ক্রাউড ফান্ডিং এখন স্টার্ট আপ উদ্যোগগুলির শুরুর রশদ হিসেবে নতুন ট্রেন্ড। এক কথায় ব্যাপারটা যেন লাগে টাকা দেবে গৌরী সেনের মতো। গৌরী সেনটি আর কেউ নন - জনতা। জনতার কাছ থেকে ব্যবসার জন্যে টাকা তুলে ওই ব্যবসা চালানোর যে নয়া পদ্ধতি - তারই নাম হল ক্রাউড ফান্ডিং।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতিতে নয়া উদ্যোগগুলির ক্ষেত্রে উদ্যোগপতিরা বাজার থেকে টাকা তোলেন। ব্রিটেনে এই পদ্ধতি ব্যাপক হারে চালু রয়েছে। পাশাপাশি এর চল রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও।
উদাহরণ দেওয়া যাক। তবে এমন উদাহরণ অনেকই রয়েছে। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে কলবরে না বাড়িয়েও দেখা যেতে পারে কয়েকটি ক্ষেত্রে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের ফলে ঠিক কী ঘটেছে। কী পরিমাণ টাকা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তোলা হয়েছে। আর শেষপর্যন্ত তার পরিণতিই বা কী হয়েছিল।
চলতি বছরের জুনের ঘটনা। লন্ডনের একটি ফুড ডেলিভারি স্টার্ট আপ সংস্থার ব্যবসা চালানোর জন্যে টাকার দরকার পড়েছিল। ওরা ক্রাউড ফান্ডিংয়ের রাস্তা বেছে নেয়। এ জন্য Seedrs নামে একটি অনলাইন ওয়েব সাইট চালু করা হয়। টাকা তোলা হয় ওই ওয়েব সাইটে আবেদন জানিয়ে। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তোলা হয়েছে ৭ লক্ষ পাউন্ড বা ৮ লক্ষ ৭৫ হাজার ডলার। ফুড ডেলিভারির ওই স্টার্ট আপ সংস্থাটির নাম Pronto।
সাধারণত নতুন উদ্যোগগুলিতে টাকা ঢেলে থাকেন সিড ফান্ডিংয়ের অ্যাঞ্জেলরা কিংবা ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা। কিন্তু যখন ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট নেই, সেক্ষেত্রে এই পথে টাকা তোলা হয়। তবে অনেকক্ষেত্রে টাকা তোলার পরেও কিন্তু ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কর্তারা সা্ফাই দেন, আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, শেষপর্যন্ত আমরা পারলাম না। ব্যস, এটুকুই মাত্র! যাঁরা টাকা ঢেলেছিলেন তাঁদের টাকা ফিরত পাওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু এসব ক্ষেত্রে একেবারেই শূন্য।
ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে টাকা তোলা এবং তারপর কম্পানির অপারগতার কথা জানিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলা – গোটা ব্রিটেন জুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এরকমটা ব্যাপকভাবেই ঘটছে। যেমন ৪ লক্ষ পাউন্ড তোলার পরে বন্ধ হয়ে গেল লন্ডনের পোশাক নির্মাতা সংস্থা Earlybird কিংবা ১ লক্ষ ৫০ হাজার পাউন্ড তোলার এক বছরের ভিতর বন্ধ হয়ে গিয়েছে Hen Restaurants।
ইক্যুইটি ক্রাউড ফান্ডিংয়ে গুগল, ফেসবুকের দেখানো রাস্তা ক্রমে উদ্যোগপতিদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে টাকা তোলার জন্যে অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে। মানুষজন যাঁরা মুক্তহস্তে দান করেন, তাঁরা চান একটি নতুন সংস্থার সঙ্গে জড়িত থাকতে। এর জেরেই তাঁরা টাকা দিয়ে থাকেন। বলাবাহুল্য, অনেক ক্ষেত্রে এসব মানুষের স্বপ্ন বা উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। টাকাটা বরং জলে যায়।
পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ব্রিটেনে নতুন উদ্যোগগুলির ক্ষেত্রে শুরুতে ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ আসে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে। এর প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। গত বছর এভা্বে বিনিয়োগ হয়েছে ৩৩২ মিলিয়ন। লাফিয়ে লাফিয়ে পরিমাণটা আরও বেড়ে চলেছে। ২০১১ সালে ব্রিটেনে এভাবে টাকা তুলেছে ১ হাজার স্টার্ট আপ।
তবে ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ আর্থিক সঙ্কট তৈরি হওয়ায় এবং ব্রেক্সিটের প্রভাবে ক্রাউড ফান্ডিংয়ে ধাক্কা লেগেছে। গত তিন মাসে এর পরিমাণ ২০ শতাংশ কমেছে বলে জানা গিয়েছে।
শতাধিক স্টার্ট আপকে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহায়তা করেছে এমন এক স্টার্ট আপ কনসালটেন্টের উপদেষ্টা আদম ওসকওয়ারেকের কথায়, সত্যি কথা বলতে গিয়ে অনেক সময়ই যাবতীয় তোড়জোড় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শে্ষমেশ হয়তো কিছুই হল না। আসলে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের পরবর্তী ক্ষেত্রে কী ঘটবে, সেটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার।
