ভারতে মহিলা হেনস্থার ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রতিদিনই রাস্তায় ঘাটে নানা ভাবে হেনস্থার শিকার হতে হয় তাঁদের। সরকারি খতিয়ান বলছে প্রতি ২০ মিনিটে ভারতে একজন মহিলা ধর্ষণের শিকার হন। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আফ্রিকার পর মহিলাদের ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি হয় ভারতেই। ভারতে সামাজিক লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে অনেক মহিলা ধর্ষণের রিপোর্ট পর্যন্ত দায়ের করেন না। লুকিয়ে যান সবকিছু। মহিলাদের এই অবস্থা থেকে বার করে এনে তাঁদের সচেতনতার পাঠ দিচেছ সেফসিটি নামে একটি সংস্থা। একদিকে মহিলাদের নির্দ্বিধায় পুরো ঘটনা জানান এবং নিজের সুরক্ষা সম্বন্ধে আরও সচেতন হওয়ার পাঠ দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম চালাচ্ছে তারা। সেইসঙ্গে তৈরি করছে একটি ম্যাপ। তাঁদের কাছে আসা খবরের ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন কোণার কোন কোন শহরের কোন কোন এলাকায় মহিলারা কি ধরণে অপরাধের শিকার হন তার একটি তলিকা প্রস্তুত করে চলেছে সেফসিটি। আর তা আগাম জানিয়ে রাখছে মহিলাদের।
সুইডেনে মহিলাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলা নিয়ে কাজ করছিলেন তিন মহিলা এলসা মারি ডিসিলভা, সুরিয়া ভেলমুরি ও সালোনি মালহোত্রা। কিন্তু ২০১২-এ দিল্লির বুকে ঘটে যাওয়া নির্ভয়া কাণ্ড সবকিছু বদলে দেয়। ওরা তিনজন ঠিক করেন মহিলাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করার চেয়েও আগে দরকার তাদের সুরক্ষা। সেই লক্ষ্যেই তাঁরা শুরু করেন সেফসিটি সংস্থা। ভারতে লিঙ্গভিত্তিক অত্যাচারের অভিজ্ঞতার কথা মহিলাদের মুখ থেকে শুনে তা লিপিবদ্ধ করতে শুরু করে সেফসিটি। তারপর তা দিয়ে ক্রমশ গড়ে তোলা হয় একটি অঞ্চল ভিত্তিক ম্যাপ। কোথায়, কখন ঘটনাটি ঘটেছে। কি ধরণের অপরাধ ঘটেছে অর্থাৎ ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা, শ্লীলতাহানি, কটূক্তি না অন্য কিছু তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জেনে তা ম্যাপে তুলতে শুরু করে সেফসিটি। যেমন, উদাহরণ হিসাবে সেফসিটি ম্যাপে দেখা যাচ্ছে দিল্লির কনট প্লেসে ভিড়কে কাজে লাগিয়ে মহিলাদের গায়ে হাত দেওয়া, ধাক্কা দেওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আবার দিল্লিরই রোহিনীতে মহিলারা সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের শিকার হন। আবার দিল্লির ওখলাতে মহিলদের উদ্দেশ্য করে টিকাটিপ্পনি, কটূক্তি, মোবাইলে মেয়েদের ছবি তোলার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। মহিলাদের দেওয়া অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ম্যাপে এই তথ্য তুলে ধরছে সেফসিটি। ফলে এসব এলাকার মহিলারা বা কেউ ওই এলাকায় গেলে আগাম সতর্ক থাকার সুযোগ পাচ্ছেন।
বর্তমানে সেফসিটি ভারত ও নেপালের ম্যাপিং করছে। কিন্তু আগামী দিনে বিশ্বজুড়েই এই কাজ করার পরিকল্পনা করেছে তারা। ইতিমধ্যেই ভারতের ৫০টি শহর থেকে ৪ হাজার রিপোর্ট তাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। নেপাল থেকে এসেছে ৫০০ টিরও বেশি রিপোর্ট। ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আফ্রিকা থেকেও বহু মহিলা তাদের খবর দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সেফসিটির অন্যতম কর্ণধার এলসা। তবে এখনও মহিলারা তাঁদের হেনস্থার খবর দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন। নিজের মধ্যেই কষ্টটা লুকিয়ে রাখেন লোকলজ্জার ভয়ে। সেখান থেকে বেরিয়ে সেফসিটির কাছে সবকিছু খুলে বলা, পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানোর পরামর্শ দিচ্ছেন এলসা। সেফসিটিকে মিসড কল দিলেও তারা ফোন করে সব জেনে নেয়। ফলে কোনও মহিলার তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানাতে এক পয়সা খরচ হবে না। এছাড়া তাদের মেল info@safecity.in এও সেফসিটির কাছে অভিজ্ঞতার কথা জানাতে পারেন যে কেউ। তাদের কাছে আসা রিপোর্টের ভিত্তিতে মহিলাদের সচেতন করতে বিভিন্ন শহরে কর্মশালা, সেমিনার, আলোচনাসভার আয়োজন করে তারা। এছাড়া প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে গ্রামের মহিলাদেরও সচেতনতা বিকাশের চেষ্টা চালাচ্ছে সেফসিটি। শুধু তাঁদের অভিজ্ঞতা জানাই নয়, তাঁদের করণীয় পদক্ষেপ সম্বন্ধেও সবরকমভাবে সচেতন করে তোলার চেষ্ঠা নিরন্তর চালাচ্ছে এই সংস্থা। কোনওরকম হেনস্থার শিকার হলে মহিলারা আইনের দ্বারস্থ কিভাবে হতে পারেন তারও পাঠ দিচ্ছে তারা।
এলসা জানিয়েছেন, তাঁদের কোনও ঘটনার কথা কেউ জানালে সেফসিটি তাঁদের সাহায্য করে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, একবার একটি কর্মশালায় একটি মেয়ে তাদের জানায় পিভিআর-এ সিনেমা দেখতে গিয়ে থ্রিডি চশমা নেওয়ার সময় হেনস্থার শিকার হন তিনি। যে ব্যক্তি চশমাটি দিচ্ছিলেন সে তাঁর সঙ্গে অভব্য আচরণ করে বলে অভিযোগ করেন ওই তরুণী। সেফসিটি বিষয়টি পিভিআর কর্তৃপক্ষকে সবিস্তারে জানায়। পিভিআর কর্তৃপক্ষ তৎক্ষনাৎ সবকিছু খতিয়ে দেখে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়।
অনেক কলেজের ছাত্রছাত্রীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে সেফসিটির ম্যাপিং তৈরিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক এনজিও সংস্থা তাদের সঙ্গে কথা বলছে। দিল্লির একটি তালিকাও একটি এনজিও সংস্থা তাদের কাছ থেকে নিয়েছে। মহিলাদের সচেতন করে তুলতে ফেসবুককেও কাজে লাগাচ্ছে সেফসিটি। তৈরি করছে নিজেদের মোবাইল অ্যপও। রয়েছে টুইটারেও। twitter@pinthecreep-এ। আগামী এক বছরে নিজেদের ওয়েবসাইটে এক লক্ষ রিপোর্ট তালিকাভুক্ত করার লক্ষ্য স্থির করেছে সেফসিটি।
Related Stories
March 14, 2017
March 14, 2017
Stories by Chandrochur Das
March 14, 2017
March 14, 2017