যে ব্যাঙ্কাররা ভারতে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী
Wednesday August 26, 2015,
6 min Read
ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্র দীর্ঘদিন পুরুষরা সামলেছেন। এবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মহিলারাও সামাল দিচ্ছেন ভারতের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ব্যাঙ্ক ব্যবসা। তাঁরাই এখন ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সর্বেসর্বা। এই কাহিনি তাঁদের নিয়েই।
সম্পদের দিক থেকে ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক এসবিআই। তার প্রথম মহিলা চেয়ারপার্সন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য। একজন প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে তিনি স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ায় যোগ দেন। সময়টা ১৯৭৭ সাল। ৩৬ বছরের কার্যকালে তিনি ব্যাঙ্কের বানিজ্যিক শাখা – এসবিআই ক্যাপিটাল মার্কেটস – এর চিফ এক্সিকিউচটিভ পদের দায়িত্বভার সামলেছেন। এর সঙ্গে একাধিক প্রকল্পের চিফ জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন। নিউইয়র্কে ব্যাঙ্কের দফতরেও তিনি কাজ করেছিলেন। এসবিআই জেনারেল ইনস্যুরেন্স, এসবিআই কাস্টোডিয়াল সার্ভিসেস এবং এসবিআই ম্যাকিউরে ইনফ্রাস্টাকচর কাজের মতো ব্যাঙ্কের নতুন বিভাগেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি এসবিআই-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং চিফ ফাইনানসিয়াল অফিসার পদে ছিলেন।
ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাঙ্ক, যা কিনা প্রাইভেট ব্যাঙ্কগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। তার কর্ণধার পদে রয়েছেন ছন্দা কোচ্ছার। আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের মুখ হিসাবেই হোক, কিংবা ভারতের রিটেল ব্যাঙ্কিং-এর আধুনিকীকরণ – দেশ এবং বিদেশের বিভিন্ন সম্মেলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। সেটা ১৯৮৪ সাল। কেরিয়ারের শুরুতে আইসিআইসিআই লিমিটেডে যোগ দেন ছন্দা। ২০০১ সালে আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক-এর বোর্ড অব ডিরেক্টরসে পৌঁছে যান। ১৯৯০ সালে আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক গড়া ওঠার পিছনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। ২০০০ সালে তিনি আইসিআইসিআই এর আর্থিক পরিকাঠামো এবং কর্পোরেট ব্যাঙ্কিং বিজনেসের প্ৰধান হিসাবে কাজ করেছেন। ব্যাঙ্কের রিটেল ব্যবসা তখন অঙ্কুরের স্তরে, সোজা হয়ে দাঁড়ানোর জন্য ছন্দা কাজে লাগালেন উদ্ভাবনী শক্তি, প্রযুক্তিকে। যার ফলে এই ব্যবসায় আইসিআইসিআইকে দেখা গেল নেতৃত্বের ভূমিকায়।
২০০৬-২০০৭ সাল। আন্তর্জাতিক মানচিত্রে ভারতীয় সংস্থাগুলি তখন নিজেদের বিস্তৃত করে চলেছে। সে সময় আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের কর্পোরেট এবং আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কিং ব্যবসাকে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ছন্দা কোচ্ছার গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেন। ২০০-৭-২০০৯। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে দেখা দিল বেশ কিছু পরিবর্তন।থাবা বসাল সঙ্কট। সে সময় তিনি সংস্থার জয়েন্ট ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং চিফ ফাইনান্সিয়াল অফিসার। সেখান থেকে ২০০৯ সালে তিনি উঠে এলেন আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সিইও পদে। তাঁর প্রধান দায়িত্ব তখন ব্যাঙ্কের কাজকর্মকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সহ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। ব্যাঙ্কের অন্যতম প্রধান শাখা কোম্পানিগুলোর বোর্ডেও তিনি ঠাঁই পান। যার মধ্যে রয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান বেসরকারি জীবন এবং সাধারণ বিমা কোম্পানি।
