রছাত্রীদের তৈরি করতে আধুনিক পঠনধারাকেই পুরোদমে কাজে লাগাচ্ছে তাঁর সংস্থা।

প্রচলিত পঠন পদ্ধতির বাইরে বেরিয়ে তাঁর নয়া ধারার পঠন পদ্ধতি অভিভাবকদের বোঝানো রাখীর সামনে এখনও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। স্কুলের পড়া আর কোচিংয়ের বাইরে বেরিয়ে কোনও নতুন শিক্ষা পদ্ধতিকে সহজে মেনে নিতে পারছেন না তাঁরা। তবে ব্যতিক্রমও আছে। রাখীর মতে, অনেক বাবা-মা তাঁর এই উদ্যোগের পাশেও দাঁড়িয়েছেন।

তাঁর এই লড়াইয়ে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সকলকে পাশে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন রাখী চাওলা। তার ছ‍’বছরের ছেলেও তাকে বোঝে। তাই সব লড়াইয়ের বাইরে গিয়ে এক মায়ের মন কোথায় যেন ছেলের সঙ্গে কাটানো মুহুর্তগুলোকে তারিয় তারিয়ে উপভোগ করে। ছেলের সঙ্গে সময় কাটানোটা রাখীর কাছে অমূল্য। ছেলের কথা বলতে গিয়ে এখনও যে হাসিটা রাখীর ঠোঁটের কোণে ঝিলিক দিয়ে ওঠে তা ব্যাখ্যা করার মত কোনও ভাষা এখনও পৃথিবীতে তৈরি হয়নি।