দোলনের কঠিন লড়াইয়ে শিক্ষাই একমাত্র হাতিয়ার

দোলনের কঠিন লড়াইয়ে শিক্ষাই একমাত্র হাতিয়ার

Monday September 21, 2015,

3 min Read

তিন বছরের মেয়েকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন বাবা। ছোট্ট মেয়েটি তখনই বুঝে নিয়েছিল জীবনের পথ তাঁর সহজ হবে না। আজ বছর তেইশের দোলন পালের একমাত্র আশৈশব সঙ্গী সেই লড়াই। তবে দোলন বিশ্বাস করেন পাশা পাল্টাবেই। ভাগ্যকে হারিয়ে দেবেন শুধু মনোবল, প্রয়াস আর শিক্ষা দিয়ে।

image


সকাল থেকেই হাতে হাতে মায়ের সঙ্গে সংসারের কাজ সামলান। সাড়ে তিন বছরের ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে নিজে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করতে যান। বিকেলে স্থানীয় একটি স্যালোঁয় বিউটি থেরাপিস্টের ট্রেনিং নেন। রাতে ফিরে ছেলেকে পড়ান। সব শেষে কুড়িয়ে কাচিয়ে যেটুকু সময় পড়ে থাকে সেটুকু নিজের পড়াশুনোর জন্য বরাদ্দ। এত কিছুর পরেও হাঁপিয়ে ওঠেন না বছর তেইশের দোলন পাল। সে তার লক্ষ্যে স্থির। এম এ পাশ করবেনই। তারপর হয় ভালো সরকারি চাকরি না হয় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মত ব্যবসা করে সমাজ সংসারকে দেখিয়ে দেবেন যে তিনি পরাজিত নন। যারা প্রয়াস করে তাঁরা পরাজিত হয় না।

দোলন নিজে জীবনে যা যা পাননি সেইসব থেকে সে তার ছোট্ট শিশুকে বঞ্চিত হতে দেবেন না। এই প্রতিজ্ঞা করেছেন দোলন। তাই নিজের এবং ছেলের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতেই দোলনের এই দীর্ঘ লড়াই।

পুরুলিয়ার কদমকুলির মেয়ে। ছোটবেলাতেই তাঁকে ফেলে কোথায় যেন চলে গেলেন বাবা। আর কোনওদিন ফিরে আসেননি। তার এবং মায়ের দায়িত্ব নিজের মামাকেই সামলাতে দেখেছেন দোলন। আর পাঁচটা ছেলেমেয়ে জীবনে যা যা পেয়ে থাকে তার অনেক কিছুই হয়তো ছিল না তাঁর। তখন থেকেই দোলন বুঝে গিয়েছিলেন, জীবনে কিছু করে দেখানোর একটাই উপায়। মন দিয়ে পড়াশুনো করা। 

বরাবরই মেধাবি ছাত্রী। তবে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই বাড়ির সকলের জোরাজুরিতে বিয়ে করতে বাধ্য হন দোলন। তবে বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। মাসখানেক যেতে না যেতেই তার উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করে দোলনের শ্বশুরবাড়ির লোকজন। বিয়ের বছর দেড়েক পর জন্ম হয় পুত্র অরিন্দমের। তবে তাতেও স্বামীর অত্যাচার থামেনি। অবশেষে ২০১২ সালের অক্টোবরে, ৯ মাসের সন্তানকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হন দোলন। এত কিছুর পরেও একটা বিষয় পাল্টায়নি। একদিনের জন্যও পড়াশুনো থামিয়ে দেওয়ার কথা ভাবেননি দোলন পাল। পড়াশুনোর সঙ্গে আপোস করেননি। বিয়ের পরেও পুরুলিয়া নিস্তারিনী মহাবিদ্যালয়ে দর্শন নিয়ে স্নাতকস্তরে ভর্তি হন। স্নাতক হওয়ার পর সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়া শুরু করেন। বর্তমানে সেখানকারই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী দোলন পাল।

আজকের এই প্রযুক্তিনির্ভর জগতে পুঁথিগত শিক্ষাই যে যথেষ্ট নয় তা জানেন দোলন। সেই কারণেই পুরুলিয়া ইয়ুথ কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার থেকে কম্পিউটার শিখেছেন। কষ্ট করে দীর্ঘদিন টাকা জমিয়ে সম্প্রতি একটা ল্যাপটপও কিনেছেন দোলন। এই কম্পিউটারের মাধ্যমে রোজগার বাড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন তিনি। তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের দক্ষতা বাড়ানোর নিরন্তর প্রয়াস করে যাচ্ছেন দোলন। 

এরকম দোলন একা নন। অসংখ্য দোলন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ছোট -বড় মফস্বলে, গ্রামে, পাড়ায়, অলিতে গলিতে গিজগিজ করছেন। দোলনদের নিয়েই এই রাজ্যের নারীত্বের ছবিটা আঁকা যায়। কিন্তু তবু দোলন পাল কোথাও পৃথক। তাঁর লড়াই আর জয়ী হওয়ার অদম্য ইচ্ছেই তাঁকে আলাদা করেছে। সে এখন লড়াকু নারীত্বের প্রতিনিধি। এই কঠিন লড়াইয়ের গল্পের কোনও উপসংহার হয় না। তবে দোলনের আসন্ন সাফল্যই আমাদের একমাত্র কাম্য।