স্টার্টআপের লাভের গুড়ে 'স্বচ্ছ ভারত সেস'-এর মাছি!

স্টার্টআপের লাভের গুড়ে 'স্বচ্ছ ভারত সেস'-এর মাছি!

Saturday December 19, 2015,

5 min Read

image


ভারতীয় স্টার্টআপের মুখে নুন ঢেলে দেওয়া! ব্যাপারটা খানিকটা তাই বটে। যখন ভারত সরকার স্বচ্ছ ভারত সেস (Swachh Bharat Cess) হিসাবে ০.৫ শতাংশ আদায় করার কথা ঘোষণা করল। যার ফলে ১৫ নভেম্বর থেকে সার্ভিস ট্যাক্স বা পরিষেবা কর ১৪ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪.৫ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় বাজেটে বলা হয়েছিল সেস ২ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। সেই হিসাবে ০.৫ শতাংশকে কম বলেই মনে হবে। কিন্তু ভারতীয় স্টার্টআপগুলি, বিশেষত যারা কনজিউমার স্পেসে কাজ করে, ইতিমধ্যেই লোকসানের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে। ফলে ০.৫ শতাংশ অতিরিক্ত কর প্রত্যক্ষভাবে তাদের আরও নিচের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

স্টার্টআপের ঘাড়ে সেসের বোঝা

'সেসের ব্যথা', বিষয়টাকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করলেন হাইপারলোকাল হোম সার্ভিস স্টার্টআপ Housejoy-এর CEO সারণ চ্যাটার্জী। তিনি বললেন,"হ্যাঁ, ০.৫ শতাংশও প্রভাব ফেলে। আমরা মার্কেটপ্লেস মডেলে কাজ করি। ফলে কমিশনের ওপর সার্ভিস ট্যাক্স দিতে হয়। এর একটা খারাপ প্রভাব পড়বেই।" হাউসজয় বিভিন্ন পরিষেবা ক্ষেত্রে (প্লাম্বিং, কারপেন্ট্রি, ফিটনেস ট্রেনার ইত্যাদি) কাস্টমারদের সঙ্গে সার্ভিস প্রোভাইডারদের যোগাযোগ করে দিয়ে থাকে। ন'টি শহরে ছড়িয়ে থাকা হাউসজয় রোজ এই ধরনের কাজে চার হাজারের মতো অর্ডার পেয়ে থাকে। সংস্থার লক্ষ্য আগামী ১২ মাসের মধ্যে এই পরিষেবা ২৫টি শহরে পৌঁছে দেওয়া। এমন বলিষ্ঠ পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও সেস নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত সংস্থা। চিন্তার কারণ, বাজেট ভাষণে ২ শতাংশ সেসের প্রস্তাব। সারণ বললেন,"এটা যদি আরও ১.৫ শতাংশ বাড়ে, তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে। আশা রাখি সরকার এ থেকে রেহাই দেবে।" এই আশঙ্কা হয়তো অমূলক নয়। হাইপারলোকাল ইন্ডাস্ট্রিতে গ্রস মার্জিন থাকে ২০ শতাংশের মতো। কিন্তু এইসব স্টার্টআপ কাস্টমার ধরতে ডিসকাউন্ট দেয়, মার্কেটিংয়েও বড় মাত্রায় খরচ করে থাকে। ফলে নেট মার্জিন কমতে বাধ্য।

গ্রাহক ধরতে স্টার্টআপের তুরুপের তাস হল দাম বা প্রাইস। সেসের নামে অতিরিক্ত কর কিন্তু বিষয়টাকে জটিল করে তুলেছে। সে কথাই বললেন হাইপারলোকাল গ্রসারি বিজনেসের সঙ্গে যুক্ত PepperTap-এর CEO নভনীত সিং। তিনি বললেন," স্টার্টআপ হিসাবে আমরা চাই কাস্টমারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ুক। এখন এই অতিরিক্ত কর বা ০.৫ শতাংশ সেস আমরা কাস্টমারের কাঁধে হয়তো ফেলতে পারব না।আমরা ডেলিভারি ফি হিসাবে ৫০ টাকা নিয়ে থাকি। এর মধ্যে সার্ভিস ট্যাক্স ধরা থাকে। এখন আমাদের ভাবতে হবে যে এই রেট আমরা ধরে রাখব, নাকি বাড়াব।" বর্তমানে ১৭টি শহরে পরিষেবা দিয়ে থাকে পেপারট্যাপ। রোজ মোট অর্ডারের সংখ্যা প্রায় ২২ হাজার।