আইসিআইসিআই গ্রুপে গুরুদায়িত্বের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী বানিজ্য এবং শিল্প পরিষদের সদস্য পদে রয়েছেন ছন্দা। রয়েছেন আর্থিক পরিকাঠামো বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের কমিটি, ভারত-মার্কিন সিইও ফোরাম, ব্রিটেন-ভারত সিইও ফোরামে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক রিলেশনস, ন্যাশন্যাল ইনস্টিটিউট অব সিকিউরিটিজ মার্কেটস, ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি কনফারেন্সেরও তিনি সদস্য। ২০১১ সালে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের বৈঠকে তাঁকে দেখা গেছে অধ্যক্ষের ভূমিকায়। ২০১১ সালে তিনি পেয়েছেন অসামরিক ক্ষেত্রে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কার।
এইচএসবিসি ইন্ডিয়ার প্রধান নয়না লাল কিদওয়াই। তিনি সংস্থার বোর্ডে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পদে রয়েছেন। হাভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে তিনি এমবিএ করেন। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। বানিজ্য জগতে প্রভাবশালী ভূমিকার জন্য নয়না দেশ এবং বিদেশে বিশেষ পরিচিত। ফরচুন গ্লোবাল লিস্ট অব টপ উওমেন ইন বিজনেস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ফাইন্যান্সিলয়াল টাইমস গ্লোবাল লিস্টিং অব উওমেন টু ওয়াচের মতো তালিকায় ধারাবাহিকভাবে তিনি স্থান পেয়ে আসছেন।
২০০২ সালে টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিশ্বের ১৫জন প্রভাবশালী মহিলার মধ্যেও নয়না ছিলেন অন্যতম।শিল্প এবং বানিজ্য জগতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি ‘পদ্মশ্রী’ পুরষ্কারে ভূষিত হন।
এইচএসবিসি ছাড়াও নয়না জড়িয়ে রয়েছেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। নেসলে এস এ-র বোর্ডে তিনি রয়েছেন নন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসাবে। লন্ডন অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল ফর ইন্ডিয়ার তিনি চেয়ারম্যান। এছাড়াও হাভার্ড বিজনেস স্কুলের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা, রয়েছেন ইন্ডিয়ান অ্যাডভাইসরি বোর্ডের অধ্যক্ষা হিসাবে। মাইক্রোফিন্যান্স, পরিবেশ কিংবা গ্রামীণ মহিলাদের জীবনধারণের মান উন্নয়নের মতো বিষয়ে তিন উৎসাহী। বর্তমানে তিনি ফিকির প্রেসিডেন্ট।
এইচডিএফসি-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে রয়েছেন রেনু সুদ কানার্ড। তিনি মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের স্নাতক। অর্থনীতি নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের উড্রো উইলসন স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল আ্যফেয়ার্সের তিনি ‘প্রভীন ফেলো’। এইচডিএফসি-র সঙ্গে রেনু সুদের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১৯৭৮ সালে তিনি এই সংস্থায় চাকরিতে যোগ দেন। এর পর শুধুই সাফল্য। ২০০০ সালে হলেন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, ২০০৭ এর অক্টোবরে উঠে এলেন কর্পোরেশনের যুগ্ম ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে। ২০১০ সালের ১লা জানুয়ারিতে তাঁকে ৫ বছরের জন্য কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর করা হয়। সংস্থার অভ্যন্তরীন কাজকর্ম, মানব সম্পদ উন্নয়ন, সমন্বয় সংক্রান্ত কাজ দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন রেনু কার্নাড। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে এশিয়ার নজরকাড়া প্রথম ১০ মহিলার তালিকায় তিনি স্থান পেয়েছেন।
