শিশুশিক্ষার বার্তা নিয়ে সাইকেলে হিমালয়ে বারাসতের সুদীপ্ত

একদিকে কাশ্মির উপত্যকার বড় অংশ জুড়ে চলতে থাকা কার্ফিউ, অন্যদিকে তখনও দিল্লি থেকে কুরিয়ার-মারফত সাইকেলের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ আসা বাকি। হিমালয়ের বুক চিরে পাঁচ হাজার কিলোমিটারের একক সাইকেল অভিযান শুরুর কয়েক ঘন্টা আগে জম্মুর সরকারি গেস্টহাউসে বসে স্বাভাবিকভাবেই খুব অস্থির শোনাচ্ছিল সুদীপ্তর গলা। তারই মধ্যে আমাদের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন বারাসত নবপল্লির সুদীপ্ত পাল।

শিশুশিক্ষার বার্তা নিয়ে সাইকেলে হিমালয়ে বারাসতের সুদীপ্ত

Thursday July 21, 2016,

4 min Read

image


কাশ্মির থেকে অরুণাচল প্রদেশ – হিমালয়ের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত পাঁচ হাজার কিলোমিটার সাইকেল অভিযানে বেরোতে চলেছ তুমি। এই অভিযানের বিষয়ে একটু যদি বিশদে জানাও আমাদের...

সুদীপ্ত: দ্যাখো, এবারের অভিযানটা নানা কারণেই আমার কাছে খুব স্পেশ্যাল। প্রথমত ধরো, এই যে হিমালয়ের পুরো দৈর্ঘ্য বরাবর, একেবারে কাশ্মিরের শ্রীনগর থেকে অরুণাচল প্রদেশের ওয়ালং পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে যাওয়া... এটা আগে খুব বেশি ঘটেনি। এর আগে অনেকেই সাইকেল চালিয়েছেন হিমালয়ে, কিন্তু পুরোটা একসঙ্গে করা – তাও আবার সম্পূর্ণ একা – এ ব্যাপারটা খুবই চ্যালেঞ্জিং। এই যে একা সাইকেল নিয়ে হিমালয়-ঘেঁষা তিনটি দেশের মধ্যে দিয়ে যাওয়া – এই চ্যালেঞ্জটাই সবচেয়ে বেশি তাতিয়ে রেখেছে আমায়।

তারপর ধরো, এটা তো শুধু একটা পাহাড়ি রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে যাওয়া নয়, এটা সেই অঞ্চলের মানুষদের চিনতে-চিনতে – তাঁদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার ধরনটাকে বুঝতে-বুঝতে – তাঁদের ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হতে-হতে যাওয়া। এককথায় বলতে পারো, এটা আসলে প্রায় মাসচারেক ধরে তাঁদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলারও প্রচেষ্টা। আর সবচেয়ে যেটা বড় কথা, এই অভিযানটা আমি মূলত যাদের কথা মাথায় রেখে করছি, সেই পাহাড়ি শিশুদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠার ব্যাপারটাও আমার কাছে খুব খুব আগ্রহের।

হ্যাঁ, তোমার এই অভিযানের পরিকল্পনায় শিশুরা খুব বড় একটা জায়গা জুড়ে আছে। সেটা ঠিক কীভাবে?

সুদীপ্ত: দ্যাখো, হিমালয়ে আসা এই প্রথম নয় আমার। একেবারে ছোটবেলা থেকেই নিয়মিত পাহাড়ে যাচ্ছি আমি, প্রায় গত ১৫ বছর ধরে। এটা বরাবরই দেখেছি, যে কোনও পরিস্থিতিতে, বিশেষত যেখানে প্রাকৃতিক বিরুদ্ধতার মধ্যে বাঁচতে হয় মানুষকে, সেখানে প্রতি পদে সবচেয়ে বেশি মাশুল দিতে হয় শিশুদেরকেই। আমরা মুখে বলি বটে শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ, কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা কেউই খুব বেশি মাথা ঘামাই বলে মনে হয় না। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, হিমালয়ের দুর্গম এলাকার শিশুরা কোনও দিক দিয়েই আমাদের শহরের শিশুদের চেয়ে কোনও অংশে পিছিয়ে নেই, বরং অনেক ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে; কিন্তু কেবলমাত্র সুযোগের অভাবে তারা সেভাবে উঠে আসতে পারে না। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধে তো ছেড়েই দিলাম, সামান্য স্কুলে পৌঁছনোর সুযোগটুকুও পায় না অনেকেই। অথচ কেবল সেটুকু সুযোগ পেলেই তারা অনেকদূর এগোতে পারবে। আমার এই অভিযান, তাই, এককথায়, শিশুশিক্ষা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যই।

এই অভিযানে তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে CRY- Child Rights and You। সেটাও কি এই কারণেই?

