দাবার বোর্ডে কিস্তিমাত ভবিষ্যৎ ইঞ্জিনিয়ার ভাব্য-আতুরের

দাবার বোর্ডে কিস্তিমাত ভবিষ্যৎ ইঞ্জিনিয়ার ভাব্য-আতুরের

Wednesday September 09, 2015,

4 min Read

কম্পিউটারের সঙ্গে দাবা খেলা নতুন কিছু নয়। ক্লিক অ্যান্ড ড্র্যাগ এ কিস্তিমাত। সমস্যা একটাই, হাতে ধরে ঘুঁটি চেলে বুদ্ধির গোড়ার ধুয়ো দিয়ে দাবা খেলার মজা পাওয়া যায় না তাতে। যারা দাবা খেলতে ভালোবাসেন তাঁদের একটা সুখবর দিই। এবার সেই সমস্যাও মিটতে চলেছে। ঘুঁটি ধরে আপনিও চাল দেবেন, প্রতিপক্ষ কম্পিউটারও চাল দেবে। এমন অভিনব দাবার বোর্ড আবিষ্কার করে ফেলেছে মুম্বইয়ের দুই ভবিষ্যৎ ইঞ্জিনিয়ার, ভাব্য এবং আতুর।

ভাব্য গোহিল এবং আতুর মেহতার পরিচয় কে জে সোমায়া কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়তে এসে। সাধারণভাবে বলা যায়, এদেশে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে নতুনদের দুটি দল থাকে। একদল প্রথম থেকেই পড়াশোনা করে গ্রেড বাড়ানোর চেষ্টা করে যায়, আরেক দল কলার উঁচিয়ে ঘোরে, কারণ মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছে তারা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পড়ুয়া। তাদের মধ্যেও একটা দল আছে যারা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে আসে একটা আবেগ থেকে, আনন্দ পেতে। ভাব্য এবং আতুরের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যাবে, দুজনে শেষের এই ছোট্ট অংশটির মধ্যেই পড়ে।

অাতুর  মেহতা ও ভাব্য গোহিল

অাতুর মেহতা ও ভাব্য গোহিল


‘সিলেবাসের পড়ার পাশাপাশি প্রথম সেমেস্টারের অবসর সময়ে আমরা নানা প্রযুক্তি এবং ছোট প্রেজক্ট নিয়ে নাড়াঘাঁটা করতাম’, একটা ইমেল ইন্টারভিউতে বলছিলেন ভাব্য।কলেজেরই একটা কাউন্সিলে(পরিষদ) কাজ করার সময় দুজনের আলাপ হয়। তখন থেকে শুরু। সবসময় সৃজনশীল কিছু একটা করা, নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা, দুজনকেই প্রচারের কেন্দ্র রাখত।

‘নতুন নতুন যারা ভর্তি হয়েছে তাদের এই ধরণের প্রজেক্ট করতে দেখা যায় না। তাই RiiDL(সময়া বিদ্যাবিহারের রিসার্চ ল্যাব)এর সঙ্গে থাকতে পেরে আমরা খুশি হয়েছিলাম’, মনে পড়ে ভিব্যর। RiiDL হল সময়া বিদ্যাবিহারের উদ্ভাবন কেন্দ্র। কেন্দ্রটি মূলত এক একটা দল তৈরি করে, যারা পৃথিবীতে সারাক্ষণ ঘটে চলেছে এমন কিছু সমস্যার সমাধান করে, দক্ষতা বাড়ায় এবং নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে। এখান থেকেই নতুন পথের দিশা পান ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দুই মেধাবী ছাত্র ভিব্য এবং আতুর। ‘দ্বিতীয় বর্ষের ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সময় RiiDL এ তৈরি করা কিছু মডেল রোম, গোদরেজ, ক্যাপজেমিনি, ওয়াসআপ আন্ধেরি, আইআইটি বম্বে, আইআইটি খড়গপুরে মেকার ফেয়ারের নানা ইভেন্টে দেখানো হত। এইসব ইভেন্ট থেকে যে সাড়া পেতাম সেটাই আমাদের এগিয়ে যেতে উৎসাহ যুগিয়েছে’, বলছিলেন আতুর।

দাবার বোর্ড নিয়ে একটা আইডিয়া আসে দুই মেধাবীর মনে। কম্পিউটারে দাবা খেলাটা আরও বেশি মজাদার করে তুলতে এবং শুধু ক্লিক করে ঘুঁটি সরানোর চাইতে ঘুঁটিগুলি যাতে হাতে ধরা যায় তার ব্যবস্থাও করে ফেলেন দুজনে। দাবার ফ্যান হিসেবে দুই বন্ধু একটা স্বয়ংক্রিয় দাবার বোর্ড তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। স্বয়ংক্রিয় দাবা আসলে এমন একটা পদ্ধতিতে খেলা হয় যাতে প্রতিপক্ষ কম্পিউটারের সঙ্গে তথ্যের আদান প্রদান হয় এবং হাতে ঘুঁটি ধরে চাল দিয়ে খেলা যায়।