আবার এমন কিছু পরিষেবা সংস্থা রয়েছে, যারা গ্রাহকের থেকেই সেসের টাকা তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। রেস্তোরাঁ চেন Mast Kalandar-এর প্রতিষ্ঠাতা গৌরব জৈন মনে করেন, কাস্টমার যে ধরনের পরিষেবা দৈনিক ভিত্তিতে নিয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে করের হার অন্যরকম হওয়া উচিত। "আমাদের মস্ত কালান্দর রেস্তোরাঁয় অনেকে সপ্তাহে কমপক্ষে তিনবার খাওয়াদাওয়া করে থাকেন। এই ধরনের কাস্টমাররা দামে সামান্য পরিবর্তন হলেও আঁতকে ওঠেন", বললেন গৌরব। মস্ত কালান্দরের নেটওয়ার্কে রয়েছে ৭০টি আউটলেট এবং চলতি আর্থিক বছরে সংস্থার লক্ষ্য ৮০ কোটি টাকার ব্যবসা।

গৌরবের বক্তব্যের সঙ্গে একমত Chai Point-এর প্রতিষ্ঠাতা তথা CEO অমুলিক সিং বিজরাল। তিনি বললেন, "চায় পয়েন্টকে আমরা রোজকার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে দিতে চাই। আমাদের সেই প্রচেষ্টা এর ফলে বাধা পেতে পারে। আমরা উৎকৃষ্টমানের চা অপেক্ষাকৃত কম দামে গ্রাহককে তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। সেসের ফলে আমাদের অসুবিধাই হবে।" অমুলিকের সংস্থায় রোজ দেড় লাখ গ্লাস চা বিক্রি হয়। সংস্থার কর্পোরেট ক্লায়েন্টের সংখ্যা ২০০ আর দোকানের সংখ্যা ৭৫টি।


image


রেহাই পাবে না তুমিও

বর্তমান সার্ভিস ট্যাক্স ব্যবস্থায় CENVAT Credit বলে একটা বিষয় রয়েছে। কোনও একটি সংস্থা গ্রাহকের থেকে সার্ভিস ট্যাক্স আদায় করছে। আবার সেই সংস্থাকেও অফিস বা আউটলেটের ভাড়া বা রেন্ট বাবদ সার্ভিস ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কর কর্তৃপক্ষ এই ধরনের সার্ভিস প্রোভাইডারকে প্রদত্ত ট্যাক্সের ওপর ক্রেডিটের সুবিধা দিয়ে থাকে। সেটাই সেনভ্যাট ক্রেডিট। কিন্তু স্বচ্ছ ভারত সেসের ক্ষেত্রে সার্ভিস প্রোভাইডার ক্রেডিটের এই সুবিধা পাবেন না বলে জানালেন Taxmantra-র প্রতিষ্ঠাতা তথা CEO অলোক পাতনিয়া। পাশাপাশি বুক অব অ্যাকাউন্টসে পৃথকভাবে দেখাতে হবে সেসের বিষয়টি। জমাও দিতে হবে পৃথকভাবে। যেতেতু এই খরচ শুধুমাত্র ক্লিন ইন্ডিয়া ইনিশিয়েটিভের জন্য। স্টার্টআপের জন্য এগুলোও বাড়তি মাথাব্যথার কারণ।

আবার e-tail কোম্পানিগুলির জন্য সমস্যা একটু অন্য ধরনের। যেহেতু তারা গ্রাহককে কোনও পরিষেবা দেয় না, সেহেতু পরিষেবা কর প্রযোজ্য হয় না। "আমাদের কিন্তু বিভিন্ন পরিষেবা নেওয়ার জন্য, যেমন ফেসবুক বা গুগ্‌ল মার্কেটিং, সার্ভিস ট্যাক্স দিতে হয়। আমাদের মতো সংস্থার ক্ষেত্রে যা বেশ কয়েক লক্ষ টাকা। ফলে সেসের প্রভাব মারাত্মক", বললেন অনলাইন ফ্যাশন ব্র্যান্ড Faballey-র প্রতিষ্ঠাতা শিবানী পোদ্দার। শিবানীর সংস্থায় প্রতি মাসে প্রায় চার কোটি টাকার বিক্রি হয়। বৃহৎ সংস্থা, যেমন Flipkart, Snapdeal কিংবা Ola-র ক্ষেত্রে এই প্রভাব আরও বেশি। তাদের ব্যবসার বহর আর লোকসানের কথাটা মাথায় রাখলে সেটা বোঝাই যায়। যদিও এ ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হয়নি ফ্লিপকার্ট। ই-মেলে জানতে চাওয়া হলেও কোনও উত্তর দেয়নি স্ন্যাপডিল এবং ওলা।


