আজ আপনাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব সুন্দরবনের এক অনন্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে। তিনি সুন্দরবনেরই ভূমিপুত্র। নাম শঙ্কর হালদার। গত বারো তের বছর ধরে সুন্দরবনের দুর্দশা থেকে মুক্তির রাস্তা খুঁজছেন বছর তেতাল্লিশের শঙ্কর। সুন্দরবনের আর্থসামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে একের পর এক প্রকল্প নিয়েছেন। ২০ হাজার শৌচাগার তৈরি করে দিয়েছেন সুন্দরবনের গ্রামে। পাঁচ হাজারের বেশি কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন কীভাবে অর্গানিক ফসল চাষ করা যায়। তিনশরও বেশি কৃষককে অর্গানিক চাষিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছেন। সুন্দরবনের অর্থনীতি এবং সেখানকার মহিলাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চল্লিশ হাজার নারকেল গাছ লাগিয়েছেন। এখনও পর্যন্ত বণ্টন করেছেন ২ লক্ষেরও বেশি গাছ। শিক্ষার ক্ষেত্রে যুগান্তর এনেছে তাঁর সংস্থা মুক্তি। খুলেছেন বুক ব্যাঙ্ক। সেই বুক ব্যাঙ্ক থেকে বই নিয়ে সারা বছর পড়াশুনো করছে সুন্দরবনের হাজার হাজার ছাত্র। হাজারেরও বেশি মেধাবী ছাত্রকে দেওয়া হয়েছে স্কলারশিপ। ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেলে সেমিস্টারের টাকাটা নিয়ে আর ভাবতে হয় না সুন্দরবনের গরিব মেধাবী ছাত্রদের। কারণ পাশে আছেন তাদের অ্যাঞ্জেল শঙ্কর হালদার।
রায়দিঘির পূর্ব শ্রীধরপুরের ছেলে শঙ্কর। নিজে জীবনে অনেক প্রতিকূলতা পেয়েছেন। হত দরিদ্র পরিবারে জন্ম। পরের জমিতে মুনিষ খাটতেন বাবা। স্কুলের পর বাবার কাজে হাত লাগাতেন। একবেলা খেয়ে আরেকবেলা উপোষ করে চালিয়ে দেওয়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল ছোটবেলা থেকেই। এটাই ওদের গ্রামের রেওয়াজ ছিল। নতুন কিছু নয়। অধিকাংশ বাড়িতেই লেখা পড়ার পাট চুকে যেত প্রাথমিক শিক্ষার পরই। কিন্তু এখানে ও একটু অন্যরকম। ছোটবেলা থেকেই লেখা পড়ায় ভালো। তাই পড়া চালিয়ে যেতে পেরেছেন। মাধ্যমিকে এবং উচ্চমাধ্যমিকে ৯০ শতাংশের ওপর নম্বর পেয়েছেন। স্কলারশিপও জুটে গিয়েছে ভালো লেখাপড়ার দৌলতে। পড়তে আসতে পেরেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯৬ সাল। সেসময় মাস্টার্স ইন কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন পড়তে ভালোই খরচ ছিল। কিন্তু অত টাকা পাবেন কী উপায়। তাই পড়া থামার উপক্রম হয়। শঙ্কর তার জীবনে একজন অ্যাঞ্জেলের দেখা পান। পাড়ারই এক ব্যাঙ্ক কর্মী। মধুসূদন বৈরাগী। তিনিও শঙ্করের মতই দারিদ্রের পাঁক থেকে উঠে এসে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছেন। লেখাপড়া শিখে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন নিজের উদ্যোগে। শঙ্করের কথা জানতে পেরে প্রয়োজনীয় টাকা দিয়ে সাহায্য করেন। ঘুরে যায় শঙ্করের জীবন।
এমসিএ পাস করেই চাকরি পান। এবার তার ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। কিন্তু মধুসূদন বাবু জানিয়ে দেন তার টাকা চাই না। বরং পারলে সে যেন তার সমাজের জন্যে কিছু করে।
ছোটবেলা থেকেই সামাজিক উন্নয়নে কিছু একটা করার ইচ্ছে ছিল শঙ্করের। এই সাহস পেলেন। ইচ্ছেটা উস্কে দিলেন অ্যাঞ্জেল মধুসূদন বৈরাগী। ২০০২ সালে মনস্থির করেন। ২০০৩ সালে মাথা তোলে মুক্তি নামের সংস্থা। শঙ্কর এবার সঙ্গে পেলেন মধুসূদন বাবুকে। জুটে গেল আরও কিছু সমমনস্ক মানুষ। স্কুল-ছুটদের পড়ানোর একটা প্রয়াস নিয়ে কাজ শুরু হলেও। তার পাশাপাশি, দুঃস্থ মানুষের জন্যে চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা। তাদের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি