চেন্নাইয়ে উদ্ধার অভিযান, পিছিয়ে থাকল না স্টার্টআপও

চেন্নাইয়ে উদ্ধার অভিযান, পিছিয়ে থাকল না স্টার্টআপও

Saturday December 19, 2015,

5 min Read

বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা (disaster management) কতটা জরুরি ফের তা সামনে এনে দিয়েছে চেন্নাইয়ের ভয়াবহ বন্যা। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি স্টার্টআপ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। উত্তরাখণ্ডে ২০১৩ সালের বন্যা কিংবা ২০১৫ সালে নেপালে ভূমিকম্পের সময় নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েছে সংস্থাগুলি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় যে সব স্টার্টআপ প্রশাসনকে সহযোগিতা করছে, তল্লাশি অভিযানে সামিল হচ্ছে, ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে ইয়োর স্টোরিতে আজ তাদের কাহিনি।


image


সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলির সময় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে এভিয়েশন (বিমান, হেলিকপ্টার চলাচল) ক্ষেত্রের স্টার্টআপগুলি। সাধারণ হেলিকপ্টার যে কোনও জায়গায় নামতে পারে না। কিন্তু ড্রোন হেলিকপ্টারের (UAV বা Drones) সে সমস্যা নেই। দুর্গম দুর্ঘটনাস্থল থেকেও উচ্চমানের ছবি পাঠাতে পারে ড্রোন-ক্যামেরা। ড্রোন সরবরাহকারী মুম্বইয়ের AirPix সংস্থায় সহ-প্রতিষ্ঠাতা সিনিল শেখর বললেন, "বিপর্যয় মোকাবিলায় অনেক সহায়তা করতে পারে ড্রোন। প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার সময় ড্রোন ব্যবহার খুব একটা জটিল কিছু নয়। কর্তৃপক্ষ ও জনসাধারণ, সবাই এর ফলে উপকৃত হয়।"

উত্তরাখণ্ডে ২০১৩ সালে ভয়াবহ বন্যার সময় উদ্ধারের কাজে 'জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকে (National Disaster Response Force বা NDRF) সহায়তা করেছিল আইডিয়া ফোর্জ (ideaForge)। আইডিয়া ফোর্জের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অঙ্কিত মেহতা বললেন, "উত্তরাখণ্ডে বন্যার সময় আমরা UAV ওড়াতে দু'টি দল পাঠিয়েছিলাম। কারণ প্রশাসনের এ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ছিল। তারা যতটা সম্ভব চেষ্টা করছিল। পাশাপাশি আমরা বন্যার্ত পুরো এলাকার ছবি প্রশাসনের কাছে তুলে ধরেছিলাম। ফলে বিপর্যস্তদের ত্রাণ ও উদ্ধার সহজ হয়েছিল।"

একসময় আইডিয়া ফোর্জে থাকা অমরদীপ সিং এখন NexGear-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। সেই অমরদীপ জানালেন এই ধরনের প্রযুক্তির ফলে উদ্ধারের কাজে কম লোক লাগে, সময়ও বাঁচে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বললেন, "স্থানীয় প্রশাসনকে বিভিন্ন দফতরকে কাজে লাগাতে হয়। ফলে সমন্বয়টা খুবই জরুরি। কিন্তু আমাদের UAV শুরু থেকেই দুর্গতদের সন্ধান করতে থাকে। একবার সন্ধান মিললেই সবচেয়ে কাছাকাছি এলাকায় হেলিকপ্টার পাঠিয়ে উদ্ধার অভিযান চালান হয়।" ২০১৪ সালে আইডিয়া ফোর্জের থেকে উদ্ধার-সামগ্রী কেনে এনডিআরএফ। শুধু উত্তরাখণ্ড নয়, পরবর্তী সময়ে পুনের কাছে এক ধসের ঘটনাতেও তল্লাশি অভিযানে সামিল হয়েছিল আইডিয়া ফোর্জ। মালিন গ্রামে সেই ধসে মাটির নিচে চাপা পড়েছিলেন প্রায় দুশোজন। "এই ধরনের কাজে ড্রোন ব্যবহার করলে কী হয়, কোন দিকে এগোলে সুবিধা সেটা সহজেই বোঝা যায়", বললেন অমরদীপ।

