উদ্যোগের উষ্ণতা নিয়ে হাজির কাশ্মীর

জম্মু কাশ্মীর বললেই হয় বরফের মোটা চাদরে ঢাকা উপত্যকা নয়তো সন্ত্রাসের কুশ্রী ছবিই মনে পর্দায় ভেসে ওঠে। কিন্তু জম্মুর পিওর মার্টের ভেষজ ভাণ্ডার শোনালো অন্য কাহিনি। কাশ্মীরি তরুণের অনলাইন ব্যবসার দারুণ গল্প।

উদ্যোগের উষ্ণতা নিয়ে হাজির কাশ্মীর

Thursday August 20, 2015,

4 min Read

image


আসুন সাহিল ভার্মার সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করাই। জম্মু-কাশ্মীরের ভেষজ দ্রব্য বা অর্গানিক প্রোডাক্টকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়া এক অনলাইন মার্কেটের ইনিই কর্ণধার। সাহিলের কথায়, "জম্মুতে বড় হয়ে ওঠার সময় খালি ভাবতাম, বাইরের লোকেরা আমাদের এখানকার আখরোট, জাফরান বা অন্যান্য শুকনো ফল নিয়ে এত করে জানতে চায় কেন। আমরা তো এগুলো হাতের কাছেই পাই। এতে আর এমন কী আছে।" সাহিল প্রথম বাড়ির বাইরে পা রাখেন যখন সে ফার্মাসি পড়তে বেঙ্গালুরু পাড়ি দেয়। বাড়ি ছেড়ে ভিনরাজ্যের একটি কলেজে পড়তে যাওয়া খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত ছিল সাহিলের পক্ষে। কিন্তু প্রাপ্তি কিছু কম হল না। বন্ধুত্ব হল দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছেলেমেয়ের সঙ্গে। সাহিল লক্ষ্য করলেন, তাঁর রাজ্য সম্পর্কে মানুষের মনে একটা খারাপ ধারণা কাজ করছে। জম্মু ও কাশ্মীর মানেই যেন সন্ত্রাস। সেইসঙ্গে বরফ আর কিছু শুকনো ফল। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরের ১৪ বছর ধরে বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দরাবাদ, পুনে আর মুম্বই ঘুরে-বেড়িয়ে সাহিল একটা জিনিস উপলব্ধি করেন। জগতে আর যা কিছুরই পরিবর্তন হোক না কেন, তাঁর জন্মভূমি সম্পর্কে বিরূপ ধারণায় ইতি পড়েনি।

এক প্রিয় বন্ধুর বাবার মৃত্যু আমার যেন চোখ খুলে দিল। সাহিল বলেন, "তাঁর মৃত্যুর কারণ আসলে খারাপ খাদ্যাভাস। স্বাস্থ্যকর জিনিস অত্যন্ত সহজলভ্য হলেও তিনি তার সুবিধা পাননি। আখরোট, জাফরান-সহ আমাদের রাজ্যের বহু জিনিস হৃদরোগকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। শুধু তাই নয়, শ্বাসকষ্ট, হাড়ের সমস্যাও কমিয়ে আনে। ভারতে যত সংখ্যক মানুষ মারা যান, তাঁদের বেশিরভাগই এইসব রোগের শিকার। তখনই ভাবলাম, এমন কিছু করতে হবে যাতে দেশের মানুষের কাছে এসব পৌঁছে দেওয়া যায়। জম্মু-কাশ্মীর মানে যে শুধুই সন্ত্রাস আর তুষার নয়, দেশের মানুষেরও এবার সেটা জানা দরকার।" সাহিলের ভাবনায় সাথী হলেন তাঁর স্ত্রী। তবে বাবা-মা কিছু জানতে পারলেন না। আসলে বিষয়টা তাঁদের কাছে গোপনই রাখলেন সাহিল।

এরপর কী হল? এই ব্যবসায় তাঁর পার্টনার রজনী ভার্মাকে নিয়ে বছরখানেক ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শহরে গেলেন সাহিল। জম্মু-কাশ্মীরের ভেষজ দ্রব্য সম্পর্কে জন সচেতনতা বাড়ানোই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। তাঁরা দুজনেই আশ্চর্য হলেন, আখরোট আর জাফরান কেমন দেখতে তাই জানেন না অধিকাংশ মানুষ। নিজের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া আসল জাফরান আর কাঠবাদাম লোকজনকে দেখাতেন সাহিল। জানাতেন এসব ভেষজের গুণ।

