অস্তিত্বের লড়াই লড়ছে বাংলা ক্যালেন্ডার
Saturday April 15, 2017,
3 min Read
পয়লা বৈশাখ মানে বছরের প্রথম দিন। হালখাতা। নতুন জামা। মিষ্টিমুখ। প্রভাতফেরি। গানে গানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ফলাও প্রচার। যদিও হিন্দুদের পুজো-আচ্চার দিন। হিন্দু ব্যবসায়ীদের গণেশ পুজো। তেমনি মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে এই দিনটা উৎসব। সকাল থেকেই বর্ষবরণের ধূম পড়ে যায়। হিজরি সালের প্রথম দিন নয়। বাংলা সালের প্রথম দিন। বাংলা আমার মাতৃভাষা। বাংলার সংস্কৃতি আমার সংস্কৃতি এই জেনে দুই বাংলা এক হয়ে যায় এই দিন। তিস্তা না তোর্সা তা নিয়ে যতই মতভেদ থাক। শেখ হাসিনা না খালেদা জিয়া যতই মন কষাকষি থাক। সিপিএম না তৃণমূল যতই মতপার্থক্য থাক। পয়লা বৈশাখ সকলের। দুপুরে কাগজি লেবু দিয়ে সোনামুগের ডাল ভাজা ভাত। পাতে, মাছের নানান পদ, মাংসের ঝোল। খাওয়ার পর আইসক্রিম। দই। রসমালাই। পান সুপারি। সুরভী জর্দার ফুরফুরে গন্ধ।
এসবের ফাঁকে কখনও কেউ কোনওদিন ভাবেনি নববর্ষ হিন্দুদের না মুসলিমদের। নববর্ষ বাংলার। বাঙালিদের। ধর্ম জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে উৎসব। কলকাতার রাস্তাতেও নেমেছিল সম্প্রীতির মিছিল। মফঃস্বলের অলিতে গলিতেও বেজেছে সম্প্রীতির গান। এই রেওয়াজ দীর্ঘদিনের।
আরেকটি জিনিস এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। সেটি রানি রঙের মলাটে ঢাকা হাফ পঞ্জিকা, ফুল পঞ্জিকা। নানান ব্র্যান্ড। নানান মতবাদ। নানান দলাদলি। কেউ মানেন বেনীমাধব শীল, পি এম বাগচী-কে ধ্রুবতারা। কেউ কেউ বিশুদ্ধ সিদ্ধান্তের মতেই স্থির থাকেন। ফলে সিদ্ধান্তে সকলে এককাট্টা নন। কিন্তু উৎসবে উদ্দীপনায় সকলেই এক। নেট-জেটের যুগেও পঞ্জিকার তাই দারুণ কাটতি। বেশ কয়েকটা পঞ্জিকার অ্যাপও ডাউনলোড করার জন্যে তৈরি। দেশের রাজনৈতিক সীমা পেরিয়ে এই অ্যাপগুলি বাংলাদেশ, ভারত, আবু ধাবি, ইউরোপের বাঙালিরা ডাউনলোড করছেন।
পাশাপাশি ছাপাও হচ্ছে পঞ্জিকা। ফি বছর কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা হয় পঞ্জিকার। হিন্দু ধর্মীয় আচারের সঙ্গে পঞ্জিকা যেন ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। তাই বাজারও নির্দিষ্ট। বিক্রিও নিশ্চিত। একটা সময় লাইন পড়ত পঞ্জিকা কেনার। চৈত্র মাসে তো নৈবচ। কিনতে হলে কেবল পয়লা বৈশাখ কিংবা তার পর। দারুণ বাজার বাংলা ক্যালেন্ডারেরও। কিন্তু তাতে সামান্য রূপভেদ ঘটেছে। তাই জানতেই আমরা ঘুরে এলাম ভিস্তি পাড়া। কথা হল ক্যালেন্ডার এবং পঞ্জিকার বিক্রেতাদের সঙ্গে। বেরিয়ে এলো একটি সত্য।
সেন্ট্রাল এভিনিউ-এম জি রোড ক্রসিংয়ের কাছে ভিস্তি পাড়া। স্বাধীনতার পর থেকে এখানে মূলত বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরি হয়ে আসছে। প্রথমে একটি একচালা টালির বাড়িতে এই ক্যালেন্ডার তৈরির কাজ চলত। পরবর্তীকালে চাহিদা বাড়ায় ব্যবসারও বাড়বাড়ন্ত হয়। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই ক্যালেন্ডার বিক্রি হলেও, সেই সময়ে এতো চাহিদা থাকত যে সেই লাভে সারা বছর ভালো করেই কেটে যেতো ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষজনের। ‘সারা বছর ধরে ডিজাইন ভাবতাম। আরও কত আকর্ষণীয় করা যায়। বদলে যাওয়া রুচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কখনও ছবি ক্যালেন্ডারের কদর তৈরি হয়েছে কখনও আবার পঞ্জিকা ক্যালেন্ডার নিয়ে মাতা মাতি করেছেন গ্রাহক। এখনও অর্ডারের পাহাড় জমে।’ বলছিলেন ছাপাখানার মালিক জয়ন্ত মল্লিক।
তবে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল জয়ন্তর কথায় যে যত সময় এগোচ্ছে ততই কমছে বাংলা ক্যালেন্ডারের চাহিদা। কারও মতে, আজকাল সুসজ্জিত ফ্ল্যাটের দেওয়াল নষ্ট করতে চান না অনেকেই। তবে গ্রামের দিকে বাংলা ক্যালেন্ডারের চাহিদা আছে। মিষ্টির প্যাকেটের সঙ্গে ক্যালেন্ডার চাই সবার, না হলেই মুখভার, হেসে বলেন ক্যালেন্ডার ব্যবসায়ী শিবু চন্দনি। পয়লা বৈশাখের সময়ে খদ্দেরদের বাংলা ক্যালেন্ডার সঙ্গে মিষ্টি দিয়ে হালখাতা করেন ব্যবসায়ীরা। তবে এবছর ব্যবসা খানিকটা মন্দা। খুচরো ব্যবসায়ীরা আগে যেখানে এক হাজার পিস ক্যালেন্ডার নিতেন, সেখানে অনেকেই মাত্র কয়েকশো পিস ক্যালেন্ডার নিচ্ছেন। তবে এখনও পঞ্জিকা ক্যালেন্ডার কিংবা গ্লিটার চুমকি দিয়ে দেবদেবীর ক্যালেন্ডার নিতে ভিড় যে একেবারে নেই তা নয়। পাশাপাশি ক্যালেন্ডার প্রস্তুতকারীরা অভিজাত ফ্ল্যাটের আবাসিকদের জন্য স্মার্ট টেবিল ক্যালেন্ডারও তৈরি করছেন আজকাল। যেন তেন প্রকারেণ এই শিল্পটা বাঁচাতে মরিয় ছাপাখানাগুলি।