পায়ে হাঁটিয়ে কলকাতার 'ভূত' দেখান পার্থসারথি

পায়ে হাঁটিয়ে কলকাতার 'ভূত' দেখান পার্থসারথি

Thursday May 26, 2016,

4 min Read

কলকাতায় ভূতের সংসারের খোঁজ রাখেন? এই শহরের আনাচে কানাচে ভূত। প্রাচীন ভূত। নবীন ভূত। তাঁদের ইতিহাস। তাদের ভবিষ্যত এসব নিয়েই সম্প্রতি মেতে উঠেছেন কলকাতার এক দুঁদে রাজনৈতিক রিপোর্টার পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়। ইতিহাস ঘাটার শখ চিরকালের। কোথাও গেলেই জিজ্ঞেস করেন সেই জায়গার ইতিবৃত্ত। যা দেখছেন যা শুনছেন যা বুঝছেন শুধু তাই তাঁর রিপোর্টিংএ থাকে না। থাকে তার প্রচ্ছদ। থাকে ভূতকালের কথা। সব সময় খোঁজার চেষ্টা করেন শেঁকড়। আর এই শেকড়ের সন্ধান করতে করতেই কৌতুহলী পার্থ খুঁজে পেয়েছেন কলকাতার ভূতুড়ে বাড়ির হদিস।

image


স্বপ্ন ছিল নতুন কিছু করার। নিজের মতো করেই ভাবতেন কিছু করবেন। হোক না ছোট্ট কিছু। ক্ষতি নেই। তবু নতুন কিছু অন্যরকম থ্রিলিং কিছু করে দেখাবেন তাদের যারা ওকে বলেছিল, তোর দ্বারা কিছু হবে না। তুই রিপোর্টার রিপোর্টারই থেকে যাবি। সেই সব নিন্দুক বন্ধুদের মুখের ওপর জবাব দিয়েছেন পার্থ।

সমস্যা অনেক ছিল। পুঁজি ছিল না। শুরুতে বিনা পুঁজিতে ব্যাপারটা নেহাত অসম্ভব মনে হলেও দিব্যি সম্ভব করেছেন শুধু ওর শেকড়ের খোঁজ। অদম্য অধ্যবসয় আর উদ্যোগ নেওয়ার প্যাশন। এসব দিয়েই হেরিটেজ ব্লগ লেখা শুরু করেন। বছর তিনেক আগে।

একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সিনিয়ার রিপোর্টার। তাই অন্য আর পাঁচটা পেশার চেয়ে অনেকটাই বেশি ব্যস্ত থাকেন। তাঁর ফাঁকেই নিজের ব্লগের জন্যে লেখেন। ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছে তাঁর নিজস্ব পাঠক। যারা মুখিয়ে থাকে ওর ব্লগ পোস্টের জন্যে। এবার তাদের জন্যেই মূলত শুরু করলেন কলকাতার নানান জানা অজানা জায়গা ঘুরিয়ে দেখানোর একটা পায়ে হাঁটা ট্যুর প্যাকেজ। ট্যুর প্যাকেজ বললে বোধহয় খাঁটো করা হবে ওর উদ্যোগকে। ও রীতিমত টাইম মেশিনে চেপে শদুয়েক বছর পিছিয়ে যান। ওর সহযাত্রীদের নিয়ে যান ইতিহাসের অলিতে গলিতে। ভূতেদের চিহ্ন চিনিয়ে চিনিয়ে নিয়ে যান রহস্যে মোড়া এক কলকাতায়।

image


দুই থেকে তিন ঘন্টার এই টানটান রহস্য সফরে আপনাকেও স্বাগত জানাচ্ছেন পার্থ। কলকাতাকে নিয়ে মজার মজার নানা তথ্য, ঘটনা, গল্প বলতে বলতে পার্থসারথি ঘুরে বেড়ান তাঁর নিজস্ব টাইম মেশিনে। সব বয়সের মানুষের জন্যই অভিনব সুযোগ রয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য রেখেছেন বিশেষ ব্যবস্থা।

পার্থ বলছিলেন ইতিহাসের প্রতি টান তাঁর ছাত্রাবস্থা থেকেই। সাংবাদিকতার হাতে খড়িও ইতিহাস দিয়েই। একটি জনপ্রিয় কিশোর পাঠ্য পত্রিকায় ইতিহাস, প্রত্নতত্ব সংক্রান্ত প্রবন্ধ দিয়েই লেখালিখি শুরু করেন পার্থ। তারপর রাজনৈতিক সাংবাদিকতা। সেটা করতে করতে পড়তে হয় অনেক। রাজনীতি তো আর একালের সীমায় আটকে থাকে না। সেকালের অনুষঙ্গও চলে আসে। এই সাংবাদিকতার সূত্র ধরে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু হয়ে প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র, অতূল্য ঘোষ, অম্বিকা চক্রবর্তী, পান্নালাল দাশগুপ্তর মত অগণিত মানুষের মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বারংবার ইতিহাসের অন্দরে উঁকি মারার সুযোগ হয়েছে। আর অসীম কৌতুহল ওকে নিয়ে গিয়েছে সেই সব সময়ে। সাংবাদিকতা করতে করতেই শুরু করেন নিজের ব্লগ। বিষয় বাংলার ঐতিহ্যভবন। নিজেই ছবি তোলেন। সংগ্রহ করেন সেই বাড়িরই পুরোনো ছবি। একটু একটু করে বইপত্র ঘেঁটে তুলে আনা তথ্য দিয়েই Heritage structures of Bengal নামে তৈরি করেছেন নিজের ব্লগ।