সাহিল বুঝতে পারেন, এই ব্যবসায় বিজনেস টু বিজনেস মডেল চলবে না। সরাসরি ক্রেতাদের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলতে হবে। সেই সময় (২০১১) ই-কমার্স বিষয়টিও ধীরে-ধীরে মাথা তুলছিল। একেই হাতিয়ার করে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন সাহিলরা। দুটি জিনিস, জাফরান আর আখরোট নিয়েই ব্যবসা শুরু করে দিল সাহিলদের পিওর মার্ট। বছর তিনেকের মধ্যেই দেশের এমন কোনও শহর আর পিন কোড নেই, যেখানে পিওর মার্ট জিনিস পৌঁছে দিচ্ছে না। কন্যাকুমারী থেকে কলকাতা, নাগাল্যান্ড থেকে আন্দামান, সব জায়গার ক্রেতাদেরই চাহিদা মেটাচ্ছে পিওর মার্ট। এমনকী কানাডা, ইংল্যান্ড, দুবাই থেকেও দু-হাজারের বেশি অর্ডার পেয়েছেন সাহিলরা।


image


তাঁদের ব্যবসার কথা জানাতে গিয়ে সাহিল বলেন, "আমরা রাজ্যের চাষিদের থেকে সরাসরি এইসব জিনিস সংগ্রহ করি। ভেষজ দ্রব্যের ব্যবহার বাড়াতে এবং গ্রিন ইন্ডিয়ার লক্ষ্যে আমরা নীভ হার্বালস নামে একটি সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছি। নীভ হার্বালস এই কাজের জন্য ভারত সরকার থেকে পুরস্কৃতও হয়েছে। সম্প্রতি আমরা টোয়েন্টি ফোর মন্ত্রা নামে একটি সংস্থার সঙ্গে পার্টনারশিপ গড়ে তুলেছি। আপনার গেরস্থালির কাজে প্রয়োজনীয় সমস্ত রকম ভেষজ জিনিস পৌঁছে দিতে এই মুহূর্তে একটি ব্র্যান্ড এই টোয়েন্টি ফোর মন্ত্রা।" তবে সাহিল চান, মানুষকে ভালো জিনিস তুলে দিতে। সেটা ব্র্যান্ডেড না হলেও চলবে। জিনিস ভালো হলে সেটা এমনিতেই ব্র্যান্ড হয়ে উঠবে বলে মনে করেন সাহিল। তিনি এটাও দেখেছেন তাঁদের ক্রেতাদের ৯৯ শতাংশই তাঁদের জিনিস সম্পর্কে ভালো রিপোর্ট দিয়েছেন। যে এক শতাংশ ঘাটতি রয়েছে সেটা মূলত সময়ে জিনিস পৌঁছে না দিতে পারার জন্য। সেই সমস্যাও তাঁরা কাটিয়ে তুলতে চান।


image


ডেলিভারি ও পেমেন্ট-এই দুটিই তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানাচ্ছেন সাহিল। দ্বিতীয়টির সমাধান অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু ক্রেতাদের বাড়িতে জিনিস পৌঁছে দেওয়া ততটা সহজ নয়। জিনিস পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে সব ডেলিভারি পার্টনারদের ওপর তাঁরা নির্ভর করেন তারা অনেক সময়েই পরিষেবা দিতে পারে না। ফলে পিওর মার্ট সম্পর্কে ক্রেতাদের একাংশের মনে ভুল ধারণা জন্মায়। এজন্য বেঙ্গালুরুতে নিজস্ব ডেলিভারি মডেল চালু করেছে পিওর মার্ট। কোনও বাড়তি খরচ ছাড়াই ক্রেতাদের বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে জিনিস। আরও তিন-চারটি শহরে এই ব্যবস্থা চালু করতে চান সাহিল ও তাঁর পার্টনার রজনী।

পিওর মার্ট নিয়ে আগামী দিনে কী ভাবনা সাহিলদের? মাল্টি চ্যানেল মার্কেট প্লেস এবং ভেষজ মেলার মাধ্যমে তাঁদের ব্যবসাকে আরও ছড়িয়ে দিতে চান সাহিল-রজনী। পাশাপাশি মেট্রো শহরগুলিতে সমমনস্ক উদ্যোগীদের নিয়ে আরও জোরদার স্ট্র্যাটেজিক সেলস অ্যান্ড ডেলিভারি মডেল গড়ে তুলতে চান তাঁরা। সোশ্যাল মিডিয়াতে ভেষজ দ্রবের আরও বেশি করে প্রচারও এবছর তাঁদের কাজের অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে। লগ্নির ক্ষেত্রে চলতি বছরেই এক কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ছুঁয়ে ফেলতে চায় পিওর মার্ট।

কিছু বাধাবিপত্তি থাকলেও সাহিল-রজনী এবং তাঁদের সঙ্গী আরও পাঁচজন এই অনলাইন ভেষজ ব্যবসা সম্পর্কে আশাবাদী। নিজেকে এখন ফাউন্ডার এবং চিফ এভরিথিং অফিসার বলতেই পছন্দ করেন সাহিল।

পিওর মার্ট নিয়ে আনন্দেই কাটছে তাঁর সময়। ফিরে গিয়েছেন জন্মভূমিতেই। সেখান থেকেই দু-বছর হল চালাচ্ছেন অনলাইন ভেষজ ব্যবসা। নিজে কিছু করার মধ্যে যে এটা অন্যরকম ব্যাপার রয়েছে সেটাই এখন সাহিলের জীবনের উপলব্ধি।