যাঁরা বলেন ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে, তাঁরা ভুল বলেন। শুধুমাত্র সকালের আলোটুকু দেখেই যে গোটা দিনটার আঁচ করা যায় না তা প্রমাণ করলেন কেরলের মহম্মদ আলি শিহাব। তাঁর শৈশবের আকাশে নিরাশার নিকষ কালো মেঘ, আর যৌবনে ঝলমলে সূর্য। ছোটবেলায় পিতৃহীন যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ দেখে হয়তো অনেকেরই মনে হত এ গল্পের নাম রাখা যেতে পারে ‘একটি সম্ভাবনার মৃত্যু’। সত্যিই তো হতদরিদ্র পরিবার, টানাটানির অথৈ দরিয়ায় যে মাঝি সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন তিনিই যদি না থাকেন, তবে তা সব শেষ! যাঁরা ভেবেছিলেন বিধাতা বুঝি মেধাবী শিহাবের সম্ভাবনাময় জীবনীর গল্পে উপসংহার টেনে দিয়েছেন তাঁরা ভুল ভেবেছিলেন। পিতৃহীন ছেলে শিহাব, অনাথ আশ্রমে প্রতিপালিত শিহাব, আইএএস পরীক্ষায় হয়ে উঠেছেন দেশের হাজার, লক্ষ, কোটি ছেলে-মেয়ের কাছে আদর্শ।
কেরলের মালাপ্পারম জেলার আধা শহর, আধা গ্রাম এডাভান্নাপ্পা। শান্ত। নিস্তরঙ্গ। ছোট্ট এক পান দোকান চালিয়ে কোনওরকম সংসার চালাতেন শিহাবের বাবা। শৈশবে এবিসিডি-র পাশাপাশি শিহাব শিখেছিল পানের খিলি সাজতে। পড়ার ফাঁকে দোকান, কাজের ফাঁকে পড়া – এই করে এগোচ্ছিল রোজনামচা। কিন্তু আচমকাই গল্পে নিদারুণ মোড়। পিতার মৃত্যু। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত! পড়াশোনা দূরের কথা, পেট চালানোই তখন ছেলে আর মায়ের কাছে একমাত্র চিন্তা। একরকম বাধ্য হয়েই শিহাবকে তাঁর মা পাঠিয়ে দিলেন অনাথ আশ্রমে।
নতুন জায়গা। অচেনা পরিবেশ। পড়ার বই নিয়ে বসলেই কেবলই মনে পড়ে বাবার কথা। ক্লাস ফাইভের পরীক্ষায় ডাঁহা ফেল। সেদিনের ভয়ঙ্কর ধাক্কা খেয়ে কি পাল্টা ধাক্কা দেওয়ার কথা মাথায় এসেছিল? শিহাবের জবাব, ‘‘সেই থেকেই শুরু। ডুব দিলাম পড়াশোনার সমুদ্রে। সব্বাই যখন ঘুমাতো, আমি পড়তাম।’’
অনাথ আশ্রমের ডরমিটারিতে একের পর এক খাদ। ‘‘অন্যদের যাতে অসুবিধা না হয় সেজন্য বেডকভারের নীচে ঢুকে হালকা আলো জ্বেলে পড়তাম। পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়তাম।’’ হাসতে হাসতে শিহাব বলছিলেন, ‘‘রাত জেগে পড়ে অনাথ আশ্রমের নিয়ম ভেঙেছিলাম ঠিকই, কিন্তু তার সুফলও পেয়েছি।’’
দূরশিক্ষার কার্য্যক্রমে ইতিহাস নিয়ে স্নাতক হওয়ার পর চাকরির পরীক্ষা। রেলের টিকিট চেকার, জেল ওয়ার্ডেনের মতো ২১টি সরকারি চাকরির পরীক্ষায় সফল হওয়ার পর শিহাব ঠিক করলেন যে তিনি ইউপিএসসিতে বসবেন। ‘আইএএস যে সহজ কথা নয়, তা আমি জানতাম। কিন্তু এও জানতাম চেষ্টায় সব হয়। অনাথ আশ্রম থেকে সাহায্য মিলল। উত্সাহ মিলল। আর আমি আরও একবার ডুব দিলাম বইয়ের পাতায়।’’ এক নাগাড়ে অনেকটা বলে থামলেন শিহাব।
লক্ষ্যভেদী অর্জুন দেখেছিলেন পাখির চোখ, আর শিহাবের চোখে শুধুই আইএএস। কোচিং, হাজারো প্রশিক্ষণ না নিলে যে পরীক্ষায় সফল হওয়া যায় না, সেই ইউপিএসসিতে শিহাবের স্থান ২২৬। ক্লাস ফাইভে ফেল করেও অনাথ আশ্রমের হট্টগোলের মধ্যেও যে আইএএসে সুযোগ পাওয় যায় তা প্রমাণ করেও শিহাব শান্ত। স্থিতধী। সাফল্যের পরও মুখে সংযত হাসি। বলছিলেন, ‘‘অনেক নীচু থেকে উঠে এসেছি। যারা পিছিয়ে রয়েছেন তাঁদের জন্য যদি কিছু করতে পারি তবেই নিজেকে সফল বলে মনে করব।’’
বলতেই হচ্ছে, সাবাশ শিহাব। তু সি গ্রেট হো।