ব্লগ দেখে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই এই বাড়িগুলো ঘুরে দেখতে চাইতেন। কেউ চাইতেন ছবি তুলতে। সেখান থেকেই চিন্তাভাবনা। অবশেষে বিদেশে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে, এমন এক বন্ধু সাহস দিলেন। তাঁরই এক প্রবাসী আত্মীয়কে কলকাতার অপরিচিত নানান জায়গা ঘুরিয়ে দেখানোর বরাত দিলেন পার্থকে। সঙ্গে অনর্গল ইতিহাস। সেখান থেকেই শুরু। তারপর একের পর এক মানুষ এই পায়ে হেঁটে কলকাতা দেখার কোর্সটা করতে চান। তাঁরা নিয়মিত পার্থর সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ রাখেন। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে রীতিমত বাড়ছে সেই উৎসাহীদের সংখ্যা। পার্থ এই পেজের নাম দিয়েছেন, walks in Kolkata, নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বিদেশি এবং প্রবাসীরা। কলকাতায় এলেই ঘুরে দেখার জন্য যোগাযোগ করছেন।

বিদেশে বিভিন্ন শহর ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে ওয়াকিং ট্যুর সার্ভিস। অনুসন্ধিৎসুদের জন্য আদর্শ। জনপ্রিয়ও বটে। এদেশে এরকম সার্ভিস যারা দেন তাদের আমরা গাইড বলি। কিন্তু কলকাতার প্রাচীন ইতিহাসের যে অনুষঙ্গ নিয়ে পার্থর যাতায়াত সে কোনও গাইডের কম্ম নয়। তাই পার্থর মত টাইম মেশিন কলকাতায় চোখেই পড়ে না।

পার্থ অবশ্য শুধুমাত্র ট্যুরিস্টদের জন্য এই সুযোগ রাখেননি। কলকাতার সবাই অতীতকে জানুক দশটা পাঁচটা কাজের ফাঁকে, এটাই চাইছেন তিনি। যুক্ত করছেন শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। বইয়ের পাতা থেকে একটু বেরিয়ে এসে ইতিহাসকে জানার সুযোগ করে দিচ্ছেন তিনি। এ যেন চিরাচরিত ক্লাসরুমের বাইরে বেড়াতে বেড়াতেই ক্লাসরুম। ইতিমধ্যেই শহরের একটি প্রথমসারির স্কুল তাদের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কয়েক ঘন্টার জন্য পার্থর সঙ্গে ঘুরেছে। যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে পড়ুয়াদের মধ্যে। শিক্ষকরাও রীতিমতো উৎসাহ দিয়েছেন, জানালেন পার্থ। আরও কিছু প্রতিষ্ঠান বিষয়টা নিয়ে প্রাথমিকভাবে আগ্রহী। পার্থ'র কর্মকান্ড দেখে একাধিক ট্র্যাভেল এজেন্ট, ট্যুর অপারেটররা যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। জনপ্রিয় অনলাইন বুকিং পোর্টাল বুক মাই শো'তেও টিকিট পাওয়া যাচ্ছে পার্থসারথির ওয়াকিং ট্যুরের।

পরের পরিকল্পনাও তৈরি। ভারচ্যুয়াল হেরিটেজ ট্যুর তৈরির প্রাথমিক একটা খসড়ার কাজে একটু একটু করে নিজেই হাত লাগিয়েছেন। শেষ হতে এখনও ঢের দেরি। ফেসবুক পেজ থেকে এবার পুরোদস্তুর নিজস্ব ওয়েবসাইট চালু করতে চান। সঙ্গে থাকবে অনলাইন পেমেন্টের ব্যবস্থা।কলকাতার সঙ্গে গোটা রাজ্যের বিভিন্ন শহরে নিজের কর্মকাণ্ডকে ছড়িয়ে দিতে চাইছেন পার্থ। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং পরিবেশকে ভিত্তি করে পার্থর সফল্যের রথ ছুটছে। অক্লান্ত পার্থ বলছেন সাফল্য পেতে এখনও অনেক রাস্তা হাঁটতে হবে। যে পথ টাইমমেশিনে পাড়ি দেওয়া যায় না। রীতিমত ঘাম ঝরিয়ে পেরতে হয়।