স্ট্যান্ড আপ কমেডি বিদেশে বেশ জনপ্রিয়। বরং একটু দেরিতেই ভারতে এসেছে । তবে গত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশেও রমরমিয়ে চলছে স্ট্যান্ড আপ কমেডি। উঠে আসছেন প্রতিভাবান শিল্পীরাও।
কেনেথ সেবেস্টিয়ান, বেঙ্গালুরুর এই কৌতুক শিল্পী এই ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য নাম। বাবা প্রতিরক্ষা বিভাগে কাজ করায় স্কুলের দিনগুলি কেটেছে দেশের বিভিন্ন রাজ্য। বাবার অবসরের পর বেঙ্গালুরুতে পাকাপাকিভাবে থাকা শুরু করে সেবেস্টিয়ান পরিবার। “২০০৭ সালে নবম বা দশম শ্রেনিতে পড়ার সময়, ইউটিউব তখন সবে জনপ্রিয় হচ্ছে, একটি ভিডিও দেখি, কিছু বাচ্চা স্টার ওয়ারসের লাইলসেবার ব্যাটন বানিয়েছিল নিজেরা, সেটা বানানোর পদ্ধতিও দেখানো হয়েছিল ভিডিওটাতে, সেই প্রথম ফিল্ম বানানোতে উত্সাহী হই আমি”, বললেন কেনেথ।
কর্ণাটক চিত্রকলা পরিষদে স্নাতকস্তরে পড়ার সময় প্রতিবেশী অনিকেত দাশগুপ্তর থেকে ক্যামেরা ধার করে ইউটিউবের জন্য স্পেশ্যাল এফেক্ট ফিল্ম তৈরি করতে শুরু করেন কেনেথ, কেনেথ বললেন, “সেই সময় খুব কম ভারতীয়রই ইউটিউব চ্যানেল ছিল”।
চিত্রকলা পরিষদে পড়ার সময়ই থিয়েটার ক্লাসে ভর্তি হন কেনেথ, সেখানে আলাপ হয় সিদ্ধান্ত সুন্দরের সঙ্গে। “সিদ্ধান্ত আমার বানানো ফিল্মগুলি খুবই পছন্দ করে ও আমাকে ওঁর কিছু ফিল্ম এডিট করতে বলে। আমি ওর ছবি এডিট করি এবং কর্পোরেট ফিল্ম বানাতে শুরু করি। আমার রাতগুলো কাটতো কর্পোরেট ফিল্ম আর অন্যান্য প্রজেক্টে, দিন কলেজে। এই সময় দিনে অন্তত তিন ঘন্টা আমি ইউটিউব দেখে কাটাতাম। সেই সময়ই স্ট্যান্ড আপ কমেডি দেখতে শুরু করি আমি, আমার সব থেকে পছন্দের শো ছিল হুজ লাইন ইস ইট এনিওয়ে আর সেইনফেল্ড”, জানালেন কেনেথ।
কৌতুকের জগতে নিজের যাত্রা প্রসঙ্গে কেনেথ বললেন, “১৯ বছর বয়সে আইআইটি, মুম্বইয়ের ফেস্টে গেছিলাম, সেটা আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। সেখানে স্ট্যান্ডআপ কমেডি উত্সব হচ্ছিল, ভাবলাম অংশগ্রহণ করি। চূড়ান্ত ১০ জনের মধ্যে নির্বাচিত হই তার মধ্যে আটজন একেবারেই ভাল ছিল না, আমি ভেবেছিলাম খুব সহজেই আমি জিতে যাব, কিন্তু পুনে থেকে একজন পেশাদার কৌতুক শিল্পী আসেন ও দর্শকদের মন জয় করে নেন, আমি স্বভাবতই বেশ ঘাবড়ে যাই, তাত্ক্ষণিক উদ্ভাবন সব সময়ই আমার জোরের জায়গা, আমি কখনই স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করতে পারি না। তাই স্টেজে উঠে আইআইটি মুম্বইতে আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি, দর্শকদের সেটা ভাললাগে ও আমি সেরা নির্বাচিত হই। ১০ গ্র্যান্ড পুরস্কার হিসেবে পাই, এটা আমার জন্য বড় ব্যাপার ছিল, সেই প্রথম আমি কোনো পুরস্কার পাই”।
প্রথম পুরস্কারে দ্য কমেডি স্টোরে অংশ নেওয়ারও সুযোগ মেলে, যেখানে বীর দাস ছিলেন সঞ্চালক, কিন্তু কাউকে না চেনায় বেঙ্গালুরু ফিরে আসেন কেনেথ। বেঙ্গালুরুতে ফিরে আরও স্ট্যান্ড আপ কমেডি শোতে অংশ নেবেন বলে ঠিক করেন কেনেথ। “খুব কাকতালীয়ভাবে, আমি যেদিন বেঙ্গালুরুতে ফিরি সেদিনই এখানকার এক দৈনিকের প্রথম পাতায় শীরোনাম ছিল ‘প্রবীন কুমার,সঞ্জয় মানকতলা ও সন্দীপ রাওয়ের হাত ধরে বেঙ্গালুরুতে স্ট্যান্ডআপ কমেডির প্রবেশ;, আমি খুবই উত্তেজিত হই এটা দেখে, আর এটিকে একটি সংকেত হিসেবেও দেখি”, বললেন কেনেথ।
