একা বাবু পাল চন্দননগরে চিনের সঙ্গে লড়ছেন

একা বাবু পাল চন্দননগরে চিনের সঙ্গে লড়ছেন

Sunday November 08, 2015,

3 min Read

কয়েক পুরুষের পারিবারিক লোহার ব্যবসা। এলাকায় নাম, ডাক। তবুও লোহা-লক্করের আওয়াজ টানত না শিশুমনকে। ছেলেবেলা থেকে আলোর হাতছানি এড়াতে পারেননি। আলো নিয়ে জাদু দেখাতে নিজের মতো করে কিছু করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মূলধনের প্রশ্নে চিন্তায় ছিলেন। দিদি ১০ হাজার টাকা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। পাশে পেয়েছিলেন কাছের মানুষ অশোক কুণ্ডুকে। হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন শ্রীধর দাস। তার পরেরটা ইতিহাস। চন্দননগরের সুপ্রীম পাল এখন এরাজ্যের সবথেকে বড় আলোর শিল্পী। দেশের অন্যতম সেরা। সুপ্রীম নামটা সার্টিফিকেটে আটকে আছে, বাবু পাল নামেই তাঁর আসল পরিচিতি। দশ হাজার টাকার পুঁজি থেকে এখন কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা বাবু পালের। দেশ জয় করে দুবাই শপিং ফেস্টিভ্যালেও তাঁর সমান খ্যাতি।


image


বড়দিন থেকে ফার্স্ট জানুয়ারি পর্যন্ত পার্কস্ট্রিটের রাস্তা আলোর ঝর্ণাধারা, হিডকো কিংবা ইকোপার্কে আলোর কেরামতি। শহরকে রঙিন করার পাশাপাশি দুর্গাপুজোয় শ্রীভূমি, একডালিয়া, কলেজ স্কোয়ারের মতো জায়গায় আলোর জাদুর পিছনে একটাই নাম পাল ইলেকট্রিক। চন্দননগরের এই আলো শিল্পীর হাতযশে মুগ্ধ চিনের উপরাষ্ট্রপতিও। সম্প্রতি রাজারহাটের ইকো পার্ককে আলোয় সাজানোর ভার পড়েছিল পাল ইলেকট্রিকের কর্ণধার বাবু পালের ওপর। সেখানে তাঁর সংস্থার তৈরি ড্রাগন খোদ চিনার উপরাষ্ট্রপতির পছন্দ হওয়ায় অন্যরকম তৃপ্তি পেয়েছেন বাবু পাল। আরও অনেক জিনিসের মতো দেশে আলোর বাজারেও চিনের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সেখানে চিনের ‘হানাদারি’ ঠেকাতে নিজের মতো করে লড়াই চালাচ্ছেন বাবু পাল। এক্ষেত্রে তাঁর ইউএসপি টু-ইন-ওয়ান আলো। অর্থা, এলইডির ওপর ক্যাপ বসিয়ে তার মধ্যে টুনি বাল্ব। এমন একই অঙ্গে আলোর দু’রকম রূপ দেশে আর কেউ করতে পারেননি। বাবু পালের কথায়, ‘‘এলইডির জন্য পরিবেশরক্ষা হল, আবার টুনি ব্যবহার করে চন্দননগর নিজস্বতা বজায় থাকল। টুনির আলোয় যে স্নিগ্ধতা আছে তা আর কিছুতে মেলে না। যেখানেই যাই সেখানে এলইডি নয়, টুনির কথায় সবাই জিজ্ঞাসা করে। অনেক কৌতূহল আছে এই আলো নিয়ে।’’


image


বাংলার টুনি নিয়ে আগ্রহ কী জায়গায় পৌঁছাতে পারে তা ১৯৯৯ সালে বিদেশের মাটিতে টের পেয়েছিলেন বাবু পাল। সেসময় দুবাইতে চলছিল শপিং ফেস্টিভ্যাল। সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর এই শহরে ওই ফেস্টিভ্যালে ৪০ ফুটের দুর্গ বানিয়েছিলেন বাবু পাল। কয়েক কিলোমিটার জুড়ে শপিং ফেস্টিভ্যাল চললেও আলোর কেরামতিতে দর্শনার্থীদের মন জয় করে নেয় পাল ইলেকট্রিকের কাজ। কৌতুহল মেটাতে খোদ দুবাইয়ের রাজা এসে জানতে চেয়েছিলেন এর স্রষ্টা কে। কয়েক বছর আগে রাশিয়ার মস্কো থেকে কিছুটা দূরে একটি রাধাকৃষ্ণ মন্দির সাজানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন বাবু পাল। একবার মুম্বইতে গণেশ পুজোয় কাজ করতে গিয়ে তাঁর অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সিদ্ধিদাতার পুজোয় পাল ইলেকট্রিকের নৈপুণ্য দেখে অনেক উত্সাহী আলো কিনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্রষ্টা চাননি সৃষ্টি হাতছাড়া হোক। শুধু মহারাষ্ট্র নয় গুজরাত, ওড়িশা, রাজস্থান, দিল্লিতেও নাম পেয়েছে চন্দননগরের আলোর কাজ।


image


সাফল্যের মধ্যগগনে থাকলেও শুরুটা কিন্তু এত মসৃণ ছিল না। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত লোহার পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে যখন আলোর ব্যবসায় নামেন, তখন পুঁজি বলতে ছিল মনের জোর। আলোর প্রতি ভাইয়ের দুর্নিবার টান দেখে দিদি সুমিত্রা কুণ্ডুচৌধুরী ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। পাশে পেয়েছিলেন পারিবারিক ঘনিষ্ঠ অশোক কুণ্ডুকে। চন্দননগরের আলো‌ ব্যবসার পুরোধা শ্রীধর দাসের কাছে হাতে ধরে কাজ শিখেছিলেন। সেই শিক্ষাই তাঁকে আক্ষরিক অর্থেই আলোয় ফিরিয়েছে। মুম্বই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বাবু পালের আলোর কেরামতিতে দুর্গামূর্তি জায়গা পেয়েছে। এতে যেমন মনে হয় কাজের স্বীকৃতি মিলেছে, তেমনই আলোর বাজারে চিনের বাড়বাড়ন্ত কিছুটা হলেও রুখে দিয়ে তিনি অন্যরকম আনন্দ পান।


image


বাবু পালের কথায় এবার দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো ও জগদ্ধাত্রী পুজোয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। শুধু তাঁরই সংস্থা এবছর কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। শুধু পুজো নয়, সারাবছর নানা ধরনের আলোর কাজে ‌ব্যস্ত থাকেন পাল ইলেকট্রিকের ৪৪ জন কর্মী। এই টিমওয়ার্কই তাঁর সাফল্যের কারণ। ব্যবসা আরও ছড়াতে অনলাইনেও আসতে চায় পাল ইলেকট্রিক। চন্দননগরের বড় চাঁপাতলার বাসিন্দা বাবু পাল নিজের কাজ করেই থামতে চান না। নতুন প্রজন্মের যারা আলো নিয়ে মাততে চান, তাদেরকে তিনি ট্রেনিং দেন।