ফেরানোই ছিল সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। দরকার ছিল টাকার ব্যবস্থা করারও। এরমধ্যে ২০০৪ সালে TCS এ চাকরির সুবাদে জার্মানি চলে যেতে হয়। পরের একটা দশক ইউরোপ, আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়ায় কেটে যায়। একদিকে নিজের কেরিয়ার আর অন্য দিকে স্বপ্নের MUKTI-র জন্যে নেটওয়ার্কিংয়ের কাজ চালিয়ে যাওয়া। নিউইয়র্কে ম্যারাথন করে ১০ হাজার ডলার তুলে দিয়েছিলেন এক বন্ধু, ২০০৬ সালে ভারতীয় মুদ্রায় যার মূল্য ছিল ৫ লক্ষ টাকা। আরও অনেক বন্ধু সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। টাকার বন্দোবস্ত করে ফেলেন শঙ্কর বাবু আর তার টিম। বলছিলেন মুক্তি কোচিং সেন্টারের কথা। স্কুলের পড়া ভালো করে পড়ানোর স্কুল প্রথম থেকেই চালু হয়ে যায়। রায়দিঘির পরিসংখ্যান বলছে, মুক্তির উদ্যোগের আগে যেখানে মাত্র কুড়ি শতাংশ ছিল শিক্ষার হার, সেখানে শিক্ষার হার বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫৫ শতাংশ। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এবার প্রয়োজন পড়ে ভোকেশনাল স্কুলের। খুলে ফেলেন সেটিও। মুক্তি ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি। কম্পিউটার শেখানোর পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া হয়। যাতে হাতের কাজ শিখে দুটো পয়সা রোজগার করতে পারে শিক্ষিত যুবকেরা। এরই পাশাপাশি চলছে মাইক্রো ক্রেডিটের প্রকল্প। এই সামাজিক উদ্যোগপতি মহিলাদের স্বনির্ভর করার জন্যে বিনামূল্যে হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। সিড ফান্ডের জন্যে বিভিন্ন মানুষের কাছে হাত পাতছেন। ব্যবসা শুরু করার জন্যে অল্প টাকা বিনা সুদে ধার চাইছেন যাদের দেওয়ার ক্ষমতা আছে তাদের কাছে। মাত্র এক বছর পর সেই টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে মুক্তি। ওই এক বছরে ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দেওয়ার সার্বিক চেষ্টা করছেন শঙ্কর বাবু। এভাবে ইতিমধ্যেই হাজার দুয়েক মাইক্রো আন্ত্রেপ্রেনিওর তৈরি করে ফেলেছেন সুন্দরবনের মত জায়গায়। সংস্থার উদ্যোগে তৈরি জিনিসের বিক্রির ব্যবস্থাও আছে। মূলত কৃষি পণ্য নিয়ে মুক্তির গাড়ি আসে কলকাতার বিভিন্ন আবাসনে। অর্গানিক ফসল বিক্রি হয় রোজ।
২০১৪ সালে দেশে ফিরে এসেই লেগে পড়েছেন শঙ্কর বাবু। বলছিলেন ফিরে আসাটা সোজা ছিল না। যখন ফিরেছেন তখন মেয়ের বয়স দশ। ততদিনে বিদেশি স্কুলে পড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। ফলে ওই ছোট্ট মেয়েটার দারুণ কালচার শক হয়ে থাকবে। আর পাঁচটা সাধারণ যুবক যেখানে বিদেশে এতদিন থাকার পর দেশে ফেরার কথাটা জাস্ট ভুলে যায়। কখনও সখনও অলস সময়ে কল্পনা বিলাস করে সেখানে শঙ্কর বাবু ফিরে এসেছেন তাঁর শিকড়ের টানে। শুধু তার গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়াবেন বলে। এই আবেগটাকে অনেক স্ত্রীই মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু এক্ষেত্রেও ভাগ্যবান শঙ্কর হালদার। তাঁর কর্মযজ্ঞে পাশে পেয়েছেন স্ত্রীকে।
বলছিলেন ২০১৭—১৮ তে ১২৯ জন গরিব মেধাবী পড়ুয়া স্কলারশিপ পাচ্ছেন। এদের মধ্যে ২৮ জন হবু চিকিৎসক আর ৩৩ জন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। এই পরিসংখ্যান গুলোই শঙ্কর বাবুকে প্রেরণা দেয়। আর শঙ্কর বাবুর MUKTI অনুপ্রাণিত করে আমাদের সকলকে।
Related Stories
January 17, 2018
January 17, 2018
January 17, 2018
January 17, 2018
Stories by Hindol Goswami
January 17, 2018
January 17, 2018
January 17, 2018
January 17, 2018