চিরায়ত নারীত্বের জয়যাত্রার ব্র্যান্ড Naina Jain

চিরায়ত নারীত্বের জয়যাত্রার ব্র্যান্ড Naina Jain

Sunday November 12, 2017,

6 min Read

নয়না জৈন। ফ্যাশন দুনিয়ায় এখন বেশ নামী একটি ব্র্যান্ড। একটি মানুষ যখন একটি ব্র্যান্ড হয়ে ওঠেন সেই গল্প সব সময়ই খুব প্রেরণা যোগায়। নয়নার কাহিনিটিও সেরকমই একটি প্রেরণা জাগানো কাহিনি। তবে ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার সামনে ভেসে উঠছিল সত্তর আশির দশকের প্রেক্ষাপট। রাজস্থানের সম্পন্ন পরিবারের এক প্রতিভাশালী কিশোরীর মুখ। কোটার মতো শহরের গায়ে তখনও লেগে আছে ব্রিটিশের ছেড়ে যাওয়া সাহেবিয়ানা। পর্দানশীন অন্দরমহল। রাজকীয় কালচার। পুরনো হয়ে যাওয়া ফিটন গাড়ির পাশাপাশি ফিয়েটের পদ্মিনীও ছুটছে ধুলো উড়িয়ে। সেই সব স্মৃতি হাতড়ে শান্ত সম্ভ্রান্ত নয়না জৈন বলছিলেন তাঁর শৈশবের কথা। তাঁর কিশোরী বেলার কথা। তার ছোটবেলার কোটা, আর ছোটবেলার ব্যাডমিন্টন কোর্টের কথা। ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ ছিল। রান্নাবান্না করতে ভালোবাসতেন। কিন্তু সব থেকে বেশি ভালোবাসতেন হাতে ব়্যাকেট নিয়ে লড়ে যেতে। সামনে ধেয়ে আসা কোনও সুযোগই যেন তিনি ছাড়বেন না।

image


বলছিলেন, বাবার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতেন। গাড়ি করে ঘুরে বেড়াতেন। চারদিকে ঠাকুর চাকর পর্যাপ্ত বৈভবের একটি আবহে থেকেও মা ঠাকুমার কাছ থেকে রান্নাবান্না শিখতেন। সেলাই ফোঁড়াইও শিখতেন আগ্রহভরে। জীবনে যাই করেছেন সবেতেই পুরস্কার পাওয়ার মত যোগ্যতার সঙ্গে করেছেন। যে প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছেন সেখানেই প্রথম হয়েছেন। সে রান্নাবান্নাই বলুন কিংবা ব্যাডমিন্টন। আর ফ্যাশনের দুনিয়ায় তো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেই ফেলেছেন কলকাতার নয়না জৈন।

আমি যেই ঘরে বসেছিলাম তার চারদিকে ঝলমলে সব পোশাক ঝুলছিল। ভীষণ এথনিক। যে শিল্পের ক্যানভাসে ঝলমল করছে সোনালি রুপোলী সুতো আর রেশমের উজ্জ্বল রঙের বুনট। নয়না জৈনের ব্রাইডাল কালেকশনের সামনে আপনি দাঁড়িয়ে থাকার অভিজ্ঞতাটি একটি স্তব্ধ হলঘরে গণেশ পাইনের ছবি দেখার মতোই জমকালো। যেন কোথাও শানাই বাজছে। এসরাজের টানা টানা সুর, পেঁয়াজ রঙা রেশমি ঘাগরার পাড় ধরে যেন ভেসে আসছে। মনে হচ্ছিল উৎসবের একটি আলো-ঝলমলে দৃশ্য উঁকি দিয়ে দেখে ফেলছি। সলজ্জ অথচ দৃপ্ত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে অসামান্য পোশাকের ব্রাইডাল কালেকশন। সল্টলেকে নয়না জৈনের বাড়িতে ঢোকার রাস্তাটাও অসামান্য। রেল লাইনের কাঠের পাটাতন আর মোরাম দিয়ে এক অসাধারণ কম্বিনেশন। দরজা ঠেলে ঢুকলেই উপলব্ধি করতে পারবেন যে একটি শিল্পিত আবহের ভিতর আপনি প্রবেশ করছেন।

