গলি থেকে রাজপথে নাওয়াজের সান্তা

গলি থেকে রাজপথে নাওয়াজের সান্তা

Wednesday December 23, 2015,

4 min Read

প্রতিবছর বড়দিনের আগে মহম্মদ নাওয়াজ খুব ব্যস্ত থাকেন। লাল ভেলভেট আর সাদা তুলো নিয়ে তার কারিকুরি। এই যা! নাওয়াজের সঙ্গে আপনাদের আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়নি। নাওয়াজ কলকাতার ছেলে। ছোটোদের ভালোবাসে। এটুকুই পরিচয়। বাকিটা সান্তা ক্লজের সঙ্গে জুড়ে আছে ওর বাস্তবটা। এই সময় গোটা পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা সেজে উঠছে। নিউমার্কেট থেকে ফুটপাথ ছোট বড় নানান মাপের সান্তা বুড়োর ভিড়। শুধু স্লেজ গাড়িতে চাপার অপেক্ষা। মেরি ক্রিসমাস। জিঙ্গল বেল। সব রেডি।

জোরকদমে চলছে বুড়োকে গাড়িতে তোলার তোড়জোড়। এই লাল-সাদা বুড়োই পৌঁছে যাবে তিলোত্তমার আনাচে কানাচে। শত ব্যস্ততার মধ্যেই নাওয়াজ জানালেন, নামে কিবা এসে যায়? যেমন যায় আসে না মহম্মদে। তাইতো দিন-রাত এক করে শুধুই হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। ছোটদের মুখে হাসি ফোটাতে হবে যে। নিজের ছোট্ট ঘরেই কাজ করতে করতে জানালেন সেই শুরুর দিনের কথা, বাবা-ই প্রথম এ কাজ করতেন। বাবা মহম্মদ ইজাজের পুতুল তৈরি দেখে সান্তা ক্লজ তৈরি শুরু নাওয়াজের। চল্লিশ বছর ধরে এই কাজ করেছেন বাবা। বয়সের ভারে তাঁর কাজ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। তখনই হাল ধরেন নাওয়াজ। সঙ্গে পেয়ে যান স্ত্রী প্যারি বেগমকেও ।

image


কাজের শুরু ও পথচলা

নাওয়াজের বয়স তখন সবে ১৫। স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে কি পেরোয় নি। পড়াশোনার ইচ্ছার চেয়ে পুতুল তৈরির অমোঘ আকর্ষণ কিশোর নাওয়াজের ঘাড়ে চেপে বসে। তাই আনন্দ ও কৌতূহলের বশেই পুতুল তৈরিতে নেমে পড়ে নাওয়াজ। অজান্তেই কিশোর নাওয়াজ ব্যবসায়িক দায়িত্বটাও ঘাড়ে তুলে নেয়। দায়িত্ব নিয়েই নাওয়াজ বুজতে পারে শুধুমাত্র পুতুল সান্তা বানালেই হবে না । তা পাঠিয়েও দিতে হবে শহরের ওলিতে গলিতে। কিশোর নাওয়াজ তখন নিজেই দায়িত্ব নিয়ে নেয় শহরের সব দোকানে সেই সান্তা পৌঁছে দেওয়ার । সেই শুরু। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। দোকানদারদের সঙ্গে পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিউমার্কেট থেকে ক্যানিং স্ট্রীট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ওলি গলি পৌঁছে যায় ছোট বড় নানা লাল টুপি সাদা দাড়ির সান্তা। শহরের বাজারে এখন ডজন ডজন সান্তা পৌঁছে দেন নাওয়াজ। আগে শুরু করেন ছোট সান্তা তৈরির কাজ। তার পরেই শুরু হয় বড় মাপের সান্তা তৈরির কাজ। বায়না অনেক। সময় যত এগিয়ে আসে খাওয়ার সময় পাওয়া যায় না। দুপুরের খাওয়ার পর বিশ্রামের সময় কোথায়? বসে থাকার উপায় নেই। সময়মতো অর্ডার যে পৌঁছে দিতে হবে।অনেকটা কুমোরটুলিতো দূর্গাপুজোর আগের ব্যস্ততার মতো। বড়দিন পেরোলেই যে সান্তা বুড়োর কদর কমে যায়।