image


সেস নয়, ইনসেনটিভ সিস্টেমের পক্ষে সওয়াল

স্বচ্ছ ভারত সেসের তুলনায় ইনসেনটিভ সিস্টেম অনেক বেশি কার্যকর হত বলে মনে করেন আন্ত্রেপ্রেনাররা। কীভাবে? চায় পয়েন্ট-এর অমুলিক জানালেন, বেঙ্গালুরুতে তাদের দোকানের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য তারা পুরসভার ওপর নির্ভর করেন না। চা-পাতা সহ অন্য বর্জ্য সরাসরি সংস্থার গুদামে পাঠিয়ে ঝাড়াইবাছাই করা হয়। সেই ভেষজ বর্জ্য নিয়ে যায় ডোড্ডাবাল্লাপুরের কৃষকরা। আঙুর খেতের জন্য যা খুবই কাজে লাগে। তাদের মতো সংস্থাকে সরকারের তাই সেস থেকে রেহাই দেওয়া উচিত বলে মনে করেন অমুলিক। এর ফলে অন্যরাও উৎসাহিত হবে এবং স্বচ্ছ ভারত অভিযানও সরাসরি উপকৃত হবে। Faballey-এর শিবানী আবার মনে করেন, আয়করের মতো এক্ষেত্রেও কোম্পানিগুলির জন্য স্ল্যাব সিস্টেম হওয়া উচিত। ছোট-ছোট সংস্থা, যাদের রোজগার কম তাদের এর আওতা থেকে বাদ দেওয়া উচিত।

স্বচ্ছ ভারত সেস-কে আবার সমর্থনও করছেন কেউ-কেউ। মহিলা কেন্দ্রিক ফ্যাশন ই-টেলার Limeroad-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা সুচি মুখার্জী বললেন,"আমি কিন্তু স্বচ্ছ ভারত মিশনের পক্ষে। যদিও আমাদের দেশে অনেক ব্যাপারে বহু টাকা খরচ হলেও কোনও ফল দেখা যায় না। গঙ্গা সাফাই অভিযানে এর আগে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ফল শূন্য। সেসের টাকায় স্বচ্ছ ভারতের কাজ কতটা এগোচ্ছে তা সরকারকে নিয়মিত জানাতে হবে। আর তা না হলে, কিছু কিছু লোককে অনর্থক দণ্ড দেওয়া হবে।"


image


একমাত্র আশা- জিএসটি

পণ্য ও পরিষেবা কর (Goods and Services Tax বা GST) নিয়ে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছে সরকার। আশা করা যায় খুব শিগগিরই চালু হয়ে যাবে জিএসটি। এই কর চালু হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলেই মনে করেন ট্যাক্সমন্ত্রা-র অলোক পাতনিয়া। তাঁর কথায়, জিএসটি চালু হলে সার্ভিস ট্যাক্স, ভ্যাট-সহ অন্যান্য ইনডিরেক্ট ট্যাক্স এর মধ্যেই ঢুকে যাবে। করের হার হতে পারে ১৬ থেকে ১৮ শতাংশের মধ্যে। পরিষেবা নেওয়ার জন্য কোনও কোম্পানিকে যে কর দিতে হবে আর পরিষেবা দেওয়ার জন্য ক্লায়েন্টদের থেকে যে কর নেবে তা অ্যাডজাস্ট করা যাবে। সব মিলিয়ে জিএসটি অনেক ভালো। এর ফলে অনেক কিছুই বদলে যাবে।

জিএসটি চালু হলে স্টার্টআপগুলির জন্য হয়তো সত্যিই ভালো হবে। কিন্তু যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন 'সেসের ব্যথা' নিয়েই পথ চলতে হবে।

লেখা - রাধিকা নায়ার