image


প্রাথমিকভাবে, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের কথা মাথায় রেখে স্বয়ংক্রিয় দাবার বোর্ড তৈরি করা হয়। যত সময় যায় এর ব্যবহার আরও প্রশস্ত হল। ‘আমরা ন্যাব(ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ব্লাইন্ড) এ যাই। অন্ধ দাবাড়ুদের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করি তাঁরা কীভাবে খেলেন, কী কী অসুবিধার সম্মুখীন হন’, বলেন ভাব্য। যা ভাবা হয়েছিল মোটামুটি চার মাসের মধ্যে সেরকমই একটা চেজবোর্ড বানিয়ে ফেলেন দুজনে। উদ্ভাবকদের নজর কাড়ে স্বয়ংক্রিয় চেজবোর্ড। যারা দাবা ভালোবাসেন তাদের এবং প্র‌যুক্তিমনষ্কদের সমীহ আদায় করে নেয় ভাব্যদের চেজবোর্ড। অনেকের বিষয়টা এতটাই ভালো লেগেছিল আরও যাতে নানা বৈশিষ্ট তাতে জোড়া যায় তার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে পরামর্শও আসতে থাকে দুজনের জন্য।

নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা ভাঙা গড়ায় যেটা দাঁড়িয়েছে, চেজবোর্ডটি এবার বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য তৈরি। প্রথম লক্ষ্য অবশ্যই চিনের বাজার। কিন্তু লজিস্টিকস (উৎপাদন থেকে গ্রাহকের হাতে তুলে দেওয়া পর্যন্ত যে প্রক্রিয়া)এবং মান নিয়ে নানা সমস্যা রয়েছে সেদেশে। ‘বদলে আমরা ভাবলাম চিনের পরিবর্তে ভারতেই উৎপাদন হবে। তাতে মেক ইন ইন্ডিয়া ক্যাম্পেইনকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরে গর্ববোধও হবে। ল্যাবেই সবকিছুর ব্যবস্থা হল। নজরে ছিল যাতে ওই পরিকাঠামোতে চেজবোর্ডটিতে সবচেয়ে ভাল মান দেওয়া যায়। শুরুতে পণ্যের মান ধরে রাখতে পারালে, গ্রাহকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা’,বোঝান আতুর।

২০১৩র মাঝামাঝি ন্যব (NAB) এর সঙ্গে তাঁদের যে কথাবার্তা হয়েছিল সেই মতো পরীক্ষামূলক চারটি স্বয়ংক্রিয় চেজবোর্ড তৈরি হয়। গোটা প্রকল্পে বিভিন্ন ক্ষেত্রের নানা প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হয়। এবং ইলেকট্রনিক্সের ছাত্র হিসেবে প্রকল্পটি দুই মুম্বইকরের কাছে মজার এবং একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জের হয়ে দাঁড়ায়। প্রজেক্টের প্রথমে ইলেকট্রিক্যাল অংশটা সেরে নেন। তারপর যন্ত্রপাতি সংক্রান্ত অর্থাৎ মেকানিক্যাল অংশটায় হাত দেন। সব শেষে স্বয়ংক্রিয় অংশের কাজ ধরেন। যেহেতু গত বছর অক্টোবরে প্রাথমিক লঞ্চটা মেকার ফেয়ার রোমে হয়ে গিয়েছিল তাই স্বংয়ক্রিয় দাবা এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ, রিসর্ট ক্লাব হাউস, ক্যাফে এবং নানা হোটেলে স্বচ্ছল ক্রেতাদের আগেই নজরে পড়ে গিয়েছিল।

ক্রেতাদের এই উৎসাহই তাদের হাতে সবচেয়ে ভালো জিনিস তুলে দেওয়ার তাগাদা বাড়িয়ে দেয় দুই ভবিষ্যৎ ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে। ‘চেজক্লাবগুলি থেকে নানা অনুরোধ আসতে থাকে আমাদের কাছে। অনুরোধগুলি আমাদের উৎসাহ বাড়িয়ে দেয় এবং স্বয়ংক্রিয় দাবার পর আরও যে পরিকল্পনা রয়েছে সেগুলি নিয়েও পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে দিয়েছি’! বলেন ভাব্য। প্রথমে অল্প সংখ্যক উৎপাদনের চিন্তাভাবনা রয়েছে দুজনের। স্বংয়ক্রিয় বোর্ড হাতে খেলা ছাড়াও একই খেলা অনলাইনেও নিয়ে আসার কথা ভাবছেন তাঁরা, যাতে একটা কমিউনিটি বা দল তৈরি করে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে বন্ধু বা যেকোনও প্রতিপক্ষের সঙ্গে দাবা খেলা যায়।

ভারতে হার্ডওয়ার দুনিয়া বেশ রোমাঞ্চকর হয়ে উঠছে। ২০১৪র বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বেরিয়ে এবার নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। সারা দেশে থেকে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্যোগ এবং উদ্যোক্তাদের চেষ্টা চোখে পড়ছে। আর দেশের স্লোগান মেক ইন ইন্ডিয়া আরও জোরদার হচ্ছে। তাতে তরুণ উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ ভালো দিনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে দেশবাসীকে।