পাচার হওয়া সুন্দরবনের মেয়েটা এখন আগলে রাখেন অন্যদের

সুন্দরবনের পাচার হওয়া অষ্টাদশী তরুণী এখন শিশু অধিকার রক্ষা আন্দোলনের এগিয়ে থাকা একজন সেনানী

পাচার হওয়া সুন্দরবনের মেয়েটা এখন আগলে রাখেন অন্যদের

Saturday October 08, 2016,

3 min Read

সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকার এক অনুন্নত গ্রামের মেয়ে আনোয়ারা খাতুন নিজেই একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন। সারা পৃথিবীতে যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের অধিকার আদায়ের জন্যে আন্দোলন করছে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত সুন্দরবনের মেয়ে আনোয়ারা তাঁদের মতোই একজন নেত্রী। 
image


কাজের লোভ দেখিয়ে অথবা বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শিশু বা কিশোর-কিশোরীদের পাচার করে দেওয়াটা একটি জঘন্য ধরনের অপরাধ। ভারতে এটাই এখন একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। যার শিকার অপ্রাপ্তবয়স্ক বহু কচি ছেলেমেয়ে। সারা বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলির দরিদ্র পরিবারের নাবালক বা নাবালিকারা হামেশাই পাচার হচ্ছে। পাচারের পরে ভোগ করতে হচ্ছে অকথ্য অত্যাচারের জীবন। ফলে ফুলে্র মতো বয়সে, জীবনের সাজানো বাগানের স্বপ্ন দেখার বয়সে স্বপ্নগুলি ছারখার হয়ে যাচ্ছে। শিশুরা তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের অতলে।

আনোয়ারার পিছনে ফেলে আসা জীবনটা নিপীড়ন ও দুর্দশার। কৈশোরে পাচার হয়েছিলেন আনোয়ারা। ১৮ বছরের মেয়ে আনোয়ারা এই জীবন দেখে এসেছেন। নিজেও ছিলেন অপরাধ চক্রের একজন শিকার। আর আজ তিনিই আগলে রাখছেন মেয়েদের। পাচারের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নেমেছেন। বর্তমানে শিশুপাচার রোধে গোটা দেশে যে আন্দোলন ও সচেতনতা বাড়ানোর কাজ চলছে, আনোয়ারা সেই আন্দোলনে একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী। ‌

ভারতের সীমানা পেরিয়ে আনোয়ারা একজন আন্তর্জাতিক কর্মীও বটে। ইতিমধ্যে দুদুবার রাষ্ট্রসঙ্ঘে বক্তব্য রেখেছে আনোয়ারা। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুন, বিল গেটস ও তাঁর স্ত্রী মেলিন্দা গেটসের সঙ্গে সশরীরে দেখা করেছে, তাঁদেরকে শিশুদের প্রতি অপরাধগুলি সম্পর্কে সচেতন করেছে উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালির প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা এই মেয়ে।সে এখন সত্যিই একজন নায়িকা। জীবনযুদ্ধের অন্ধকারের বিপক্ষে একজন সাহসিনী অষ্টাদশী।

আনোয়ারা বললেন, সারা পৃথিবীতে শিশু ও কিশোর-কিশোরদের সার্বিক পরিস্থিতি, তাদের অধিকার আদায়ে লড়াইয়ের কাহিনি জানার সুযোগ পেয়ে এবং আমার নিজের জীবন ও আমার গ্রামজীবনের কাহিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে বলবার সুযোগ পাওয়াটা আমার কাছে এক অসীম সৌভাগ্য। একজন সমাজকর্মী হিসাবে এই সুযোগলাভের পরে আমি যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ হয়েছি। নিজের কাজে প্রেরণাও পেয়েছি।

আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সেভ দ্য চিলন্ড্রেনের হয়ে কাজ করছে আনোয়ারা। রক্ষা পাওয়া নাবালক-নাবালিকাদের ৮০ টি দলের নেতৃস্থানীয় কর্মী আনোয়ারা সে। জীবনের অভিশাপের বিরুদ্ধে ওই নাবালক-নাবালিকারা শিশুশ্রম, পাচার, নাবালিকা বিবাহ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করছে। কালো দুনিয়ায় আলো ফোটানোর গুরুদায়িত্বটা নাবালক-নাবালিকারাই ১০ থেকে ২০জনের এক একটি দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। এও এক আশা করার মতোন দৃষ্টান্ত।

আনোয়ারার কাজের শুরুতে বাধা ছিল যথেষ্ট। গ্রামবাসীদের সচেতনতা বাড়াতে গিয়ে প্রথম দিকে ঔদাসীন্যেরও শিকার হয়েছিল সে। আনোয়ারা বলল, প্রথম দিকে ওঁরা আমার কথায় কোনও গুরুত্ব দিত না। বহু সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছে। গত বছর আনোয়ারা অংশ নিয়েছিল রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাস্টেনেবল ডেভলপমেন্ট গোল্ড সামিটে। আর গ্রামের লোকে এখন আনোয়ারার কথা মন দিয়ে শুনছে। এবছর আনোয়ারা রাষ্ট্রসঙ্ঘের জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে ভারতের শিশুদের তরফে প্রতিনিধিত্ব করেছে।

আনোয়ারা বললেন, আমি শিশু অধিকার রক্ষায় লড়াই করবার ব্রত নিয়েছি। প্রধানত কাজ দেওয়ার নাম করে কিংবা বিয়ে দেওয়ার নাম করে শিশুদের পাচার করা হচ্ছে। আমি নিজেও পাচার হয়েছিলাম। জানি শিকারে পড়া বাচ্চাদের যন্ত্রণা কতটা মর্মান্তিক।

ইতিমধ্যে নানা দেশের লড়াকু নাবালক বা নাবালিকা সমাজকর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সুযোগ পেয়েছে আনোয়ারা। অনেকক্ষেত্রেই ওদের যন্ত্রণালাভের অভিজ্ঞতা আরও বেশি তীব্র। ২৩ বছরের ইয়াজাদি তরুণী নাদিয়া মুরাদের কাহিনিটা তেমন। ইরাকের এই মেয়ে এখন রাষ্ট্রসঙ্ঘের গুডউইল অ্যাম্বাসাডার। আনোয়ারা নাদিয়ার গল্পটা বলতে গিয়ে জানাল, পাচারের বিরুদ্ধে নাদিয়া লড়ছে। জীবনে অনেক কিছু হারানো মেয়ে নাদিয়া আমার প্রেরণাদাত্রী।

বর্তমানে দুনিয়া জুড়ে কাজ করে চলা শিশু সমাজকর্মীদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক তৈরির কাজে হাত দিয়েছে আনোয়ারা। আনোয়ারা বলল, দেশ বা সীমানা আলাদা হতে পারে কিন্তু আমাদের সমস্যাগুলির চরিত্র একই রকমের।

(TCI)