স্কুলে জীবনশৈলীর পাঠ নিয়ে হাজির ‘আপনি শলা’

স্কুলে জীবনশৈলীর পাঠ নিয়ে হাজির ‘আপনি শলা’

Monday September 14, 2015,

4 min Read

নেলসন মান্ডেলা বলেছিলেন, ‘পৃথিবী বদলে দিতে শিক্ষাই তোমার হাতে একমাত্র অস্ত্র’। কিন্তু, শিক্ষা বলতে কী শুধু প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে বোঝায়? জীবনশৈলী এবং অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিক্ষা (experiential education) কোথায় পাবে শিশুরা? এই স্কিলগুলিও অত্যন্ত জরুরি এবং পরিস্থিতি বদলে শক্তিশালী অনুঘটক। তবুও বেশিরভাগ স্কুলে সেই শিক্ষার দেখাই পাওয়া যায় না। আর যে শিশুরা নিম্নবিত্ত ঘর থেকে আসে তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও প্রকট। জীবনশৈলী এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যে যে বড় ফাটল তার দু প্রান্তে সেতুবন্ধন তৈরি করতে ৩ মহিলা উদ্যোক্তার হাত ধরে ‘আপনি শলা’র জন্ম। ‘আপনি শলা’ নিম্নবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করে এবং তাদের মানসিক, আত্মীক এবং ভাবনাচিন্তার ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ‘যখন স্কুলগুলি অংক, বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং সাহিত্যে জোর দিচ্ছে তখন কিন্তু এই পড়ুয়ারা জীবনশৈলী এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আজকালকার বাচ্চাদের মধ্যে সামাজিক দক্ষতা, সঠিক আচরণের ধারা, সমস্যা সমাধান এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বিকাশের প্রয়োজন’, বলেন ‘আপনি শলা’র কো-ফাউন্ডার শ্বেতা।

image


জীবনশৈলীর প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আগেই বুঝেছিল শ্বেতা। এনজিওর একজন শিক্ষিকা হিসেবে জীবনশৈলীর আসল মূল্য বুঝতে শেখেন। শ্বেতা একটা ঘটনার কথা বলেন যেটা তাঁর মনে ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে ভাবনার ভিত পালটে দিয়েছিল। শ্বেতা বলেন, ‘যখন ‘ইচ ওয়ান টিচ’-এ শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করছিলাম একটা বাচ্চার আচরণ আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। সাধারণ মানের এক ছাত্র, কোনও কোনও ক্ষেত্রে বেশ ভাল। অথচ তার মধ্যে একটা অসামাজিক প্রবণতা ছিল। কোনও বন্ধু ছিল না। ভীষণ একরোখা। খোঁজখবর করার পর জানতে পারি ওর মদ্যপ বাবা ছেলেটিকে গালিগালাজ করত। তাছাড়া, বাচ্চাটিকে স্কুলের পর কাজও করতে হত। তাই পড়াশোনার দিক থেকে ওই ছাত্রটিকে নিয়ে কোনও সমস্যা না থাকলেও তার জীবনশৈলী একেবারেই ঠিক ছিল না’। এই ঘটনার পর শ্বেতা আর আরামের কর্পোরেট জগতে ফিরতে পারলেন না। বাচ্চা ছেলেটার গল্প তাঁর মনে মনে তাড়না দিচ্ছিল-এই ধরনের আরও অনেক বাচ্চা রয়েছে যাদের পাশে তাঁকে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। কর্পোরেট জীবনকে পিছনে ফেলে শ্বেতা কনটেন্ট ডেভেলপার হিসেবে ‘প্রথম’-এ যোগ দেন । এর মধ্যে শ্বেতা সিদ্ধান্ত নেন আরও পড়াশোনা করবেন এবং টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সে(TISS) আবেদন করেন। কিছুদিনের মধ্যে TISS এ সোশ্যাল এন্টারপ্রেনারশিপ নিয়ে এমএ-তে ভর্তি হন। এখানেই ‘আপনি শলা’র দুই সহকর্মী ও সহপ্রতিষ্ঠাতা অমৃতা এবং অনুকৃতির দেখা পান। TISS এর সেই দিনগুলির কথা মনে করে শ্বেতা বলেন, ‘TISS এ একবছরের মধ্যে আমরা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই। অনুকৃতির মধ্যে সবসময় উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা ছিল এবং কিছু একটা করতে চাইছিল। অন্যদিকে অমৃতা প্রশিক্ষণ নেয় সাইকোলজি এবং কাউন্সেলিংয়ে। 'আমরা জানতাম, এমন কিছু করতে চাইছিলাম যা শিশু এবং শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু কখনও ভাবিনি তিনজন একসঙ্গে কিছু একটা করব। একটা ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম, প্রত্যেকে প্রত্যেককে সাহায্য করব’।

