শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে শুক্লার ‘পরিক্রমা’

বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন বস্তিতে বাস করা সতেরোশো ছেলে-মেয়েকে এখন আর সকাল হলেই কাজে বেরিয়ে পড়তে হয় না। প্রতিদিন সকালে ওরা স্কুলে যায়। ঝুপড়িবাসী এই ছেলেমেয়েদের শৈশব অন্য খাতে বইত, যদি না এক মহিলা তাদের পাশে এসে দাঁড়াতেন। তিনি শুক্লা বোস।

শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে শুক্লার ‘পরিক্রমা’

Wednesday August 19, 2015,

4 min Read

শুক্লা বোস

শুক্লা বোস


টানটান করে বাঁধা চুল, কপালে একটা বড় টিপ, কথাবার্তায় ফুটে উঠছে আত্মবিশ্বাস। এই আত্মবিশ্বাসই তাঁর প্রতিটা পদক্ষেপে প্রতিফলিত। আজ থেকে বারো বছর আগে চাকরি-বাকরির পাট চুকিয়ে বেঙ্গালুরুতে একটি স্কুল চালু করেন শুক্লা। মধ্য বেঙ্গালুরুর রাজেন্দ্রনগরে একটি বাড়ির ছাদে শুরু হয় পথবাসী বস্তিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল। উদ্দেশ্য ছিল ওদের একটা সুস্থ জীবন দেওয়া। শুরুতেই একশো পঁয়ষট্টিজন পড়ুয়া। চ্যালেঞ্জটা নিয়েই ফেললেন শুক্লা। এখন সংখ্যাটা সতেরশো ছাড়িয়ে গিয়েছে।

অনেক ভেবে চিন্তে স্কুলের নাম দিয়েছিলেন পরিক্রমা ফাউন্ডেশন। স্কুলটি এখন বেঙ্গালুরুর জয়ানগর, সহাকারনগর, কোরামঙ্গলা ও নন্দিনী এলাকায় শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে। বস্তিবাসী ওই সতেরোশো ছেলেমেয়ে এখন ওই চারটি স্কুলে দিব্যি লেখা পড়া শিখছে। শুক্লা বোস আজ এই ছেলেমেয়েদের কাছে একটা ভরসা, একটা অবলম্বনের নাম। 

ষাট ছুঁই ছুঁই এই মহিলা ও তাঁর সংস্থা দিনরাত খেটে চলেছে শুধু এইটুকু নিশ্চিত করতে যাতে ঝুপড়ির সব থেকে গরিব ঘরের বাচ্চাটা যেন আর পাঁচটার স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়।

সমাজের তৃণমূলস্তরের মানুষের হয়ে কাজ করার ইচ্ছেটা শুক্লার মধ্যে ছোটবেলা থেকেই ছিল। স্বচ্ছল পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও বাড়ির পরিবেশ তাঁকে মাটির কাছে থাকতে শিখিয়েছে। বাবা সরকারি আমলা এবং মা একনিষ্ঠ গৃহকর্ত্রী। পাঁচবার বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাওয়া বোস দম্পতির সংসারে শুক্লা একটা অন্য আশা নিয়ে জন্মেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন মা বাবার বড় আদরের। কিন্তু বাড়ির ছেলেমেয়েদের বড় করে তোলায় পরিবারটির বাহুল্য বা দেখনদারি, কোনওটাই ছিল না। তাই বাড়ির বাইরে সাত সাতটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন ৬ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতেন শুক্লা। তিনি নিজেই বলেন, ‘আমরা খুব সাধারণ জীবনযাপন করেছি, যেটা বড় হয়ে উঠতে খুব উদ্বুদ্ধ করেছিল, আমি আজ যা কিছু তার জন্য জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়গুলোর কাছে ঋণি’। শিক্ষাকেও যে কোনও ব্যক্তির ক্ষমতায়নের বড় অঙ্গ বলে মনে করেন শুক্লা। তাঁর নিজের চিন্তাভাবনাতেও লেখাপড়ার অবদান অনস্বীকার্য।


