আজ আপনাদের এক রাজার গল্প বলব। কলকাতার রাজা। অসমের তিনসুকিয়ায় জন্ম। ১৯৮৮ সালে তিনসুকিয়া নামটা শুনলে হাড় হিম হয়ে যেত। আলফা জঙ্গিদের চারণভূমি ছিল এইসব অঞ্চল। জন্মের পর ওরা চলে আসেন ডিব্রুগড়। ব্রহ্মপুত্রের ধারে একটি ছোট্ট শহর। হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করতেন বাবা। ব্যবসার সূত্রেই রাজস্থান থেকে অসমে চলে এসেছিলেন একটা সময়। রাজনৈতিক অস্থিরতার সামনে ব্যবসা বাঁচানো, জীবন টিকিয়ে রাখা দুরূহ হয়ে ওঠে।
মনীশের জন্মের বছর দুয়েকের মধ্যে অসমের পাততাড়ি গুটিয়ে কলকাতায় চলে আসে এই জৈন পরিবার। দুবছরের শিশু মনীশকে কোলে নিয়েই কলকাতায় হার্ডওয়্যারের ব্যবসা শুরু করেন ওর বাবা। তারপর সেই ব্যবসায় ইতি টেনে অফিস পাড়ায় শুরু করেন চাপাতার দোকান। ১৯৯০ এর দশকে যে যাত্রা শুরু হয় আজ সেটাই মনীশের হাত ধরে অন্য মাত্রা পেয়েছে। সেই প্রসঙ্গে আসব। কিন্তু তার আগে এই রাজার গল্পটা শেষ করি।
মনীশ জৈন। এই নামটার সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় আছে। খেলাধুলোর দুনিয়ায় মনীশ একটি পরিচিত নাম। আন্তর্জাতিক স্নুকার এবং বিলিয়ার্ডের দুনিয়ায় সকলেই একডাকে চেনেন কলকাতার এই রাজাকে। মনীশ। অগুনতি প্রতিযোগিতা জিতেছেন। বিলিয়ার্ড যেমন খেলেন, তেমনি স্নুকার এবং পুলে তিনি সিদ্ধ হস্ত। ছোটবেলা থেকেই এই খেলাটা ওকে টানত। ময়দানে ক্রিকেট ফুটবল খেলেছেন ঠিকই কিন্তু ক্লাবরুমে সবুজ টেবিলে সলিড, স্ট্রাইপ্ড আর ব্ল্যাক বল তাড়া করতে বেশি ভালোবাসতেন ছেলেটি। স্থির করে নেন জীবনে কোন জিনিসটাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাটাই ওর প্রায়োরিটি ছিল। খেলার সূত্রে গোটা দুনিয়া ঘুরেছেন। দেশের হয়ে খেতাব জিতেছেন। একের পর সম্মানের পালক গুঁজেছেন কলকাতার মুকুটে। নিজেকে রাজা মনে করার নিশ্চিত কারণ আছে মনীশের।
২০০৪ সালে বিলিয়ার্ডের কেরিয়ার শুরু করেন। তখন সবে ষোলো বছরের তরুণ। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট জুনিয়ার বিলিয়ার্ড চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় হন। এবং সে বছরই স্নুকার প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান পান। সেই থেকে জেদ চেপে যায়। খেলোয়াড়ি জেদ। জিতবার অদম্য ইচ্ছে ওকে টেনে নিয়ে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ২০০৫ থেকে রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করতে শুরু করেন। ২০০৭, ২০০৮ পর পর রাজ্য স্তরে চ্যাম্পিয়ন হন। ২০০৯ এ প্রথম দেশের হয়ে খেলেন। ২০১০ এ স্পোর্টস কোটায় ভারতীয় রেলে যোগ দেন। ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক স্তরে পেশাদার চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে যান ইউনাইটেড কিংডমের লিডসে। বরদায় জাতীয় বিলিয়ার্ড এবং স্নুকার চ্যাম্পিয়নশিপে ৯ বারের প্রতিযোগী গীত সেটিকে পরাস্ত করেন। ২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়ায় দুর্দান্ত পারফর্মেন্স দেখিয়ে গোটা দুনিয়ার কুর্নিশ আদায় করেন। খেলোয়াড় হিসেবে মনীশ যে বেশ উঁচু দরের প্লেয়ার সেটা ওর প্রতিদ্বন্দ্বীরাও একবাক্যে মেনে নেন। এবার ওর টেবিলে ব্ল্যাক বলটা ওর স্টার্টআপ। টি রাজা। বাবার ব্যবসাকে নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজাতে চান মনীশ। তাই টি রাজা নামে নতুন করে ভারতীয় চাকে ব্র্যান্ডিং করতে চাইছেন এই লড়াকু উদ্যোগপতি। গ্রিন টি, হার্বাল টি থেকে শুরু করে গুজরাটি মশলা চায়ে। সব কিছুকেই দারুণভাবে ব্র্যান্ডিং করেছেন মনীশ। ওর প্রোডাক্ট বিদেশের কাস্টমারদের পাশাপাশি দেশের বাছাই করা নিশ কাস্টমারদের বাজারটাই টার্গেট করছে। গুণগত মান যদি বলেন, এক কথায় সেরাটাই দিচ্ছেন মনীশ। খুব সম্প্রতি শুরু হয়েছে বাজার ধরা। ইতিমধ্যেই চা শৌখিনদের পছন্দের তালিকায় চলে এসেছে টিরাজার কাশ্মীরী কাওয়া চা। ফুলের গন্ধে মম করা সেই চায়ের পাশাপাশি, তুলসী টি-তে চুমুক দিলেই মেজাজ খুশ। আর আছে অসমের চা। লিকার, সঙ্গে লেবু আর সুরভি গাছ গাছালির মিশ্রণ দিয়ে তৈরি সেই পাতা জলে ফেললেই টোটাল রিফ্রেশমেন্ট। ও অসমের কথায় মনে পড়ল, জন্মসূত্রে এই অসমীয়া ছেলেটার সঙ্গে তিনসুকিয়ার একটা নাড়ির টান তো ছিলই, পাশাপাশি জেনে রাখুন মনীশের জীবনসঙ্গিনীও অসমের কন্যে। খেলোয়াড় মনীশের জেতার অদম্য ইচ্ছেটা দেখেই ওর প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। ব্যবসার টেবিলটাতেও মনীশ জানেন ওর বিপরীতে তাবড় সব প্লেয়াররা দাঁড়িয়ে আছেন। তবু জেতার জন্যেই লড়াইটা দাঁতে দাঁত চিপে করে যেতে চান এই তরুণ উদ্যোগপতি।