তাঁদের ফেসবুকে খুঁজে বের করে তাঁদের দলে যোগ দেওয়ার আবেদন জানিয়ে মেসেজ পাঠান কেনেথ। তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ও তাঁদের সঙ্গে কাজ করার পর কেনেথে তাঁর প্রতিযোগিতায় জেতার কথা বলেন, বলেন দ্য কমেডি স্টোরে সুযোগ পেয়েও সেটা কোথায় না জানাতে তাঁর না যাওয়ার কথা। “আমার এই কথা শুনে ওঁনারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন, বলেন ‘দ্য কমেডি স্টোর লন্ডনের কমেডি ক্লাব, এবং এটি ভারতের একমাত্র কমেডির স্থান, আর তুমি সেখানে সুযোগ পেয়েও যাওনি!’ আমার ভয়ঙ্কর খারাপ লাগে, তবে দুবছর পর আমি আবার সুযোগ পাই”।
প্রবীণ, সঞ্জয় ও সন্দীপের সাহায্যে স্ট্যান্ডআপ শো করতে শুরু করেন কেনেথ, পাঁচ মিনিট, ১০ মিনিট ও তারপর ২০ মিনিটের শো, কিন্তু তিনি আরও বেশি কিছু করতে চাইছিলেন। “তাত্ক্ষনিক উদ্ভাবনে ভাল হওয়ায় আমি মঞ্চে গিটার নিয়ে উঠতে শুরু করি এবং তাত্ক্ষণিকভাবে গান বাঁধতে শুরু করি, গান মুখস্থ করে গাওয়ার থেকে এটা আমার কাছে সহজ ছিল। বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পীদের নকল করতাম আমি, কারণ আমি এভাবেই গানটা শিখেছি, গানের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা আমার নেই”, বললেন কেনেথ।
কেনেথে গিটার কমেডি খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, এরকমই একটি অনুষ্ঠানে মুম্বইয়ের কৌতুক শিল্পী ড্যানিয়েল ফার্নান্ডেজের সঙ্গে পরিচয় হয় কেনেথের, তিনি কেনেথকে মুম্বই যেতে বলেন। সন্দীপও সেই সময়ই মুম্বই যাচ্ছিলেন, এবং তিনি বলেন দ্য কমেডি স্টোরে সুযোগ করে দেবেন কেনেথকে। ততদিনে কেনেথের দুবছর হয়ে গেছে এই জগতে।
দ্য কমেডি শোতে কেনেথের অনুষ্ঠান প্রশংসিত হয়, এবং সপ্তাহান্তে শো করার আমন্ত্রণ পান। অন্যান্য কমেডিয়ানদের সঙ্গে কাজ করার সময় কানন গিলের সঙ্গে আলাপ হয় কেনেথের, তাঁর সঙ্গে স্কেচি বিহেভিয়ার নামে শো করেন কেনেথ। এটা বেশ জনপ্রিয়তা পায়, এরই মধ্যে আলাপ হয় তন্ময় ভাটের সঙ্গে, তাঁর কাছে সাহায্য নিয়ে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করেন কেনেথ।
২০১৪ তে কাননের সঙ্গেই OML এ সুযোগ পান কেনেথ। OML তে অংশ নেওয়ার সময়ই কমেডি সেন্ট্রালের থেকে একটি চুক্তি পান, কিন্তু ভিডিও ফরম্যাট কাজ করছিল না।
“সঞ্জয়, কানন, বিশ্বের মতো বন্ধুরা আমাকে স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে অসম্ভব সাহায্য করে, ৬ দিনে ২০ টা এপিসোড তৈরি করি আমরা, প্রতিদিন ২০ ঘন্টা কাজ করতাম”, কেনেথ বললেন।
চ্যালেঞ্জের কথা বলতে গিয়ে কেনেথ জানালেন, “কাজ করে যেতে হবে ও নতুন নতুন জিনিস করতে হবে। কোনো কিছুরই নিশ্চয়তা নেই, একটা ভিডিও যদি ভাইরাল হয়, পরেরটা আরও ভাল করতেই হবে, তখন ১০০ টা ভিউ আপনি পেতে পারেন না।
থমাস বলে এক কৌতুকশিল্পীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ইউটিউবে নিজের ১ ঘন্টার শো আপলোড করার চিন্তা মাথায় আসে, ভারতে সেই প্রথম। লুই সিকের থেকে ধারণা নিয়ে প্রতি বছর একটি স্পেশাল প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন কেনেথ. বিদেশেও অনুষ্ঠান করতে শুরু করেছে কেনেথ, এবছর জুনে ইউএস ট্যুর করে এসেছেন।
কেনেথের পরিমর্শ, “কমেডি বা স্ট্যান্ডআপকে ভাল না বাসলে এটা করবেন না। শুধু মাত্র টাকা বা জনপ্রিয়তার আশায় কমেডি করবেন না, আপনি যদি যে কোনোও কিছু থেকে টাকা আয় করতে পারেন তবেই কমেডি থেকে পারবেন। আমরা খুবই স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে টাকা রোজগার করি, শুধুমাত্র মঞ্চে উঠে কেউ টাকা পায় না। এটা আপনার কমেডির পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। আমরা কেউ বিখ্যাত হওয়ার জন্য এটা করি না, করি কারণ আমাদের ভাললাগে। মঞ্চে ওঠা ও নানা বিষয় নিয়ে কথা বলাটা আমাদের কাছে স্বপ্ন। যদি আপনি এটা ভালবাসেন এগিয়ে যান, যদি তা না হয় তবে করবেন না”।
(লেখা-সিন্ধু কাশ্যপ, অনুবাদ-সানন্দা দাশগুপ্ত)