সুদীপ্ত: একেবারেই তাই। আসলে শিশুশিক্ষা নিয়ে সচেতনতার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করছি, এটা বলা যতটা সহজ, কাজে করে দেখানো ঠিক ততটাই কঠিন। সত্যি বলতে কী, একার চেষ্টায় কতজন মানুষের কাছেই বা পৌঁছতে পারব আমি? কিন্তু যদি আমার হাত ধরে এমন কোনও সংস্থা, যারা এ-বিষয়ে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, যাদের দেশজোড়া নেটওয়ার্ক রয়েছে, তা হলে আমার কাজটা কিছুটা সহজ হতে পারে। যখন এসব ভাবছিলাম তখনই কানে আসে, এ-বছর ক্রাই শিশুশিক্ষা নিয়ে তাদের ‘School the Spark’ ক্যাম্পেন শুরু করতে চলেছে। খবর পেয়েই সিদ্ধান্ত নিই, এই সাইকেল অভিযানে আমি ক্রাই-কে যুক্ত হতে অনুরোধ করব। এবং আমার এই অভিযানেরও মূল বার্তা হবে সেটাই।

CRY-এর এই ক্যাম্পেন সম্পর্কে যদি আরও বিশদে আমাদের জানাও...

সুদীপ্ত: CRY-এর কাজকর্ম নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার নেই। গত ৩৬ বছর ধরে সারা দেশের মোট ২৩টি রাজ্যে শিশু-অধিকার নিয়ে কাজ করে চলেছে এই সংস্থা। এ-বছর তারা যে বিষয়টি নিয়ে ক্যাম্পেন করছে, তা হল, শিশুদের আরও বেশি করে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা, এবং স্কুলের গণ্ডী পেরনোর আগে তারা যাতে কোনওভাবে স্কুলছুট হয়ে না যায় তা সুনিশ্চিত করা। এই ক্যাম্পেনের মাধ্যমে সারা দেশে এদের অপারেশন-এলাকায় বসবাসকারী প্রায় আড়াই লক্ষ শিশুর স্কুলশিক্ষা সুনিশ্চিত করতে চাইছে ক্রাই। একই সঙ্গে ক্রাই চাইছে, শিশুশিক্ষা নিয়ে দেশজোড়া সচেতনতা গড়ে তুলতে, যাতে দেশের সর্বত্র শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে যায় প্রতিটি শিশুর কাছে। ক্রাই-এর আবেদনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে চাই, এই উদ্যোগে তোমাদের সকলকেই আমরা পাশে চাই। সমাজের সব স্তরের মানুষ এগিয়ে এলেই এই ক্যাম্পেনের মূল উদ্দেশ্য সফল হবে।

আবার একটু তোমার সাইকেল অভিযানের প্রসঙ্গে ফিরি। পাঁচ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এই যাত্রাপথ সম্পর্কে একটু জানতে চাই...

সুদীপ্ত: দ্যাখো, প্রথমে ঠিক করেছিলাম, আমি শুরু করব শ্রীনগর থেকে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি জম্মু চলেও এসেছিলাম। কিন্তু প্রায় আচমকাই সেখানে গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেল। ফলে শ্রীনগর যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করে আমি আপাতত শুরু করছি কিস্তোয়ার থেকে। জম্মু থেকে সরাসরি কিস্তোয়ার চলে যাব। সেখান থেকে কেলং, কাজা, টাবো হয়ে সিমলা। তারপর গাড়ওয়াল কুমায়ুন হয়ে ঢুকব নেপালে। নেপাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের মাথা ছুঁয়ে ভুটান হয়ে পৌঁছব অসম। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার উত্তর সীমানা ধরে এর পর অরুণাচল। শেষ করব একেবারে তিব্বত সীমান্ত-ঘেঁষা ওয়ালং-এ। পুরো রুটটা করতে অন্তত চারমাস সময় তো লাগবেই।

তোমার বয়সি ছেলে মেয়েরা যখন শপিং মলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাচ্ছে, তখন তুমি প্রায় পাণ্ডববর্জিত একটা ভূখণ্ডে একা সাইকেল-অভিযানে বেরনোর পরিকল্পনা করছ। এই তরুণ প্রজন্মের জন্য কোনও বার্তা?

সুদীপ্ত: না না, তরুণ প্রজন্ম কিছু করছে না, এই ধারণাটার সঙ্গে আমি মোটেই একমত নই। অনেকেই নিজের মতো করে অনেক কিছু করার চেষ্টা করছে। সত্যি বলতে কী, তরুণদের কাছ থেকে আমরা এত নতুন ধরনের কাজ দেখতে পাচ্ছি যে, খুবই আশাব্যঞ্জক লাগছে। শুধু এটুকুই বলতে চাইব, আমাদের আরও বেশি বেশি করে এমন কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়া দরকার, যাতে সমাজের কোনও একটা স্থায়ী উপকার হয়। এবং সেই উদ্যোগে সামিল হয়ে আমি যেন মানুষ হিসেবে আরও একটু ভালো, আরও একটু দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে পারি। আর অবশ্যই সবাইকে বলব, ক্রাই-এর এই উদ্যোগে সামিল হতে। 

image


ক্যাম্পেনটির বিষয়ে আরও বিশদে জানতে ক্লিক করতে পারেন: #SchoolTheSpark লিঙ্কে