নয়না জানালেন তিনি কখনও কোনও ফ্যাশন স্কুলে যাননি। পোশাক ডিজাইনিংটা ছোটবেলার নেশা। সেসব সময় বাড়িতে টেলার মাস্টার আসতেন। বৃদ্ধ টেলার মাস্টার রক্ষণশীল পরিবারের মহিলাদের অন্দর মহলে এসে ফরমায়েশ মতো পোশাক বানাতেন। তখন তাঁকে নানান রকম ফ্যাশনের আইডিয়া দিতেন কিশোরী নয়না। হাতে এঁকে বুঝিয়ে দিতেন কী রকম চাইছেন। তাঁর মর্জিমাফিক পোশাক তৈরি হলে খুশিতে আহ্লাদে আটখানা হওয়ার জোগাড় হত। বান্ধবীরা যখন দেখত তখন তারাও নয়নার বানানো পোশাকের অনুকরণে পোশাক বানাতে চাইতো। এক নাগাড়ে শৈশবের কথাগুলো বলে চলছিলেন কলকাতার অভিজাত ডিজাইনার নয়না জৈন। এর মধ্যে একবার শিকঞ্জি চলে এসেছে। একটু চুমুক দিয়ে আবারও শুরু করলেন তাঁর এই অভিযাত্রার কাহিনি।

বাবা ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতেন সরকারি একটি কলেজের ব্যাডমিন্টন কোর্টে। বাবাকে দেখেই ব্যাডমিন্টনের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। ওই কলেজের বাগানের ফুল তোলা আর পোষ্যদের বিস্কুট খাওয়ানো ছাড়াও ব্যাডমিন্টনই ছিল সব থেকে বড় টান। ওখানেই প্রথম খেলা শুরু। প্রথমে খেলাটা মজার জন্যেই ছিল। কিন্তু এত ভালো খেলতে থাকেন যে নয়নার জীবনে কেবল মজার জন্যে ছেলেখেলা হয়ে থাকে না ব্যাডমিন্টন। কোটায় রীতিমত কোচিং নেন। স্কুলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যান। কলেজেও, এমনকি ইউনিভার্সিটিতেও ব্যাডমিন্টনে বেশ নাম ডাক হয়ে যায়। রাজ্য স্তরে এবং জাতীয় স্তরেও ব্যাডমিন্টন খেলেছেন নয়না। এটা ১৯৮০র দশকের কথা।

মেয়ে সন্তান, তাও আবার রাজস্থানের রক্ষণশীল পরিবার। ফলে পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই রেওয়াজ। বাড়িতে রীতিমত নিয়মিত আলোচনা হত। বাড়ির বড়রা বলতেন আর যাই হোক কলকাতায় যেন বিয়ে না হয়। কিন্তু বিধির লিখন, খণ্ডাবে কে! ভালো বিয়ে হল কলকাতাতেই। জৈন সমাজের বেশ নামকরা পরিবারে বিয়ে হয়ে এলেন নয়না। ১৯৮৫ সাল। তখন উত্তর কলকাতায় থাকতেন। তারপর সল্টলেক যখন সবে তৈরি হচ্ছে তখন ওঁরা চলে এলেন সল্টলেকে। ফাঁকা সল্টলেক। সবে বালি ফেলে তৈরি হচ্ছে শহর। সেই সময় থেকে সল্টলেকের বাসিন্দা। কখনও ভাবতেই পারেননি সল্টলেকেও ট্রাফিক সিগনালের প্রয়োজন হতে পারে। ফলে এ ক'দিনে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে যেতে দেখেছেন শহরটাকে। এবং দেখতে দেখতে কলকাতার প্রতি মায়া পড়ে গেছে। কলকাতার সারল্য আর এখানকার মানুষের হৃদয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ এই শিল্পী। বলছিলেন আর পাঁচটা শহরের তুলনায় কলকাতার ভালোটাই বেশি দেখতে পান। বিয়ের পর শাশুড়ি ঠাকরুনের পছন্দ ছিল না বড়ির বৌমা ব্যাডমিন্টন খেলুন। ফলে ওই প্রতিভার ওখানেই ইতি। কিন্তু শাশুড়ি মায়ের প্রেরণাতেই বিকশিত হয়েছে একের পর এক অন্যান্য প্রতিভা। কখনও রান্নার প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে জিতে নিয়েছেন প্রথম পুরস্কার। তাজের শেফেরা তারিফ করেছেন নয়না হাতের মিষ্টি এবং নোনতা রান্নার। পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠান-গুলোয় যখন যেতেন কিংবা কোনও উৎসবের আগে আত্মীয়া মহিলাদের হাতে মেহেন্দি পরানোর সময় এলে অন্যরকমের উৎসাহ পেতেন নয়না। ছবি আঁকার উৎসাহ। হাতের তালুতে আলপনা আঁকার উৎসাহ। কিন্তু মেহেন্দির কোন বানাতে পারতেন না। শাশুড়ি মা কোন বানানোয় দক্ষ। ঘরের কাজে যেমন পারদর্শী নয়নার শাশুড়ি মা তেমনি বাইরের কাজেও তিনি সমান করিৎকর্মা। এবং সব থেকে ভালো পারেন বৌমাকে সমস্ত কাজে উৎসাহিত করতে। দুজনে মিলে মেহেন্দি পরানোর কাজটাতেও এতটাই দক্ষ হয়ে উঠলেন, যে সেই প্রতিযোগিতাতেও প্রথম পুরস্কার বাঁধা। কোথাও শুনেছেন স্টোনের টিপ এখন নতুন ট্রেন্ড। কলকাতার কোথায় যেন স্টোনের টিপ বানানো হয়। সেখান থেকে স্টোনের টিপ এনে, বানানো শিখে নিজেরাই সেই টিপ বানানোর কাজ শুরু করে দিলেন। দুজনে মিলে। শাশুড়ি মা আর বৌমা। তাইই বিক্রি হল রমরম করে। সমাজ সেবা। লায়ন্স ক্লাবের কাজ। পাশাপাশি শখের মেহেন্দি, মজার টিপ বানানো, বিক্রি করা, আর শুদ্ধ শাকাহারি রান্না নিয়ে নানান এক্সপেরিমেন্ট করে যাওয়া। আর পরিবারের কারও বিয়ে থাকলে তত্ত্ব সাজানোর কাজ পেলে তো কথাই নেই।

