রাগবি খেলাই সরস্বতীপুরকে আলো দেখিয়েছে। শুনে মনে হতে পারে এ আবার হয় নাকি। একটা খেলা যার চল ভারতে বিশেষ একটা কোনও কালেই ছিল না। বরং ফুটবল ক্রিকেট হাডুডুডু কাবাডি তবু চলতে পারে সেখানে রাগবি খেলায় ভর করে জলপাইগুড়ির সবুজের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটি গ্রাম আজ আলোচনার শিরোনামে উঠে এল কীভাবে। সেই কথাই আপনাদের জানাব বলেই এই কাহিনি। জাঙ্গল ক্রোস ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছা সেবী সংস্থার উদ্যোগে এই গ্রামে আসে খেলো রাগবি ক্যাম্পেইন। গ্রামটা এমনতি আর পাঁচটা সাদা মাঠা গ্রামের মতোই। চাবাগান লাগোয়া গ্রাম তাই শ্রমিকদের ছেলেমেয়েতেই ভর্তি। কেউ বাংলায় কথা বলে কেউ হিন্দি, কেউ নেপালি, কেউ আবার দেহাতি বিহারী ভাষার ছেলে মেয়ে। সব মিলিয়ে রীতিমত জগা খিচুড়ি ভাষার একটি গ্রাম। এখানে মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে কেউ কখনও মাথাই ঘামায়নি। চা বাগানের সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি। রোজের রোজগার ৮৫ টাকা। তাও যদি কাজ থাকে। অথচ ওটাই ওদের গোটা পৃথিবী, বাইরের জনজীবনের সঙ্গে মুখ দেখাদেখি নেই। কর্মহীন, বেকারত্ব কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। অশিক্ষা, নেশা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, চা বাগান মালিকদের শোষণ, হিংস্র জন্তুর হানা—সব মিলিয়ে প্রকৃতির কোলে অভিশপ্ত জীবন ছিল এই গ্রামে। ২০১৩ সালে এহেন সরস্বতীপুরে ঢুকে পড়ে ‘খেলো রাগবি’।
উদ্দেশ্য। খেলার ছলে চা বাগানের আদিবাসীদের জীবনযাত্রায় অন্য মাত্রা যোগ করা। সরস্বতীপুরে পা রেখেই ‘খেলো রাগবি’ প্রথম যে কাজটা করে সেটা হল রাগবিকে মেয়েদের খেলা বলে প্রচার করে দেয় যাতে বাবা মায়েরা তাঁদের মেয়েদের খেলতে দিতে কোনও আপত্তি জানাতে না পারেন। চার বছর পর বোঝা গেল ‘খেলো’ র রাস্তা কতটা সঠিক ছিল। ছোট্ট এবং প্রায় অনামী গ্রামের কৃপা ওরাঁও, সঞ্জনা ওরাঁও, সন্ধ্যা রাই, পুনম ওরাঁও—আদাবাসী পরিবারের এই মেয়েরাই সারা দেশের মহিলা রাগবির মশাল হয়ে উঠেছে। গাজোলডোবা হাইস্কুলের এই চার ছাত্রীকে ‘জাঙ্গল ক্রোস ফাউন্ডেশন’ এর ফাদার জর্জ ম্যাথু এক বছর আগে ‘খেলো রাগবি’তে নিয়ে আসেন। ‘প্রথম প্রথম আপত্তি এসেছিল। কিন্তু ফাদাররা গ্রামের মানুষকে বুঝিয়েছেন খেলা মানে মজা, গ্রামের বাইরে কত লোকজনের সঙ্গে পরিচিতি বাড়বে, তাদের কাছ থেকে কত কিছু শেখা যাবে’, রাগবি খেলা শুরুর পথে হাজারো বাধার গল্প বলছিল কৃপা। ‘পরিবর্তনটা নিজেই বুঝতে পারছি। রাগবি আর পড়াশোনা পাশাপাশি চালিয়ে যেতে পারলে জীবনে উন্নতি হবে। আদব কায়দা শিখেছি। বড়দের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, ছোটদের কী বলব স্যেরেরা সব শেখাচ্ছেন। সরস্বতীপুরের বাকি ছেলেমেয়েদেরও উৎসাহিত করতে চাই। আমার বাবা—মা আমাকে নিয়ে বেশ খুশি। আমি যাতে অন্যচদের সাহায্যে এগিয়ে যাই তার জন্য তাঁরাই আমাকে উৎসাহিত করেন’, গর্বিত কৃপা বলে চলে।