Drona Aviation-এর CEO অপূর্ব গোড়বোলে। এখনও পর্যন্ত ড্রোনা এভিয়েশন কোনও উদ্ধার অভিযানে অংশ না নিলেও মুম্বই ফায়ার ব্রিগেডের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই কাজ করে থাকে। উদ্ধার অভিযানে তারা কী ভাবে সহায়তা করতে পারে তা নিয়ে বিভিন্ন সময় সরকারি দফতরগুলির সঙ্গেও আলোচনা করেছে সংস্থা। অপূর্ব মনে করেন, বিপর্যয় মোকাবিলায় আরও বেশি অ্যাপ্লিকেশন বা অ্যাপস দরকার। তাদের UAV কীভাবে চালাতে হয়, তার জন্য দমকল বাহিনীর কয়েকজনকে প্রশিক্ষণও দিয়েছে ড্রোনা। তথ্য (intelligence) সংগ্রহের জন্য বর্তমানে নজরদারি ড্রোন নিয়ে কাজ করছে অপূর্বর সংস্থা।

উত্তরাখণ্ডে বন্যার সময় ডেটা কালেকশনের কাজে সহায়তা করেছিল AirPix. সিনিল বললেন," একটা পয়েন্টের পরে মিডিয়াকে আর ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ফলে কী হয়েছিল, এনজিও'রা ত্রাণের কাজে পর্যাপ্ত ফান্ড পাচ্ছিল না। আমরা তখন দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন সব এলাকা থেকে দুর্গতদের ছবি ও খবর পাঠাতাম। যা এনজিও'দের কাজে লেগেছিল।" একইসঙ্গে সিনিলের সংযোজন," বৃষ্টি হলে কিন্তু UAV ব্যবহার করে লাভ নাও হতে পারে। আসলে তখন দৃশ্যমানতা কমে যায়। বৃষ্টি থামার পরেই ছবি তোলা সহজ হয়। আমরা তখন একটা এলাকার থ্রি ডি রিকন্সট্রাকশন করি এবং সংগৃহীত ডেটাকে কাজে লাগিয়ে জল বের করার পরিকল্পনা করি।

প্রযুক্তির যতই অগ্রগতি হোক না কেন, চেন্নাইয়ের বন্যা দেখিয়ে দিয়েছে স্টার্টআপগুলির সীমাবদ্ধতা। ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী করা উচিত, সেটাও যেন বুঝিয়ে দিয়েছে। বাস্তবিক তাই হয়েছে। বিপর্যয় মোকাবিলায় আর কী কী করা উচিত তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিয়েছে সংস্থাগুলি। যেমন, তাদের ফ্ল্যাগশিপ প্রোডাক্ট 'নেত্র'(NETRA) কী ভাবে বিশাল এলাকা জুড়ে কাজ করতে পারবে, তার উন্নতিসাধনে লেগে পড়েছে আইডিয়া ফোর্জ। সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা অঙ্কিত মেহতা বললেন, "বর্তমানে আমাদের UAV-গুলো ৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে একটানা ৫০ মিনিট উড়তে পারে। আমরা এখন এমন প্রযুক্তি তৈরি করছি যাতে আকাশপথ ও সমতল, দু'ক্ষেত্রেই তল্লাশি চালাতে পারবে।" রয়েছে আরও একটা সমস্যা। বিপর্যয় ব্যবস্থাপনায় যাকে বলা হয় standard operating procedures (SOP)। চেন্নাইয়ে বন্যার সময় দেখা গিয়েছে অনুসরণ করার মতো কোনও এসওপি নেই। এ প্রসঙ্গেই অঙ্কিত বললেন,"জরুরি অবস্থার মোকাবিলায় কোনও এসওপি না থাকলে কাজ করাটা ভীষণ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।"