নাওয়াজ ও তাঁর স্ত্রী ও মা

নাওয়াজ ও তাঁর স্ত্রী ও মা


নাওয়াজের নানা সান্তারা

নাওয়াজের কাজে সাহায্য করেন তাঁর স্ত্রী প্যারি বেগম। সকালে সংসার সামলে, দুপুরে স্নান খাওয়ার পর বেগম সাহেবাও কাজে লেগে পড়েন। নাওয়াজের তৈরি সবচেয়ে ছোট সান্তার উচ্চতা ৮ ইঞ্চি। আর বিশাল সাইজের সান্তা। সেটা অবশ্য যেমন অর্ডার আসে। প্রায় ৬ ফুটের কাছাকাছি সান্তা। বা কখনও বুড়োর উচ্চতা ছাপিয়ে যায় ছ ফুট। লাল ভেলভেট দিয়ে নানান মাপের পুতুল তৈরি করে তার ওপর সাদা গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে সান্তা সাজিয়ে চলেন নাওয়াজ। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা প্রায় বিশ হাজার। পুতুল সান্তাই তাঁর গর্ব। নাওয়াজের অহংকার। গর্বভরে বলছেন ‘ আমার মত এত বড় আর ভালো সান্তা কলকাতায় কেউ বানায় না।‘ সত্যিই আর কেউ সান্তা বানায়ও না। শহরের কচিকাচাদের মুখের হাসি ফোটাতেই এখন কৈশোরের নেশা মহম্মদ নাওয়াজের পেশা।

নাওয়াজের মা

নাওয়াজের মা


নাওয়াজের সান্তা কারখানা 

ধর্মতলার বাটা মোড় থেকে একটু এগোলেই পিস হাভেন। এ নামটা শহরের মানুষজনের কাছে পরিচিত । পিস হাভেন থেকে সরু রাস্তায় পা দিয়ে পৌঁছে যাওয়া মসজিদ বাড়ি লেনে। আর সেখানে পাড়ার ছোটদের হাতের নির্দেশই বলে দেয় ওখানে তৈরি হচ্ছে সান্তারা। মহম্মদ নাওয়াজ বললে অবশ্য ওই গলিতে মানুষজন একটু ভ্রু কুঁচকে ভাবেন। আর যদি বলেন, ওই সান্তা তৈরি করেন .... ব্যাস আর বলতে হবে না। বাবলুর বাড়ি সবাই দেখিয়ে দেবে। পাড়ার সকলেই তাকে ডাকে বাবলু নামে। ওটাতেই পরিচিতি। আর বড়দিনের আগে মসজিদ বাড়ি লেনেই বাবলুর হাতে বেড়ে ওঠেন বুড়ো সান্তারা। আর সেই গলি থেকেই শহরের রাজপথে নিওন আলোয় সুসজ্জিত হয় সান্তারা । কোথাও স্লেজ গাড়িতে কোথাও বা আবার দাঁড়িয়ে। আবার শিশুর তালুতে বন্দি খুদে সান্তা।

বড় দিনের পর...

বড়দিন আসে বড়দিন যায়। বাবলু পাঁচ মাসের ব্যস্ততা কাটিয়ে হিসেবের খাতায় মন দেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাল ভেলভেটের টুকরোয় চোখ রেখে আর উত্তুরে হাওয়ায় উড়ে আসা সাদা তুলো গায়ে মেখে পরিশ্রমের মূল্য বুঝে নেন নাওয়াজ। আয় ভালোরকমই হয়। প্রায় হাজার চল্লিশ। কিন্তু সে দিয়ে তো আর বছর চলে না। তাই পাঁচ মাসের ব্যস্ততা কাটিয়ে অটো নিয়ে পথে নেমে পড়েন নাওয়াজ। বাকি সাত মাস তখন পেশায় অটোচালক তিনি। সারি সারি গাড়ির ভিড় ঠেলে ট্রামলাইন ধরে এগিয়ে চলে অটো। যে অটো থেকে শোনা যায় .. ইয়ে ব্লু হ্যায়—পানি পানি পানি পানি পানি পানি // অর দিন ভি সানি সানি সানি সানি ... আর স্লেজ গাড়িতে উপহারের ঝোলা নিয়ে সান্তা বলেন.....জিঙ্গেল বেল জিঙ্গেল বেল জিঙ্গেল অল দ্য ওয়ে ....