একেই তস্য গ্রাম। তার ওপর রাগবি। সহজ ছিল না মোটেও। ‘বাড়ির আপত্তি, প্রতিবেশীর বাঁকা চোখ এত কিছুকে পাশ কাটিয়ে মাঠে নামা চ্যা লেঞ্জ ছিল। মাঠেও ছেলেরা নিজেদের দাপট দেখাতে গোটা মাঠের দখল নিয়ে নিত। কখনও মাঠের মাঝখানে ভলিবলের পোস্ট পুঁতে রাখত যাতে আমাদের প্র্যাকটিসের জায়গা ছোট হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আমাদের জিতে আনা পুরস্কারও সন্দেহের চোখে দেখত গ্রামের অনেকেই। পাত্তা দিইনি। নিজেদের কাজ করে গিয়েছি’, বলছিলেন সঞ্জনা।
‘আমাদের সমাজে মানুষ বুঝতে চায় না বাইরের জগৎটাকে চেনা কতটা জরুরি। এখানে ছেলে—মেয়ের ভেদাভেদ আছে। অনেকেই ভাবে মেয়েরা খেলতে পারে না। কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছি মেয়েরাও খেলতে পারে। শুধু তাই নয় রাগবিতে তো ছেলেরা পিছিয়ে বরং’, হাসে সন্ধ্যা। রাগবি মেয়েদের চোখ খুলে দিয়েছে। সঞ্জনা ভালো রাগবি খেলোয়াড় হতে চায়। সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে অন্তত স্নাতক হওয়ার ইচ্ছে আছে। পুনম আবার চায় স্নাতক শেষ করে রাগবি কোচ হতে। তারপর চাকরি নিয়ে গ্রামের বাইরে চলে যাওয়ার ইচ্ছে। সন্ধ্যাজ শুধু খেলাতেই মন দিতে চায়। রাগবিতে বাংলার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন দেখত। সেই স্বপ্ন সদ্য পূরণ হয়েছে জাতীয় টুর্নামেন্টে। এবার লক্ষ্যধ জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়ার। কৃপার এদের মধ্যেন সবচেয়ে বয়সে বড়। ভালো খেলোয়াড় হতে চায়। প্রথমে পড়া শেষ করাই লক্ষ্যই। তারপর কাজ করে পরিবারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চায় সে। তবে কোথাও একটা ভয়ও আছে। এখনও অনেকটা পথ বাকি, সেটা ভেবেই ভয় পায় আদিবাসি মেয়েগুলি।
সামান্য আদব কায়দাও জানত না যে মেয়েগুলি তারাই এখন অর্গানাইজার। ১১ অক্টোবর রাষ্ট্রসংঘের শিশুকন্যা দিবস পালন উপলক্ষে ময়দানে অনূর্ধ্ব ১৪ রাগবি ফেস্টিভ্যালের অয়োজন করল কৃপারাই। ‘পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন। মেয়েরাই সব করল। এই প্রথমবার এভাবে টুর্নামেন্টের আয়োজন হল’, বললেন ‘খেলো রাগবি’র প্রোজেক্ট ম্যানেজার নিধি জিলানি। আর কৃপারা বললেন, ‘সরস্বতীপুরে হামেশাই এমন টুর্নামেন্টের আয়োজন আমরাই করে থাকি। তাই টেনশন ছিল না, বরং উপভোগ করেছি। প্রমাণ করে দিয়েছি সুযোগ পেলে আমরা কী না করে ফেলতে পারি’। ‘খেলো রাগবি’ যেখানে যেখানে পৌঁছেছে সেসব এলাকার ২৮০ জন মেয়েকে নিয়ে ২০ টি অংশ নিয়েছে এই টুর্নামেন্টে। সব দেখে উচ্ছ্বসিত ‘জাঙ্গল ক্রোস’ এর প্রতিষ্ঠাতা পল ওয়ালস। যে স্বপ্ন নিয়ে ‘খেলো রাগবি’ পথচলা শুরু করেছিল সেই পথের এখনও অনেকটাই পেরোতে বাকি। তবু পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলোর মেয়েদের মুখে তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট। এইটুকু যাত্রায় ‘খেলো রাগবি’র সেই পাওনাটাই বা কম কী?
Related Stories
November 06, 2017
November 06, 2017
November 06, 2017
November 06, 2017
Stories by Hindol Goswami
November 06, 2017
November 06, 2017
November 06, 2017
November 06, 2017