কিন্তু ১৯৯৬ সাল নাগাদ গোটা কাহিনিতে একটা ছোট্ট টুইস্ট আসে। একবার নয়নার এক বান্ধবী আসেন কলকাতায় রাজস্থান থেকে। একটি পোশাকের একজিবিশনে নিজের পোশাক নিয়ে। তখন নয়না এবং সে এক সঙ্গে একজিবিশনে অংশ নেন। গোটা চল্লিশেক ঘাগরা নিয়ে এসেছিলেন ওই বান্ধবী। সবই প্রায় বিক্রি হয়ে যায়। তারপর আরও কয়েকবার তিনি আসেন। এবং ফেরার সময় কিছু পোশাক রেখে যান নয়নাদের নিচের ঘরে। বলে যান ওরা যাতে বিক্রিটা চালিয়ে যান। কিন্তু নয়না এবং তাঁর শাশুড়ি প্রথমেই রাজি হননি। কিন্তু শ্বশুর মশাই চাইতেন এই কাজটা শুরু করুন নয়নারা। ওদের কাজে সাহায্য করার জন্যে জনৈক পাণ্ডে জী এলেন শ্বশুর মশাইয়ের হাত ধরে। শুরু হয়ে গেল দোকান। বাড়িতেই। যারা জানতেন তারাই আসতেন ঘাগরা, চোলি, শাড়ি কিনতে। ক্রেতাদের রুচি মাফিক জিনিস তৈরি করার পাশাপাশি একটু একটু করে নয়না জৈন নিজেও ডিজাইন করতে শুরু করলেন। ১৯৯৭ সাল থেকে নয়না জৈনের নাম ছড়িয়ে পড়ল। কাপড় বাছাই করতে আমেদাবাদ, রাজস্থান, অসম সব জায়গায় ছুটলেন নয়না। দেশের সেরা ফেব্রিক আনিয়ে দুর্দান্ত সব ব্রাইডাল কালেকশন তৈরি করাতে থাকলেন। ক্রেতারা আসতে থাকলেন দিল্লি, মুম্বাই চেন্নাই এমনকি সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড় থেকেও। কলকাতায় বাড়ির বাইরেও দোকান খুলেছিলেন নয়না। মুম্বাইতেও ছিল দোকান। কিন্তু এখন সেগুলো গুটিয়ে কেবল বাড়িতে আর দিল্লিতে দোকান চলছে। লারা দত্তা থেকে শুরু করে অনুরাধা পড়ওয়াল সকলেই নয়নার ক্লায়েন্ট। বিভিন্ন ফ্যাশন শোয়ে নয়নার ডিজাইন করা পোশাক পুরস্কৃত হয়েছে। বিদেশেও দারুণ চাহিদা।

তিন সন্তানের মা নয়না। তিন জনই মায়ের স্বপ্ন সফল করেছেন। ফ্যাশন টেকনোলজি নিয়ে পড়াশুনো করেছেন সকলেই। এবং তাঁরাও দুর্দান্ত সব ডিজাইন করছেন। দিল্লির স্টোর সামলাচ্ছেন এক মেয়ে। ফ্যাশন শো গুলোয় ছুটছেন আর ব্যবসা বাড়ানোর কাজে লেগে আছেন আরেক মেয়ে। ছেলে অর্পিত আর পুত্রবধূ খুশবুও নয়নার ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। বিশেষত খুশবুর সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম সেও তাঁর শাশুড়ি মায়ের দ্বারা দারুণ প্রভাবিত। বলছিলেন নয়নাই তাঁর প্রেরণার মৌলিক উৎস।