পেটের দায়ে মীন ধরেন সুন্দরবনের মানুষ

পেটের দায়ে মীন ধরেন সুন্দরবনের মানুষ

Wednesday December 30, 2015,

3 min Read

একেই ভরা শীত। কুয়াশায় একহাত দূরেও কিছু দেখা যায় না। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় কালিন্দী, ডামা, বিদ্যাধরি দাপিয়ে বেড়চ্ছে বছর বারোর রাম সরদার। রাম একা নয়, তার মতো আরও অনেকেই রাতের অন্ধকার কেটে আলো ফোটার আগে সুন্দরবনের এই নদীগুলি প্রায় চষে ফেলে পেটের তাগিদে। চিংড়ির মীন ধরে অন্ন সংস্থান হয় সুন্দরবনের দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারগুলির।

image


কখন সন্ধে, কখন সকাল সেদিকে দেখার জো নেই। মালুম হয় না শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা। হিসেব শুধু জোয়ার-ভাটার। ঘড়ি লাগে না।জলের শব্দেই ওরা বুঝে যান,কখন জোয়ার আর কখন ভাটা। কোমর জলে জাল টানতে টানতে দিন-রাত কেটে যায়। নোনা জলে অবশ হয়ে আসে শরীর। ছাড়লে চলবে না, ওটাই যে অন্ন জোগায়। হিঙ্গলগঞ্জের কালীতলা গ্রামে এমন অসংখ্য পরিবারের খোঁজ মিলল যাদের উপার্জনের একমাত্র উপায় চিংড়ির মীন। দিনের আলো ফোটার আগে ছোট ছোট খাড়িতে মীন ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন গ্রামের মহিলারা। স্বামীরা যান বিদ্যাধরী বা ভাসায়। মাছ ধরে যা রোজগার তাতে সংসার চলে না। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সংসারের অনটন মেটাতে স্বামীর সঙ্গে রোজগারে হাত না লাগালেই নয়।

image


অসংখ্য নদী ঘেরা সুন্দরবন৷ বিশ্বের আশ্চর্য ম্যানগ্রোভ অরণ্য৷ যে অরণ্যভূমি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বিচরণভূমি৷ আর নদী, খাল, খাঁড়িগুলিতে আছে কুমির-সহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী, কাঁকড়া, নানা প্রজাতির মাছ, দুর্লভ চিংড়ির সুলভ সহাবস্হান৷ একে ঘিরেই গড়ে উঠেছে সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্। স্বামীরা যখন মাঝ দরিয়ায়, সংসার সামলে মৌসুমি মণ্ডল, জয়া সরদার, শিখা কাহাররা রায়মঙ্গলে যান মীন সংগ্রহে। শুধু রায়মঙ্গল নয়, সন্দেশখালির বড়কলাগাছি, ছোট কলাগাছি, বেতনি, ঘটিহারা, ডাসা, রামপুর, হিঙ্গলগঞ্জের সাহেবখালি, গৌড়েশ্বর, কালিন্দী, হাড়োয়া-মিনাখাঁর বিদ্যাধরী নদীতে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ, বিশেষত মহিলারা মীন ধরতে নেমে পড়েন৷ এই ছবি রোজকার৷ দিন-রাত বলে আলাদা কিছু নেই৷ জোয়ার থেকে যখন নদীতে ভাটা লাগে, মীন ধরতে নেমে পড়েন দল বেঁধে। সঙ্গে বাঁশের চটার ফ্রেমে ঘন মশারির নেট লাগানো টানা জাল আর একটা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি। ভাটা শুরু থেকে সার ভাটা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টা টানা জলে থেকে মীন সংগ্রহ৷ জোয়ার এলে উঠে পড়া৷ আবার ভাটা শুরু হলে নদীতে নামা৷ জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে নদীতে ওঠা-নামা৷ মীন সংগ্রহের পর পাড়ে উঠে বাছাই ।এভাবেই চলে রোজনামচা। জয়া সরদার বলেন, ‘দিনে ১৫০ থেকে ২০০ মীন ধরি৷ কোনও কোনও দিন তারও কম৷ বরাত ভালো থাকলে এক এক দিন আবার ২৫০ থেকে ৩০০ মীনও পাওয়া যায়। ৩০ থেকে ৫০ পয়সায় একেকটা বাগদার মীন বিক্রি হয়৷ তবে বিক্রি করার কোনও জায়গা নেই৷ ব্যাপারীরা হাঁড়ি নিয়ে এসে যা দাম বলে, তাতেই দিয়ে দিতে হয় কষ্টের সংগ্রহ৷ ব্যাপারীদের হাত ঘুরে ডবল দামে বাগদার বাচ্চা চলে যাচ্ছে মেছোঘেরিতে’।

সুন্দরবনের নদীতে টানা জালে মীন ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ৷ সুন্দরবন এবং তার জলজ প্রাণী সম্পদকে রক্ষা করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ইনল্যান্ড ফিশারিজ অ্যাক্ট ১৯৮৪ অনুযায়ী নদীতে বা উন্মুক্ত জলাশয়ে ১২ মিমি বা তার কম কোনও ফাঁস জাল, চট জাল ব্যাবহার করা যাবে না৷ কিন্তু কে মানছে সে নির্দেশিকা৷ পেট যে বড় বালাই৷

গরিবের পেট রাখি না প্রকৃতির ভারসাম্য রাখি, এই দুইয়ের মাঝে পড়ে ভোগান্তি সেই পরিবারগুলির, মীন বেচে যাদের দিন চলে। দীর্ঘ সময় জলে থাকার ফলে শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধে, ওদের ভাষায় যা নোনা ধরা। এত কষ্ট করে মীন ধরেও লাভের গুড় খায় ব্যাপারীরা। জয়া, মানসী, আকমলরা বলেন, সঠিক দাম পাওয়ার ব্যবস্থা, মৎস্যজীবীদের চিকিৎসা, আরেকটু সরকারি নজরদারি থাকলে যথেচ্ছ মীন ধরার প্রবণতা অনেকটাই কমে যেত। অথচ এই চিংড়ি বিদেশে রফতানি করে কোটি কোটি ডলার রোজগার হয় দেশের। তবু ব্রাত্য থেকে যান কাহিনীর পেছনের সেই কারিগর, হাজারো মৎস্যজীবীরা।