তবে ক্রাউড ফান্ডিং প্লাটফর্মগুলি যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁরা কিন্ত মনে করেন, বেদবাক্য বলে কিছুই নেই। শেষকথা বলবার সময় এখনও আসেনি। পৃথিবীর প্রথম ও সবচেয়ে বড় ইক্যুইটি ক্রাউড ফান্ডিং সাইট Crowdcube-এর অন্যতম কর্তা দারেন ওয়েস্টলেক বলছেন, বিনিয়োগ করেন যাঁরা তাঁরা জেনে বুঝেই ঝুঁকিটা নেন। এক্ষেত্রে ওই সংস্থার সাফল্যের থেকে ব্যর্থতার সম্ভাবনা বেশি জেনেই কাজটা তাঁরা করে থাকেন। তবে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের বিকল্প হয়ে উঠেছে অনলাইনের মাধ্যমে তহবিল গড়ে তোলাটা।
Crowdcube-এর প্রতিষ্ঠাতা কাজ করতেন একটি টেলিকম্যুনিকেশন সংস্থায়। Kickstarter নামে একটি ক্রাউড ফান্ডিং সংস্থার দুনিয়া জুড়ে জনপ্রিয়তা প্রত্যক্ষ করে ২০১১ সালে ওয়েস্টলেক আর লুক ল্যাং Crowdcube-এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে ওঁরা বলেছেন, আমরা ভেবে অবাক হচ্ছি, এত সম্ভাবনাময় কাজটা কেন যে আমাদের আগে কেউ করলেন না! লন্ডনে বেশ কয়েকটি স্টার্ট আপের ক্রাউড ফান্ডিং সফলভাবে করেছে Crowdcube। এ জন্য তারা যে কৌশল নিয়েছিল, তা হল সারা শহর বিজ্ঞাপনে ছেয়ে ফেলা। আর তাতে কাজও হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্রাউড ফান্ডিং করে টাকা তুলে দেওয়ার মজুরি হিসাবে Crowdcube নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা কেটে নেয়।
তবে বেশ কিছু সংস্থার ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, ক্রাউড ফান্ডিংয়ের পরেও সেগুলি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ওই সংস্থাটি বিক্রি হয়েছে কয়েক গুণ বেশি টাকায়। যেমন ধরুন, E-Car Club সংস্থাটির উদাহরণ। এটি তার আসল দামের চেয়ে তিনগুণ বেশি দামে বিক্রি হয়ে গিয়েছে।
তবে সংস্থায় যাঁরা বিনিয়োগ করছেন, তাঁরা যে ৫ থেকে ৭ বছরের আগে লাভের মুখ দেখতে পাবেন না এটাই শর্ত। ক্রাউড ফান্ডিং প্লাটফর্ম Seedrs বাজারে এটা সাফসুতরোভাবে জানিয়েই টাকা তুলে থাকে। তবে সবক্ষেত্রে যে বিনিয়োগকারীরা সব তথ্য বিনিয়োগের আগেভাগে স্পষ্টভাবে জানতে পারছেন এমনও নয়।
আসলে ক্রাউড ফান্ডিং ব্যাপারটাই যেন এক রহস্য। ব্রিটিশ অভিনেতা বিল নাই ব্লগ লেখেন। ট্রুথ অ্যাবাউট ইক্যুইটি ক্রাউড ফান্ডিং নামে একটি ব্লগ। স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা বিল নিজের বাড়ি থেকেই সেটি চালান। বিল লিখছেন, লাভের আশায় একটি রফতানিকারক সংস্থায় তিনি কিছু টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। শেষপর্যন্ত গোটাটাই মাঠে মারা গিয়েছে। সংস্থা তার একটি পয়সাও ফিরত দেয়নি।
আসলে ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে ক্রাউড ফান্ডিং একটি সহজ পদ্ধতি। ২০১৫ সালে এভাবে Waterbabies the Musical নামে একটি প্রোডাকশন সংস্থা ১ মিলিয়ন পাউন্ড তুলে নিয়েছে। উদাহরণ আরও অনেকই আছে। ২০১৬ সালে Solar Cloth Company বাজার থেকে ১ মিলিয়ন পাউন্ড তুলে নেওয়ার ১৮ মাসের মধ্যে কারবার বন্ধ করে দিয়েছে। সে বছরই ঘড়ির খুচরো বিক্রেতা Orsto অনলাইনে ৬০ হাজার পাউন্ড তুলেছিল।
তবে এই ডামাডোলের জেরে ব্রিটিশ সরকার নতুন আইনি নিয়ম চালু করতে চলেছে। যাতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থও খানিক সুরক্ষিত থাকে। ব্রিটিশ সরকারের এক মুখপাত্র এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ক্রাউড ফান্ডিংয়ে টাকা রাখার যে ঝুঁকি আছে, সেটা জেনেবুঝে কেউ বিনিয়োগ করলে কিছু বলার নেই। তবে ঝুঁকিটা যে কতটা সেটাই আমরা জামিয়ে দিতে চাই।
আবার Pronto-এর মতো সংস্থা ক্রাউড ফান্ডিংয়ের পরে নিজের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে পারেনি। এমন ব্যর্থতা কিন্তু সামগ্রিকভাবে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের ব্যর্থতা নয়। ফুড ডেলিভারি্র এই সংস্থার সিইও পরে একটি স্টার্ট গড়েছেন। ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে টাকা তুলেছেন। আর নিজের ব্যবসায় সাফল্যের মুখও দেখেছেন।