গাছের নাম জিৎ-কোয়েল-দেব, ওরা ছোটদের বন্ধু

গাছের নাম জিৎ-কোয়েল-দেব, ওরা ছোটদের বন্ধু

Monday July 10, 2017,

3 min Read

বর্ধমান জেলার মেমারি থেকে কুসুমগ্রাম বাজারের মোড় পার হয়ে পুটশুড়ি গ্রাম-পঞ্চায়েত। তারই এক কোণায় মন্তেশ্বর ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম বিঘা। সেখানে শিশুদের নিয়ে কাজ করে চলেছে ক্রাই – চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউয়ের সহযোগী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিক্রমশীলা এডুকেশন রিসোর্স সোসাইটি। “প্রথাগত শিক্ষাক্রমের মধ্যে দাঁড়িয়েই কীভাবে শিশুদের মধ্যে তাদের চারপাশের প্রকৃতি সম্পর্কে আগ্রহ জাগিয়ে তোলা যায়, কীভাবে চারপাশের মাঠ-ঘাট-পুকুর-গাছপালার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়, এ সব নিয়ে বিক্রমশীলার নিরন্তর ভাবনাচিন্তারই ফসল এই বন্ধুত্ব,” বলছিলেন এডুকেশন সোসাইটির প্রধান শিক্ষক অরুণ সাঁই।

image


জিৎ, কোয়েল, দেব, সুরাইয়া, চুটকি, মুসকান, তনু, হাসিবুলরা ওদের বন্ধু। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত খেলাধুলো, আমোদ-আহ্লাদ সব ওদের সঙ্গেই। এমনকী পড়াশোনাও। সে বন্ধুত্ব এতটাই গভীর যে, বন্ধুদের নিয়ে আলাদা ডায়েরিও লিখতে শুরু করেছে লালবাবু, মণিকা, অনির্বাণ, সামিউন্নিসারা। সে ডায়েরির পাতায়-পাতায় বন্ধুদের ছবি, তাদের পছন্দ-অপছন্দের তালিকা, কীভাবে বন্ধুদের আদর-যত্ন করতে হবে তার হাল-হদিশ।

জিৎ, কোয়েল, দেব, সুরাইয়া, চুটকি, মুসকান, তনু হাসিবুলরা আসলে এক-একটি আমগাছ। চারা নয়, দস্তুরমতো প্রাপ্তবয়স্ক। অথচ এই গাছগুলোর সঙ্গেই বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলেছে শিশুরা। আমবাগানের ছায়ায় ক্লাসের পড়ার ফাঁকে এভাবেই হাতে-কলমে নিতে শুরু করেছে প্রকৃতির পাঠ। চারপাশের প্রকৃতিকে বুঝতে গেলে বইয়ের বাঁধাধরা পাঠ্যক্রমের মধ্যে থেকে নয়, বরং তার বাইরে গিয়ে গাছপালার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলাই যে সেরা উপায়, তা একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ওরা। ছেলেমেয়েদের পরিচর্যায় বিদ্যালয় চত্বরের আমগাছগুলোও যে খুব খুশি, তা বোঝা যায় ওদের চকচকে ডালপাতার দিকে একঝলক তাকালেই।

কীভাবে গাছেদের নাম দিয়েছে, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে চতুর্থ শ্রেণির লালবাবু, মণিকা, অনির্বাণ, সামিউন্নিসা, তুলি, আখতাররা? জিজ্ঞেস করতেই কলকল করে উঠল কচিকাচার দল। “কেন, রোজ সকালে স্কুলে এসে প্রথমেই গাছে জল দিই আমরা। সার দিই। গাছের গোড়া পরিষ্কার করি। শুকনো ডালপালা ভেঙে দিই। গাছে পোকা লাগলে কাঠি দিয়ে ফেলে দিই। পাতায় মাকড়শা জাল বুনলে ছাড়িয়ে দিই। এসব কাজে আমাদের সবসময় সাহায্য করেন শিক্ষকরা।”

তার পর শীতের শেষে যখন গাছে মুকুল আসে, তখন সারাদিন গাছ পাহারা দিতে হয়। জহিরুল আর শিউলি বলল, “এমনিতে সারাবছর গাছে দোল খেল ঠিক আছে কিন্তু মুকুল এসে যাওয়ার পর থেকে আর কাউকে গাছে চড়তে দিই না। তার পর আস্তে-আস্তে মুকুলগুলো বড়ো হয়ে গুটি ধরে। তার পর সেগুলো আরও বড়ো হয়। আমাদের ‘বন্ধুর খাতা’য় আমরা সব ছবি এঁকে রাখি, লিখে রাখি ক’টা গুটি বড়ো হল।”

বন্ধুদের আম চুরি করো না তোমরা?

“কক্ষনও না”, জোরগলায় উত্তর তুলি আর আখতারের। যখন সব গাছের আম পেকে ওঠে, তখন সমস্ত আম পেড়ে এক জায়গায় রাখা হয়। তার পর সেগুলো আমরা সমান ভাগ করে নিই। শিক্ষকদেরও দিই। তবে গাছের সব আম আমরা পাড়ি না। কিছু আমরা রেখে দিই কাঠবেড়ালি আর পাখিদের জন্য। গাছগুলো তো ওদেরও, তাই না?”

এমন উত্তরের পর আর কথা চলে না। শিক্ষক অরুণবাবু জানান, “গাছেরা ওদের বন্ধু ঠিকই। এক-একটি গাছের ওপর ওদের এক-একজনের অধিকার রয়েছে তাও ঠিক। কিন্তু প্রকৃতির পুরোটাই যে মানুষের সম্পত্তি নয়, সেটা যাতে ওরা মাথায় রাখে, তার জন্যই এমন নিয়ম। গাছ তোমার হতেই পারে, কিন্তু তার ফলের ওপর সমান অধিকার আছে পাখিদেরও।”

ক্রাই-এর পূর্বাঞ্চলীয় কার্যক্রমের প্রধান মহুয়া চট্টোপাধ্যায় জানালেন, “এই যে গাছেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে, তাদের দেখভাল করতে-করতেই প্রকৃতির পাঠশালায় ঢুকে পড়েছে ওরা, এর মধ্যে দিয়ে ওরা ফিরে পাচ্ছে শৈশবের হারিয়ে যাওয়া আনন্দগুলোকে। আবার এভাবেই ওরা পড়াশোনার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে। আমরা চাই, সব শিশুদের কাছেই এই বার্তাটা পৌঁছক। তারা বুঝতে পারুক, পড়াশোনা মানে আসলে পাঠ্যক্রমের চোখরাঙানি নয়, বরং একটা খুবই আনন্দময় প্রক্রিয়া। বিক্রমশীলা এডুকেশন রিসোর্স সোসাইটি ও ক্রাই-এর যৌথ উদ্যোগে আমরা শিশুদের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি তাদের মনে সেই আনন্দটাই ফিরিয়ে দিতে চাই।”