গোলটা দেবেনই U17 স্ট্রাইকার অভিজিত সরকার

গোলটা দেবেনই U17 স্ট্রাইকার অভিজিত সরকার

Tuesday November 28, 2017,

3 min Read

সকলের খেলার মাঠ একরকম নয়। তুমি লড়ছ তোমার মাঠে। পায়ে বল এলে সুন্দর করে কাটিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে দিচ্ছ গোলের দিকে। সে তুমি স্টার্টআপের উদ্যোগপতি হও কিংবা দশটা পাঁচটা চাকরিজীবী। কিংবা কলেজের পড়ুয়া অথবা কলেজে পড়াও। তুমি তোমার মাঠে লড়ছ। আর অভিজিত সরকারকে লড়তে হচ্ছে জীবনের মাঠে। একে তো ফিফা অনূর্ধ্ব বিশ্বকাপে ভারতীয় স্কোয়াড খুব একটা খেলবার সুযোগ পায়নি। এএফসি আন্ডার নাইনটিনে খুব সুবিধের জায়গায় নেই অভিজিত। একথা সাজিয়ে গুছিয়ে না বললেও সকলেই অনুমান করতে পারছেন। ফলে ধীরে ধীরে অভিজিতের লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে উঠছে। কিন্তু হার মানার ছেলে নন চুঁচুড়ার অভিজিত সরকার। হেরে যাওয়া মানে তো ফুরিয়ে যাওয়া নয়। সেই কথাই অভিজিত জীবন দিয়ে শিখেছে। বলা ভালো দুটো তিনটে জীবন দিয়ে।

image


বাবা হরেন সরকার জানেন ফুটে ওঠার সম্ভাবনা যখন ফুটে উঠতে পারে না তখন তার কেমন যন্ত্রণা হয়। সেখান থেকে তৈরি হয় জেদ। এবং সেই জেদকে পুষে রেখে তাকে বিদ্যুতে রূপান্তর করার কৌশল বাবার কাছ থেকে শিখে নিয়েছেন অভিজিত। অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের পোস্টার বয়ের পায়ের স্কিল এগিয়ে যাওয়ার জেদ দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন IFA-র বিশেষজ্ঞ নির্বাচকেরা। ২০১৩ সালে অভিজিৎ তখন দেবানন্দপুর শিক্ষানিকেতনের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ওর এই ফুটে ওঠার গল্পটা শুনলে আপনার গায়ে কাঁটা দেবে।

রোজ ভোর আড়াইটা নাগাদ উঠতে হয়। তিনটের মধ্যে বেরিয়ে পড়েন। চুঁচুড়ার চকবাজারে মাছের আড়ত থেকে মাছ নিয়ে ভ্যানে করে পৌঁছে দেন বিভিন্ন বাজারে। দুপুর বারোটা নাগাদ বাড়ি ফিরেই বসে পড়তে হয় জামাকাপড় সেলাই করতে। স্ত্রী অলকা সংসারের কাজকর্মের পাশাপাশি বিড়ি বাঁধাইয়ের কাজও করেন সংসারের আর্থিক অনটন সামাল দিতে। অনেক কষ্টের মধ্যেও ছেলের বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন সবসময় জিইয়ে রেখেছিলেন হরেন বাবু। বাবার কাছেই ছোট্ট অভিজিতের প্রথম ফুটবল শেখা। হরেন বাবু দুর্দান্ত ফুটবল খেলতেন। দারিদ্রের মত কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে রীতিমত লড়াই করে গোলপোস্টের দিকে এগিয়ে চলেছেন হরেন বাবু। যদিও শৈশবেই ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যায়। কিন্তু ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা কখনও ফুরিয়ে যায়নি। ছেলের মধ্যে সেই স্বপ্ন পূরণের জেদ চেপে বসেছিল। সারাদিন হাড় ভাঙা খাটুনির পর বাড়ি ফিরেই প্লাস্টিকের বল পায়ে ছেলের সঙ্গে খেলতে নেমে পড়তেন। অভিজিতের বয়স তখন মাত্র চার। বছর খানেক পরে ছেলেকে ভর্তি করে দেন কাছেই লেনিন পল্লীর বাণীচক্র ক্লাবে অশোক মণ্ডলের কোচিংয়ে। ভারতীয় দলের স্ট্রাইকারের প্রথম এই কোচেরও ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আর্থিক সংকট ওকে স্বপ্ন থেকে ছিটকে দিয়েছে। টোটো চালান! কিন্তু মাঠ থেকে ছিটকে দিতে পারেনি দারিদ্র। আজও মাঠ নিয়েই পড়ে আছেন মণ্ডল স্যার। ফুটবল কোচিং করেন এলাকার উঠতি ফুটবলারদের তৈরি করেন। বছর পাঁচেকের অভিজিতকে যখন পেলেন তখন জহর চিনতে ভুল করেননি এই জহুরি। ধরে ধরে যত্ন করে পায়ের স্কিল শিখিয়েছেন অভিজিতকে। হরেন বাবু বলছিলেন, ভ্যান চালিয়ে আর কতই বা রোজগার হয়। তবু কষ্টে শিষ্টে একটু একটু করে জমিয়ে ছেলের খেলার বুট, জার্সি কিনে দিয়েছেন। অভিজিৎ যাতে খেলা চালিয়ে যেতে পারে তাই অশোক বাবুও অনেক সাহায্য করেছেন। 

বাংলা দলে জায়গা পাওয়াটাই অভিজিতের জীবনের প্রথম বাঁক। জুনিয়র বাংলা দলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরই অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ দলের জন্য বাছাই হন অভিজিত। গত চারবছর গোয়ায় জাতীয় শিবিরে আরও লড়াকু হওয়ার শিক্ষা পাচ্ছেন। আরও এগিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্নের দিকে। টানাটানির সংসারে অভাবকে ড্রিবল করে একটি ছেলে এগোচ্ছে। গ্যালারি ভর্তি লোক আনন্দে উল্লাসে করতালি দিচ্ছে। ওর বাবা আর ওর অশোক কাকুর মতো ও অসহায়তার লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরে যেতে চায় না। সাফল্যের গোলটা ও দেবেই।