পরিক্রমা ফাউন্ডেশনের পড়ুয়াদের সঙ্গে একাত্ম শুক্লা বোস

পরিক্রমা ফাউন্ডেশনের পড়ুয়াদের সঙ্গে একাত্ম শুক্লা বোস


দার্জিলিংয়ে শৈশব থেকে কৈশোর কাটালেও কলেজে পড়তে কলকাতায় আসতে হয়। শুক্লা মনে করেন, ‘আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার সেটাই ছিল প্রথম পদক্ষেপ’। ১৯৭৬ সালে, মাত্র ১৯ বছর বয়সেই তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর ভূটান চলে যান। কাজ শুরু সেখানেই। ভূটানে মোতায়েন ভারতীয় জওয়ানদের বাচ্চাদের জন্য সেখানে একটি স্কুল খোলেন শুক্লা। স্কুল পরিচালনা থেকে পাঠ্যক্রম ঠিক করা, সবের দায়িত্বেই তিনি। তবে ভূটানের জল-হাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারায় দেশে ফিরতে হয় তাঁকে। এরপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করে চাকরিতে যোগ দেন তিনি।

স্নাতকোত্তর শেষ করে কলকাতার ওবেরয় গ্র্যান্ড হোটেলে চাকরিতে যোগ দেন। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। কর্মক্ষেত্রে এরপর ধাপে ধাপে উন্নতি করেছেন শুক্লা। গ্র্যান্ডে কাজ করার সময়ে হোটল কর্মীদের জন্য নিউজলেটার প্রকাশের দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। এই দায়িত্ব তাঁকে হোটেল কর্মীদের জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল। মাদার টেরেজার সঙ্গেও কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। গ্র্যান্ড হোটেলের চাকরি পর প্রথমে মাদারের নির্মল হৃদয় ও তারপর শিশু ভবনে অনাথ শিশুদের নিয়ে তিনি কাজ করেন। চাকরি করতে করতেই এমবিএ-টাও করেছেন শুক্লা।

কপোর্রেট জীবন খুব একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। ছাব্বিশ বছর কর্পোরেট জগতে কাজ করার পর ২০০০ সালে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাদামাটা পরিশ্রমী জগতে যোগ দেন তিনি। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ভারতীয় শাখার এমডি হিসেবে শিক্ষাপ্রদানকে তাঁর প্রজেক্ট থিম বেছে নেন। ২০০৩ সালে শুক্লা শুরু করেন তাঁর নিজের সংস্থা পরিক্রমা। এর পিছনে তিনি জীবনের সব পুঁজি ঢেলে দেন। ঝুঁকি ছিল। কিন্তু নিজের সঙ্কল্পে বিশ্বাসও ছিল। আর তাই চ্যালেঞ্জটা জিততে পেরেছিলেন শুক্লা।


ওরা আমার  প্রিয়জন...

ওরা আমার প্রিয়জন...


পরিক্রমা ফাউন্ডেশন থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রীরাও আজ ভাল ভাল জায়গায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। বর্তমানে আইআইএম ব্যাঙ্গালোর এবং আমেরিকার করনেল ইউনিভার্সিটিতে ম্যানেজমেন্টর পাঠ্যক্রমে পরিক্রমা হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনকে নিয়েই আস্ত একটা চ্যাপ্টার রয়েছে। সমাজে এতটাই প্রভাব ফেলেছে এই সংস্থার কর্মকাণ্ড।

ব্যক্তিগত জীবনে শুক্লা রান্না করতে, বই পড়তে ভালোবাসেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও নিজেকে সময় দেবেন বলে প্রতিদিন ভোর সাড়ে চারটেয় ঘুম থেকে ওঠেন। আর পাঁচজন গৃহিনীর মতো বোকা বাক্সে কিছু ধারাবাহিকও দেখেন। মাঝেমধ্যে ট্রেকিংয়েও বেরিয়ে পড়েন তিনি। স্বামী আর মেয়েকে নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসারের অনেকটা জুড়েই রয়েছে পাঁচ পাঁচটা পোষ্য কুকুর। এদের চার জন আবার পরিক্রমার চারটি স্কুলের পাহারাদার। 

মাদার টেরেজা, দলাই লামা এবং স্যর নিকোলাস উইনটন নামে এক ব্রিটিশ সমাজকর্মীকে নিজের আদর্শ মানেন শুক্লা। তাঁর কথায়, ‘এই ব্যক্তিদের সাধারণ জীবনযাত্রা, তাদের বিনম্রতা আমাকে আকৃষ্ট করে’।

শুক্লা বোসের একটা স্বপ্ন আছে। আজ থেকে বছর কুড়ি পর, হয়তো যখন তিনি হাঁটাচলার ক্ষমতা হারাবেন, তখন ঠিক সকাল সোয়া আট‌টায় একটা হুইলচেয়ারে করে একটি স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে হাজির হবেন। না, তাঁর হাতে গড়া পরিক্রমা স্কুল নয়, এই স্কুল হবে পরিক্রমারই কোনও প্রাক্তনীর তৈরি করা।