জীবনে একবার মিথ্যে বলেছিলেন অন্না হাজারে

সততার প্রতীক। যে মানুষটাকে মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী বলে আমরা মনে করি সেই অহিংস অসহযোগী সত্যাগ্রহী অন্না আমাদের কাছে দেওয়া এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউতে অবলীলায় জানিয়ে দিলেন তিনি কবে মিথ্যে বলেছেন।

জীবনে একবার মিথ্যে বলেছিলেন অন্না হাজারে

Sunday August 21, 2016,

4 min Read

অন্না হাজারে। আধুনিক ভরতের সবথেকে জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী সমাজকর্মী। দেশের বহুমুখী বিকাশের জন্যে, দেশের মজবুত গণতন্ত্রের জন্যে বেশ কয়েকটি সামাজিক আন্দোলন করেছেন অন্না হাজারে। আজও তাঁর আন্দোলন চলছে। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন অন্না হাজারে। নিজের পৈতৃক ভিটে যেই গ্রামে সেই রালেগন সিদ্ধিকে আদর্শ গ্রামে পরিণত করে দেশের গ্রামীণ বিকাশের এমন নিদর্শন তুলে ধরেছেন যে তার দেখা দেখি অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের গ্রামের বিকাশ করেছেন এবং সমৃদ্ধি এনেছেন। দেশের কালো টাকার বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে এবং বেকারত্বের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন কি বিশাল আকার নিয়েছিল। তথ্যের অধিকার এবং লোকপাল বিলের জন্যে অন্না হাজারের নেতৃত্বে অহিংস সেই আন্দোলনের প্লাবনে জোর ধাক্কা খেয়েছিল দিল্লি। ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল গোটা দেশ। আবাল বৃদ্ধ বনিতা, আট থেকে আশি সকলের মুখে মুখে ফিরছিল স্লোগান আমিও অন্না তুমিও অন্না। আমরা সবাই অন্না। এই একটি নামই গোটা দেশকে এক সূত্রে গেঁথে দিতে সমর্থ হয়েছিল।

সেই ব্যক্তিত্বের জীবনের নানান অপরিচিত ঘটনা জানব বলে তাঁর কাছে সময় চেয়েছিলাম আমরা। আমাদের এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন অন্না হাজারে। জানিয়েছেন তাঁর জীবনের নানান অজানা কাহিনি। সেই সব প্রেরণা জাগানো গুরুত্বপূর্ণ কাহিনি নিয়ে আমরা আপনাদের সামনে নিয়ে আসছি একটি সিরিজ। এটা তার প্রথম অধ্যায়

অন্না হাজারের জন্ম মহারাষ্ট্রের আহমেদনগরের কাছেই ভিঙ্গার এলাকায়। এমনিতে অন্নার পৈতৃক গ্রাম রালেগন সিদ্ধি হলেও অন্নার ঠাকুরদাদা বাবা গোটা পরিবার রোজগারের তাগিদে ভিঙ্গারে চলে আসেন। অন্নার ঠাকুরদাদা ইংরেজ আমলে সেনাবাহিনীতে জমাদারের কাজ করতেন। বাবা কাকা পিসি গোটা পরিবার ভিঙ্গারে থাকত। অন্না এখানেই জন্মেছেন। বাবা বাবু রাও হাজারে এবং মা লক্ষ্মীবাইয়ের প্রথম সন্তান অন্না। বাবা মা তার নাম রেখেছিল কিষণ। পরিবারের সবাই এবং পাড়া প্রতিবেশীরাও ছোট্ট কিষণকে খুব ভালো বাসত। সেসব মধুর স্মৃতি এখনও অন্নার মনে আছে। তবে আর্থিক দুরবস্থার জন্যে অন্নার সব আবদার মেটাতে পারতেন না বাবা মা। সেই সবকিছু দিতে পারতেন না যা আর পাঁচটা শিশু পেয়ে পেয়ে বড় হয়। ক্লাস ফোর পর্যন্ত ভিঙ্গারে সরকারি স্কুলে পড়াশুনো করেছেন। তারপর তার মামা তাঁকে মুম্বাই নিয়ে আসেন। মামার একটি মেয়েছিল। ফলে মামা কিষণের বাবা মায়ের কাছে কিষণকে মুম্বাই পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে বিশেষ অনুরোধ করেছিলেন। ওরা কিষণকে নিজের ছেলের মতই লালন পালন করতে চেয়েছিলেন। মামার অনুরোধ উপরোধের সামনে বাবা মার আর কিছুই করার ছিল না।