শ্বেতা যখন গরিব ঘরের বাচ্চাগুলিকে জীবনশৈলীর প্রশিক্ষণ দিতে ব্যস্ত, অনুকৃতি এবং অমৃতা তখন লাইব্রেরি মডেলের কথা ভাবছিলেন। যে স্কুলে প্রথম তাঁরা যোগাযোগ করেন জীবনশৈলীর প্রশিক্ষণে বেশ উৎসাহী মনে হয়েছিল। অনেক আলাপ-আলোচনা, চিন্তাভাবনার পর তিন জনে ঠিক করলেন শিশুদের জীবনশৈলীর পাঠ দেবেন একসঙ্গে। যাইহোক, লক্ষ্য স্থির হলেও তাতে পৌঁছন খুব একটা সহজ নয়। স্কুলগুলি যদিও বিশ্বাস করত এই পড়ুয়াদের জন্য জীবনশৈলী অত্যন্ত জরুরি এবং শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। তারপরও এই স্কিলগুলি শেখাতে স্কুলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ‘আপনি শলা’কে। ‘যখন আমরা আমাদের পরিকল্পনার কথা বলি তখন সবার ভালো লেগেছিল। কিন্তু যখনই প্রতিদিনকার ক্লাস রুটিনে একটা স্লট চাইলাম তখনই শুরু হল টালবাহানা’, শ্বেতা বলেন। এই সমস্যা মেটাতে তিনজনে ঠিক করলেন সরকারি স্কুলগুলিতে সরাসরি যাওয়ার চাইতে এনজিওগুলির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবেন। ‘এই এনজিওগুলি কোনওটা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত, কোনওটার সঙ্গে সরকারি স্কুলগুলির টাই-আপ রয়েছে। তাই এনজিওগুলির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগকে কাজে লাগাই এবং লক্ষ্যের দিকে একটু একটু করে এগোতে থাকি। অনেক সংস্থা শিক্ষা নিয়ে কাজ করলেও, জীবনশৈলী নিয়ে তারাও ভাবেনি। আমাদের পরিকল্পনা এনজিওগুলির মনে ধরে। এরফলে এনজিওর মাধ্যমে আমরা স্কুলে যাই এবং জীবনশৈলীর পাঠ চালিয়ে যেতে থাকি’,বলেন শ্বেতা।

পরের যে সমস্যাটায় শ্বেতাদের পড়ত হল সেটা হল নানা স্তর বিশেষ করে সরকারি সংস্থাগুলিতে নানা ধাপ। ‘এই সমস্যা এখনও আছে। হরেক রকম অনুমতি নিতে সরকারি অফিসে নানা টেবিলে ধরনা দিতে হয়। তাতে অবশ্য ক্ষতি নেই, কারণ আমাদের কাজ হয়ে যাচ্ছিল’,জানান শ্বেতা। যখন ‘আপনি শলা’ টিমকে নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছিল, তখন তারা ‘ডিবিএস’কে পাশে পায়। ‘সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে আমরা নতুন এবং বয়সও কম ছিল। ‘ডিবিএস’ কাজটা অনেক সহজ করে দিয়েছিল। ‘ডিবিএস’ আমাদের বিশ্বাস করে টাকার যোগান দিয়েছিল। একমাত্র চিন্তা ছিল সঠিক শিক্ষা এবং সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসা। এটা আমাদের নিজেদের এবং প্রজেক্টের ওপর বিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করেছিল’, বলেন শ্বেতা। সামাজিক এবং মানসিক উন্নয়নের জন্য আপনি শলা এক্সপেরিমেন্টাল ট্রেনিং মডেলে কাজ করছে, যার মধ্যে রয়েছে গল্প বলা, নাটক করা এবং নানা গেমস। ‘আমরা চাই সব স্কুলের সিলেবাসে জীবনশৈলী এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠুক। এবং এটা পরীক্ষামূলকভাবে করা প্রয়োজন’, শ্বেতা যোগ করেন। পরের বছরের মধ্যে আপনি শলা ১১০০ শিশুকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে। শিক্ষক শিক্ষিকাদেরও এর মধ্যে সম্পৃক্ত করে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ইচ্ছে রয়েছে টিম ‘আপনি শলা’র, যেহেতু সমুদ্রের তরঙ্গে মত বয়ে যাচ্ছে এই শিক্ষা পদ্ধতির প্রভাব।


..