বিপর্যয়ের সময় বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয় কানেক্টিভিটি বা যোগাযোগ। টেলি-সংযোগ ঠিকমতো না মেলায় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী ও উদ্ধারকারী দল নিজেদের মধ্যে তথ্যের আদানপ্রদান করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে টেলিকম সংস্থাগুলি দ্রুততার সঙ্গে মোবাইল টাওয়ার ও সিগন্যালের ব্যবস্থা করা উচিত বলেই মনে করেন অমরদীপ। তাঁর সঙ্গে একমত ডেটা এগ্রিগেটর SocialCops-এর সহ-প্রতিষ্ঠাত্রী প্রুকল্পা শঙ্কর। তিনি বললেন," ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি ছাড়াও যাতে কাজ করা হয় সে জন্য আমরা তৈরি করেছি ‘Collect’ অ্যাপ। এ জন্য খুব বেশি মেমরি লাগে না। তথ্য সংগ্রহের কাজে কম দামি ফোনেও এই প্রযুক্ত কাজে দেয়।" প্রুকল্পা আর একটি বড় সমস্যার দিকেও নজর দিতে বললেন। সেটা হল ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছনোর জন্য ট্রান্সপোর্টেশন বা পরিবহণ। কী হতে পারে এর সমাধান? প্রুকল্পা বললেন, "দেশজুড়ে এখন ই-কমার্স লজিস্টিক গড়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, মহারাষ্ট্রের প্রান্তিক এলাকাতেও জিনিস পৌঁছে দিচ্ছে অ্যামাজন। সেই ধরনের সাপ্লাই-চেন কাজে লাগিয়ে কিন্তু সমস্যা মেটান যায়।"

ইয়োর স্টোরির সংযোজন

বিপর্যয়ের পরে সমাধানের খোঁজ কোনও কাজের কথা নয়। চেন্নাইয়ের বন্যা সেই প্রশ্নই তুলে ধরেছে। অমরদীপ একটা খুব জরুরি পয়েন্ট তুলে ধরেছে। বিপর্যয় ব্যবস্থাপনায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যতটা জরুরি, ঠিক ততটাই জরুরি সেই সব জিনিস যেন স্থানীয় স্তরেও থাকে। শুধুমাত্র এনডিআরএফের সদর দফতরে উদ্ধার সামগ্রী থাকলে চলবে না।

বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা ও উদ্ধার সামগ্রীর কনসালট্যান্ট হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করছেন পুনের রাজেন্দ্র লাদকাত। সেই রাজেন্দ্র মনে করেন, বিপর্যয়ের সময় দুর্গতরা সবাই, এমনকী শিশুরাও, প্রাণ বাঁচানোর উপযোগী জিনিস বানিয়ে ফেলতে পারে। এ জন্য দরকার সচেতনতা। রাজেন্দ্র বললেন, "ভূমিকম্প কিংবা ধসের সময় কী করা উচিত তা নিয়ে স্কুল ও অফিসে সচেতনতা কর্মসূচি থাকা উচিত। চেন্নাইয়ে যদি এমনটা করা হোত, মানুষ এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হোত না।" নাসিকে কুম্ভ মেলা, উত্তরাখণ্ডে বন্যা, নেপালে ভূমিকম্পের সময় রাজেন্দ্রর 'সঞ্জীবনী' কিট ব্যবহার করেছে National Disaster Response Cell. এই কিটের মধ্যে থাকে একটা কার্বন মাস্ক, একটা নেক বেল্ট-ছাড়াও কয়েকটি জরুরি জিনিস। রয়েছে ফ্লোটিং স্ট্রেচার। এই স্ট্রেচারের সাহায্যে মৃতদেহটি মুড়ে তা ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।

বিপর্যয়ের সময় কী কী থাকা উচিত তা তুলে ধরা হল। একমাত্র সরকারি দফতরগুলিরও সেই ক্ষমতা রয়েছে যাতে এগুলি বাস্তবায়িত হতে পারে। বিপর্যয়ের সময় স্টার্টআপগুলি এগিয়ে এসেছে। জরুরি কিছু প্রশ্নও তুলে ধরেছে। সরকার কি তা শুনতে পাচ্ছে?

লেখা - অথিরা নায়ার