২০০৯ সাল থেকে অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সিইও পদে রয়েছেন শিখা শর্মা। শিখার কর্মজীবন শুরু আইসিআইসিআই গ্রুপে। সেখানে তিইন রিটেল ব্যাঙ্কিং, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং এবং সংস্থার বিভিন্ন আর্থিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দেশের বেসরকারি বিমা সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম আইসিআইসিআই প্রুডেনশিয়াল লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি। তার ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সিইও পদেও তিনি কাজ করেছেন। দক্ষতা এবং সাফল্যের স্বীকৃতিও মিলেছে বারবার। ২০১২ সালে এআইএমএ-র ম্যানেজিং ইন্ডিয়া অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে তিনি ট্রান্সফরমেশ্যনাল বিজনেস লিডার অফ দ্য ইয়ারের শিরোপা পান। ২০১২ সালে ব্লুমবার্গে ইউটিভি লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে তাঁকে দেওয়া হয় উওম্যান লিডার অফ দ্য ইয়ারের তকমা। একই বছর পেয়েছেন বিজনেস ওয়ার্ল্ড অফ দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে সাফল্যের স্বীকৃতিও মিলেছে। ২০১২ সালে এশিয়ার বানিজ্য মানচিত্রে প্রথম ৫০জন ক্ষমতাশালী মহিলার যে তালিকা ফোবর্স তৈরি করেছিল তাতেও ছিল শিখার নাম। ওই বছর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ‘মোস্ট পাওয়ারফুল ইন্ডিয়ানস’ কিংবা সেই একই বছরে ‘ইন্ডিয়া টুডে পাওয়ার অফ ২৫ মোস্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল উওমেন’- তালিকাতেও ঠাঁই পান শিখা শর্মা।
২০১২ সালে এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের সিএমডি অফিসে যোগ দেন শুভলক্ষ্মী পানসে। এর আগে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিজয়া ব্যাঙ্কের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পদে। ব্যাঙ্কের প্রশাসনিক এবং ব্যবসায়িক উন্নতি সংক্রান্ত কাজে শুভলক্ষ্মী দক্ষতার ছাপ রেখেছিলেন। ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে শুভলক্ষ্মী পানসে প্রবেশ করেন ১৯৭৬ সালে, ব্যাঙ্ক অব মহারাষ্ট্রের প্রবেশনারি অফিসার হিসাবে। ক্রেডিট ম্যানেজমেন্ট রিকভারি, ট্রেজারি কিংবা ইনফর্মেশন টেকনোলজি – ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে বিভিন্ন কাজে তাঁর অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের। এমনকি দক্ষতাও সীমাহীন। ব্যাঙ্ক অব মহারাষ্ট্রের সাউথ সার্কেলে তিনি সার্কেল চিফ হিসাবে কাজ করেছেন। সে সময় তাঁর কাজের পরিধি ছিল কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরালা, গোয়া এবং পণ্ডিচেরি।
নানাবিধ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শুভলক্ষ্মী দেশ বিদেশের যে সমস্ত বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালিম নিয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে – এনআইবিএম পুণে, এএসসিআইআই অ্যান্ড ডেএনআইডিবিআই হায়দ্রাবাদ, এমডিআই গুরগাঁও, বিটিসি অ্যান্ড আরবিআই মুম্বই, ইউরোপিয়ান স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট লন্ডন এবং প্যারিস, ব্যাঙ্ক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট বাসেল, সুইৎজারল্যান্ড এবং এমইএফডিইসি, বাহরিন।
ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০০০ সালে পুণে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন তাঁকে সম্মান জানিয়েছিল। তাঁর পাওয়া পুরস্কারের তালিকাও কম দীর্ঘ নয়। যেমন ২০০৫ সালে উইশিটেকস ফাউন্ডেশনের (মুম্বই) অ্যাওয়ার্ড ফর ব্যাঙ্কার অফ দ্য ইয়ার। ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০০৬ সালে ওড়িশায় রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন সদ্ভাবনা অ্যাওয়ার্ড। আইটি এবং ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজের জন্য ২০০৮ সালে পুণের এমইএস সোসাইটি তাঁকে নারী চেতনা পুরস্কারে সম্মানিত করেছিল। ব্যাঙ্কিং এবং ফিন্যান্সে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১১ সালে তিনি পান সূর্যদত্তা ন্যাশন্যাল অ্যাওয়ার্ড। দক্ষ ব্যাঙ্কার হিসাবে যেমন পরিচিত, সেরকম শক্তিশালী প্রশাসকও হিসাবেও তিনি সমান পরিচিত। নিজের টিমের কাছে শুভলক্ষ্মী হলেন দারুণ মোটিভেটর।