কিন্তু শৈশব দারুণ উপভোগ করেছেন অন্না। বন্ধুদের সঙ্গে মার্বেলের গুলি নিয়ে খেলেছেন। ছোটবেলায় ঘুড়ি ওড়াতে ভালোবাসতেন। আকাশে ফত ফত করে ওড়া ঘুড়ি দেখে নিজের মনকেও উড়িয়ে দিতেন। আরেকটা জিনিস দারুণ লাগত সেটা হল পায়রা ওড়ানো। পায়রারা কেমন সুন্দর আকাশে ওড়ে। কত দূর দূর যায়। আবার নিজের ঘরে ফিরে আসে। গোটা প্রক্রিয়াটার মধ্যে একটা এমন শিক্ষা আছে যা ওঁকে টানত। খেলাধুলোয় এতবেশি মন ছিল যে পড়াশুনোয় তেমন মন দেননি ছোটবেলায়। আমাদের বললেন সেকথা। বলছিলেন, “তবে মাথা পরিষ্কার ছিল। তাই স্কুলে ক্লাসে মাস্টার মশাই যা বলতেন মনে থেকে যেত। পরীক্ষায় তাই লিখতেন। অভ্যাস না করেই পরীক্ষায় খুব ভালো নম্বর পেতেন। ক্লাসে স্ট্যান্ডও করতেন। কিন্তু খেলতে খেলতে কোথা থেকে সময় পেরিয়ে যেত সে দিকে হুঁশ থাকত না। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই রাস্তায় রাস্তায় মাঠে ঘাটে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতেন বন্ধুদের সঙ্গে। যখন খুব খিদে পেত তখন বাড়ি ফিরতেন। কখনও সন্ধে সাতটা সাড়ে সাতটা বেজে যেত বাড়ি ফিরতে ফিরতে।

রালেগন সিদ্ধির যাদববাবা মন্দিরে বসে অন্নার সঙ্গে এই সাক্ষাতের মধ্যে দিয়ে আরেক অন্নাকে আমরা খুঁজে পেলাম। আন্তরিক অন্না। সততার প্রতীক হিসেবে যে মানুষটাকে মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী বলে আমরা মনে করি সেই অহিংস অসহযোগী সত্যাগ্রহী অন্না অবলীলায় জানিয়ে দিলেন তিনি কবে মিথ্যে বলেছেন। স্কুলে পড়ার সময় একবার। স্কুলের শিক্ষক হোম-ওয়ার্ক দিয়েছিলেন। যেমন দেওয়া হয়। কিন্তু একদিন অন্না সেই হোম-ওয়ার্ক করেননি। স্কুলে থেকে এসে খেলার চক্করে হোম-ওয়ার্ক করতে ভুলে যান। খেলে ধুলে বাড়ি ফিরে এসে ঘুম পায় ঘুমিয়ে পড়েন। পরের দিন স্কুলে গিয়ে মাস্টার মশাই হোম-ওয়ার্ক চাইলে অন্না বলেন বাড়িতে ফেলে এসেছেন খাতা। মাস্টারমশাই বাড়িতে পাঠিয়ে দেন অন্নাকে। বাড়িতে এসে মার কাছে সবটা খুলে বলেন। শুধু তাই নয় পরের দিন মাকে স্কুলে গিয়ে আরও বড় মিথ্যে বলার কথাও বলেন। যে বাড়ি আসার পর মা তাকে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজে পাঠিয়ে দিয়েছিল তাই সে স্কুলে ফিরে যেতে পারেননি। মা রেগে যান। মিথ্যে বলতে অস্বীকার করেন। তখন অন্না বলেন যে তাহলে আর সে স্কুলেই যাবেন না। ছেলের অন্যায় আবদারে যশোদার মত মেনে নিতে বাধ্য হন মা। অন্নাকে কিষণ বলেই সবাই ডাকত ফলে যশোদা সুলভ এই কাজটা করেই ফেললেন মা। কিন্তু সেই শেষ। এই ঘটনায় অন্না ভিতরে ভিতরে অশান্ত হন। লজ্জিত অপমানিত হন। কেউ না জানলেও অন্না মনে মনে জানতেন, তাঁর মা জানতেন। সেই যন্ত্রণা থেকেই অন্না জীবনে আর কখনও মিথ্যে বলেননি, অসত্যের পথে আর কখনও হাঁটেননি। অন্যায়, অত্যাচার আর হিংসার বিরুদ্ধে তিনি যত আন্দোলন করেছেন, সরব হয়েছেন ততই তিনি গ্রামের আদুরে কিষণ থেকে অন্না হয়ে উঠেছেন। অন্না মানে বড় দাদা। পারিবারিক ভাবেও অন্না ভাইয়েদের মধ্যে বড় ছিলেন। সেদিক থেকে ভাইয়েদের কাছে অন্না তো ছিলেনই। কিন্তু অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময়, সত্যিকারের অন্না হয়ে উঠলেন। পরিবারের বাইরের লোকেদের কাছেও। অন্নার জীবনে ওঁর মাবাবার প্রভাব খুব বেশি ছিল। মায়ের ভালোবাসা আর বাবার দৃঢ়তাই ওঁকে শক্তিশালী করেছে।

পরের অধ্যায়ে আমরা দেখব কীভাবে বাবা মায়ের প্রভাব পড়েছে অন্নার জীবনে।